You dont have javascript enabled! Please enable it! 1952.03.24 | সমকালীন পত্রিকায় বাংলা ভাষা প্রচলনের পক্ষে বক্তব্য - সংগ্রামের নোটবুক

সমকালীন পত্রিকায় বাংলা ভাষা প্রচলনের পক্ষে বক্তব্য
বাংলা-বিরােধিতার পশ্চাতে

বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবীমূলে যে আন্দোলন হইয়া গেল, তাহা ভারতীয় অর্থে ভারতীয় এজেন্টদের দ্বারা (লাহােরের ‘জঙ্গ’ এর মতে ইহাদের মধ্যে অনেক সুন্দরী যুবতী’-ও ছিল) সৃষ্ট ও পরিচালিত হইয়াছিল বলিয়া আমাদের বােঝানাে হইয়াছে। অনন্যপায় হইয়া আমরা এসব কথা বুঝিয়াছি’ এবং অনেকে বিশ্বাসও করিয়াছি। .
‘প্রভাতী বার্তা আমাদের এই কথাও বুঝাইবার পবিত্র ব্রত গ্রহণ করিয়াছেন যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাকেন্দ্রগুলি কম্যুনিষ্ট ষড়যন্ত্রের আড়া হইয়া পড়িয়াছে এবং আমাদের ছাত্র ও শিক্ষকরা প্রায় সবাই কমুনিষ্ট ও রাষ্ট্রদ্রোহী হইয়া গিয়াছে। এসব কথাও আমাদের হজম করিতে হইতেছে।
আমাদের এই অসহায় অবস্থা দেখিয়া আরও অনেকেই আজ নতুন করিয়া মুখ খুলিতেছেন জনৈক বুজর্গ সম্প্রতি ফতওয়া দিয়াছেন : ইসলামী তমুদুনের সহিত সংশ্রবশূন্য সংস্কৃত ভাবধারার বাহন বাংলা কোনমতেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গণ্য হইতে পারে না। …… উর্দুর উপরইও পাকিস্তানের দৃঢ়তা ও অখণ্ডতা নির্ভর করে। অন্য কোন ভাষাকে উর্দুর সমমর্যাদা দান করা পাপ।
পাপ বলিয়াই আমরা এটাকে স্বীকার করিয়া লইতাম যদি, বা একমাত্র ইংরাজী কল্যাণে দৈনিকের’ দিল্লীর ‘মিলাপ’ এর (শিখ পরিচালিত আৰ্যসমাজ ও হিন্দ-মহাসভার উর্দু মুখপত্র)। কণ্ঠ হইতে এই একই কথা আমাদের শুনিবার সুযােগ ঘটিত।‘মিলাপ’ ১৬ই মার্চ তারিখে এক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে মন্তব্য করিয়াছেন ‘সত্য কথা এই যে, উর্দুকে যদি একমাত্র রাষ্ট্রভাষা না রাখা হয় অথবা অন্য কোন ভাষাকে যদি রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করিয়া উর্দুর সমমর্যাদা দেওয়া হয়,তবে পাকিস্তানের ভিত্তিই কাপিয়া উঠিবে এবং উহা ধ্বংস হইবে। ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতি ও সংহতি রক্ষার জন্যই পাকিস্তান কায়েম করা হইয়াছে। কিন্তু আৰ্য্য লিপি বিশিষ্ট বাংলা ভাষাকে যদি ঐ দেশের রাষ্ট্রভাষা করা হয়, তবে পাকিস্তান স্থাপনের মূল যুক্তিই হাস্যকর ও অর্থহীন হইয়া পড়িবে। আর্যসমাজ ও হিন্দু মহাসভার উর্দু মুখপত্র ‘মিলাপ’ ১৬ মার্চ তারিখে ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতি ও সংহতির বাহন” উর্দুর পক্ষেও আৰ্য্য লিপি বিশিষ্ট বাংলার বিরুদ্ধে যাহা বলিয়াছেন, উপরােল্লিখিত বিবৃতিটি তাহা হইতে মূলতঃ অভিন্ন। অন্যান্য যে সব বাংলা বিরােধী উর্দুওয়ালা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সম্প্রতি মন্তব্য করিয়াছেন, তাদের ও অনেকের ভাষা, যুক্তি ও চিন্তাধারার সঙ্গে ‘মিলাপ’ এর ভাষা, যুক্তি ও চিন্তাধারার হুবহু মিল দেখা যায়।
এই বিস্ময়কর সােসাছশ্য (?) দেখিয়া কেহ যদি সন্দেহ করেন যে, এই বাংলা বিরােধিতার পশ্চাতে ও বাহিরের কোন বিশেষ মহলের প্রভাব অনুপ্রবেশ করিতে প্রয়াস পাইতেছে, তবে সে সন্দেহকে সম্পূর্ণ অসার বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া সহজ হইবে না। যে আৰ্য্যসমাজী ও হিন্দু মহাসভাওয়ালারা ইসলাম বিরােধিতার জন্য কুখ্যাত তাদেরই কোনাে মুখপত্রের মন্তব্যকে যখন পাকিস্তানী সংবাদপত্রে প্রথম পৃষ্ঠায় ডবল কলমে যমকালাে শিরােনামা দিয়া ফলাও করিয়া ছাপা হয়, তখন সেটাও আর উপেক্ষণীয় বিষয় থাকে না। এটা সত্য যে, পূর্ববঙ্গের লােকেরা উর্দু বিরােধী নয়; উর্দু ও বাংলা দুই-ই তাদের সমান প্রিয়। কিন্তু উর্দুকে আজ পাক-ভারতীয় ভিত্তিতে বাংলার মােকাবিলায় খাড়া করিবার যে চেষ্টা চলিতেছে বলিয়া অনুমিত হয়, তা রীতিমত আশঙ্কাজনক। অবশ্য উর্দু সমর্থক সকলেই যে ইহার সঙ্গে জড়িত তা কিছুতেই বলা চলে না।
যাই হউক, ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে অনেক তথ্যই যবনিকার অন্তরাল হইতে প্রকাশিত হইয়া পড়িতেছে যারা সন্ধানী লােক তাদের এইসব তথ্যের ভিত্তিতেই আসল ব্যাপারটি তলাইয়া বুঝিবার চেষ্টা করিতে হইবে। সরকারকেও এ ব্যাপারে নিস্ক্রিয় থাকিলে চলিবে না।
রাষ্ট্র বহির্ভূত কোন অবাঞ্ছিত মহলের প্রভাব উর্দুর সমর্থনের নামেই হউক আর বাংলার সমর্থনের ভিতর দিয়াই হউক, যদি অনুপ্রবেশ করিতে চেষ্টা করে, তবে তাহাকে সর্বশক্তি দিয়া প্রতিরােধ করিতে হইবে। কমুনিষ্টরা বাংলার সমর্থন করিলে তাহা দোষণীয়, আর আৰ্য্যসমাজী ও হিন্দু মহাসভাওয়ালারা উর্দুর সমর্থন করিলে তাহা গ্রহণীয়, এরূপ হইতে পারে। পরিবেশ অধিকতর ঘােলাটে হইয়া উঠিবার পূর্বেই সকলকে সতর্ক হইতে হইবে।
ইনসাফ, ২৪ মার্চ, ১৯৫২, পৃ.২।

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত