You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলীর মতামত
পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা
— সৈয়দ মুজতবা আলী

পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে শেষ পর্যন্ত বাঙলা ভাষাই হবে সে সম্বন্ধে আমাদের মনে কখনাে কোনাে সন্দেহ ছিল না এবং একথাও নিঃসন্দেহ জানি যে যদিও এখনকার মত বাঙলার দাবী মেনে নেওয়া হয়েছে তবু উর্দুওয়ালারা আবার সুযােগ পেলেই মাথা খাড়া করে উঠতে পারেন। আমরা যে এতদিন এ সমন্ধে বিস্তৃত আলােচনা করিনি তার প্রধান কারণ বাঙলা-উর্দু দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক রঙ ধরে নিয়ে দলাদলির কারণ বয়ে দাড়িয়েছিল ; সে অবস্থায় সুস্থ মনে, শান্তচিত্তে বিচার করার প্রবৃত্তি কোন পক্ষেরই ছিলনা। আবহাওয়া এখন ফের অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে ; এই বেলা উভয় পক্ষের যুক্তিগুলাে ভালাে করে তলিয়ে দেখে নিলে ভবিষ্যতের অনেক তিক্ততা এবং অর্থহীন দ্বন্দ্ব থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে।
উর্দুওয়ালাদের প্রথম ও প্রধান যুক্তি এই : পূর্বপাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান অভিন্ন রাষ্ট্র। সে রাষ্ট্রের কেন্দ্রে যে-ভাষা প্রচলিত পূর্ব-পাকিস্তানে যদি সে-ভাষা প্রচলিত না থাকে তবে রাজনৈতিক ও কৃষ্টিগত সম্পর্ক বিছিন্ন হয়ে যাবে।
উত্তরে আমরা বলি, পূর্ব-পাকিস্তানের আপামর জনসাধারণকে বাঙলা ভুলিয়ে উর্দু শিখিয়ে যদি কেন্দ্রের সঙ্গে এক করে দেওয়া সম্ভবপর হত তাহলে যে এ বন্দোবস্থ উত্তম হত তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন এ কাজ কি সােজা? উত্তরে আমরা বলি একাজ অসম্ভব।
কেন অসম্ভব এ প্রশ্ন যদি কেউ শােধান তবে তার উত্তর দুরকমের হতে পারে। প্রথম রকমের উত্তর দেওয়া যায় ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত দিয়ে। আমরা যদি একথা সপ্রমাণ করতে পারি যে পৃথিবীর ইতিহাসে কস্মিনকালেও এহেন কাণ্ড ঘটেনি এবং যতবার চেষ্টা করা হয়েছে ততবারই সে-চেষ্টা নিফল হয়েছে তবে হয়তাে অনেকেই স্বীকার করে নেবেন যে, অসম্ভব কর্ম সমাধান করার চেষ্টা করেন মূখ, বলদকে দোয়াবার চেষ্টা সেই করে যার বুদ্ধি বলদেরই ন্যায়। ইয়ােরােপ আমেরিকা থেকে উদাহরণ দেব না। উর্দওলারা এসব জায়গার উদাহরণ মেনে নিতে স্বভাবতই গড়িমসি করবেন। তাই উদাহরণ নেব এমন সব দেশ থেকে যেসব দেশকে সাধারণতঃ ‘পাক’ বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়। এসব দেশের ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি উর্দুওলাদের জানার কথা, না জানলে জানা উচিত।
আরব ও ইরানের (পারশ্যের) মানচিত্রের দিকে তাকালেই দেখতে পাবেন যে এ দু’দেশের মাঝখানে কোনাে তৃতীয় দেশ নেই। অর্থাৎ আরব দেশের পূর্ব সীমান্তে যেখানে আব্বী ভাষা এসে শেষ হয়েছে, ঠিক সেখান থেকেই ফার্সী ভাষা আরম্ভ হয়েছে। উত্তর পশ্চিম সীমান্তেও যেখানে আরবী ভাষা শেষ হয়েছে সেখান থেকেই তুকী ভাষা আরম্ভ হয়েছে।
সকলেই জানেন খলিফা আবুবকরের আমলে মুসলিম আরবেরা অমুসলিম ইরান দখল করে। ফলে সমস্ত ইরানের লােক আগুন-পূজা ছেড়ে দিয়ে মুসলিম হয়। মুসলিম শিক্ষা-দীক্ষা মুসলিম রাজনৈতিক অনুপ্রেরণার কেন্দ্রভূমি তখন মদিনা। কেন্দ্রের ভাষা আরবী এবং সে ভাষাতে কুরান নাজিল হয়েছেন, হজরতের বাণী হদীসরূপে সেই ভাষায়ই পরিস্ফুট হয়েছে। কাজেই আমরা অনায়াসে ধরে নিতে পারি যে কেন্দ্রের সঙ্গে যােগসূত্র দৃঢ় করার বাসনায় ইরানে আরবী ভাষা প্রবর্তিত করার ব্যাপক চেষ্টা করা হয়েছিল। আমরা জানি বহু ইরানবাসী ইসলাম গ্রহণ করে আরবী শিখে মুসলিম জগতে নাম রেখে গিয়েছেন। আরাে জানি পরবতী যুগে অর্থাৎ আব্বাসীদের আমলে আরবী রাষ্ট্রকেন্দ্র ইরানের আরাে কাছে এসেছিল। ইরাকের বাগদাদ ইরানের অত্যন্ত কাছে ও আব্বাসী যুগে বহু ইরানী বাগদাদে বসবাস করে উচ্চাঙ্গের আরবী শিখতে সমর্থ হয়েছিলেন। সমস্ত ইরানদেশ তখন আরব গভর্নর, রাজকর্মচারী, ব্যবসাদার, পাইকবরন্দকাজে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। ইরানের সর্বত্র তখন আরবী মক্তব এবং মাদ্রাসার ছড়াছড়ি, আরবীশিক্ষিত মৌলবী-মৌলানায় ইরান তখন গমগম করত।
তবে কেন তিনশত বৎসর যেতে না যেতে ফার্সীভাষা মাথা খাড়া করে উঠল ? দশম শতাব্দীর শেষভাগে দেখতে পাই ফার্সীভাষার নবজাগরণের চাঞ্চল্য সমস্ত ইরানভূমিকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। গল্প শুনি, ফিরদৌসীকে নাকি ফরমাইশ দেওয়া হয়েছিল ইরানের প্রাকমুসলিম সভ্যতার প্রশস্তি গেয়ে যেন কাব্য রচনা করা হয়, এবং ততােধিক গুরুত্বব্যঞ্জক (মুহিম) ফরমাইশ, সে কাব্য যেন দেশজ ফার্সী কথায় রচিত হয়, তাতে যেন আরবী শব্দ বিলকুল ঢুকতে না পারে। গল্পটি কতদূর সত্য বলা কঠিন। কারণ ফিরদৌসির মহাকাব্যে অনেক আরবী কথা আছে কিন্তু এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে আরবী ভাষা যে কোন কারণেই হউক দেশের আপামর জনসাধারণকে তৃপ্ত করতে পারেনি বলেই ফার্সীর অভ্যুত্থান হল। তারপর একদিন ফার্সী ইরানের রাষ্ট্রভাষা হয়ে গেল।
উর্দুওলারা হয়ত বলবেন ইরান শীয়া হয়ে গেল বলেই সুন্নী আরবের সঙ্গে কলহ করে ফার্সী চালাল। এ উত্তরে আছে লােক ঠকানাের মতলব। কারণ ঐতিহাসিক মাত্রই জানেন ফিরদৌসীর পৃষ্ঠপােষক ছিলেন গজনীর সুলতান মাহমুদ এবং তিনি ছিলেন এতই কট্টর সুন্নী যে তিনি সিন্ধু দেশের হাজার হাজার করামিতাকে (ইসমাইলী শীয়া) কতল-ই-আমে অর্থাৎ পাইকারী হননে ফিনারিজহান্নম বা পরলােকে পাঠিয়ে ছিলেন। কাজেই বােঝা গেল যে এই আরবীবিরােধী ফার্সী আন্দোলনের পশ্চাতে শীয়া-সুন্নী দুই সম্প্রদায়ই ছিলেন।
না হয় ইরান শীয়াই হয়ে গিয়েছিল কি’ তুর্কীর বেলা কি? তুকীর আপামর জনসাধারণ সুন্নী এবং শুধু যে সুন্নী তাই নয় হানিফী সুন্নীও বটে। ইরানের মত একদিন তুর্কীতেও আরবী চালাবার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে চেষ্টা সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত তুকী ভাষাই তুর্কের রাষ্ট্রভাষা হল। উর্দুওলাদের স্মরণ থাকতে পারে যে কয়েক বছর পূর্বে তুকী ও ইরান উভয় দেশের জোর জাতীয়তাবাদের ফলে চেষ্টা হয় তুকী ও ফার্সী থেকে বেবাক আরবী শব্দ তাড়িয়ে দেওয়ার। আমরা এ ধরনের উগ্রচণ্ডা জাতীয়তাবাদ ও ভাষা ‘বিশুদ্ধিকরণ’ বাইয়ের পক্ষপাতী নই ; তবুও যে ঘটনাটির কথা উর্দুওলাদের স্মরণ করিয়ে দিলুম তার একমাত্র কারণ, কেন্দ্রের সাথে যােগসূত্র যতই মূল্যবান হউক না কেন তার জন্য মানুষ সব সময় সব কিছু বিসর্জন দিতে রাজী হয় না। (এ স্থলে ঈষৎ অবান্তর হলেও একটি কথা বলে রাখা ভালাে, পাছে উর্দওলারা আমাদের নীতি ঠিক বুঝতে না পারেন- আমরা ভাষা ‘শুদ্ধিকরণে বিশ্বাস করি না বলেই বাঙলা থেকে সংস্কৃত শব্দ তাড়াতে চাইনে। তাহলে বিদ্যাসাগরী পাগলামির পুনরাবৃত্তি করা হবে মাত্র ; আজকের দিনে কে না বুঝতে পারে, বিদ্যাসাগর বাংলা থেকে আরবী ফার্সী শব্দ বর্জন করে কি আহাম্মুখিই না করেছিলেন।
উর্দওলারা হয়তাে প্রশ্ন শুধাবেন, তাহলে মিশরে আরবী চলল কি করে? মুসলমান বিজয়ের পূর্বে মিশরের ভাষা তাে আরবী ছিল না। তার উত্তর এই যে মিশর জয়ের পর লক্ষ লক্ষ আরব মিশরে বসবাস আরম্ভ করে ও কালক্রমে দেশের আদিম অধিবাসী ও বিদেশীতে মিলে গিয়ে যে ভাষা গড়ে ওঠে তারি নাম মিশরী আরবী। সংমিশ্রণ একটি কথা দিয়েই সপ্রমাণ করা যায়; যদিও আরবীতে জিম’ হরফের উচ্চারণ বাংলার ‘জ’-এর মত, তবু মিশরীরা উচ্চারণ করে ‘গ’-এর মত। জবল’ কে ‘গবল’, নজীব’ কে ‘নগীব’ অল্পশিক্ষিত লােক ‘ইজা জা’ নসূরউল্লা’ না বলে বলে ‘ইজাগা ইত্যাদি। অন্যদিক দিয়ে মিশরী ফল্লাহিন (চাষা) ও আরবী বেদুইনের মধ্যে দেহের গঠন, চামড়ার রঙ ইত্যাদিতে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই।
এতগুলাে উদাহরণ দেওয়ার পরও যদি কেউ সন্তুষ্ট না হন তবে তার সামনে একটি ঘরােয়া উদাহরণ পেশ করি। পাঠান-মােগল (এমনকি ইংরেজ রাজত্বের প্রথমদিকে) যুগে এদেশে শুধু কেন্দ্র নয়, সুবাগুলােতে পর্যন্ত ফার্সী ছিল রাষ্ট্রভাষা। তবু কেন সে ভাষা দেশজ হিন্দী বাঙলা প্রভৃতি ভাষাকে মেরে ফেলে নিজে অজরামর হয়ে কায়েমি খুঁটি গাড়তে পারল ? উর্দুওলারা হয়তাে বলবেন, ‘ইংরেজ ফার্সী উচ্ছেদ করে দিল তাই।
কিন্তু সে উচ্ছেদের ব্যবস্থা তাে পাঠান মােগলরাই করে গিয়েছিলেন। পাঠান আমলের বিখ্যাত কবি আমির খুসরৌ ফার্সীতে উচ্চাঙ্গের কাব্য রচনা করে গিয়েছিলেন। অথচ দূরদৃষ্টি ছিল বলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে শেষ পর্যন্ত ফার্সী এদেশে চলবে না, দেশজ ভাষা পুনরায় আপন আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। এ তত্ত্বটা ভালাে করে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই তিনি ফার্সী ও তখনকার দেশজ ভাষা হিন্দী মিশিয়ে কবিতা রচনার একসপেরিমেন্ট করে গিয়েছিলেন। নিচের উদাহরণটি উর্দুওলাদের জানবার কথা :
“হিন্দুবাচ্চেরা ব নিগর আজব হুমন ধরত হৈ।
দর ওয়াকতে সুখ গু তন্ মূহ ফুলে ঝরত হৈ।
গুফতম বিয়া কে বর লবেতাে বােসে বগীর।
গুফৎ আরে রাম ধরম নষ্ট করত হৈ ৷
হিন্দু তরুণ কি অপূর্ব সৌন্দৰ্য্যই না ধারণ করে। যখন কথা বলে তখন মুখ হতে ফুল। ঝরে। বললুম, আয় তাের ঠোটে একটি চুমাে খাবাে-বললে, আরে রাম! ধর্ম নষ্ট করতে হ্যায়। এই এক্সপেরিমেন্টের ফলেই দেখতে পাই শাহজাহানের আমলে উর্দু ভাষা সৃষ্ট হয়েছে ও অষ্টাদশ উনবিংশ শতাব্দীতে দেখতে পাই ফার্সী আস্তে আস্তে হটে গিয়ে উর্দুর জন্য জায়গা করে দিচ্ছেন। আজকের দিনে পরিস্থিতিটা কি? ফার্সীর লীলাভূমি দিল্লা লক্ষ্ণৌয়ে এখন সাহিত্য সৃষ্ট হয় উর্দু ভাষাতে, ফার্সী সেখানে আরবী এবং সংস্কৃতের মত ‘মৃত ভাষা বা ডেড ল্যানগুইজ।
হয়ত উর্দুওলারা বলবেন, উর্দুতে প্রচুর আরবী ফার্সী শব্দ থাকায় তিনি পদে উঠে গেছেন। এর উত্তরে বলি, ফার্সী যে রকম বিস্তর আরবী শব্দ গ্রহণ করেও ফার্সী থেকে গিয়েছে উর্দুও সেইরকম বিস্তর আরবী ফার্সী শব্দ গ্রহণ করা সত্ত্বেও উর্দুই থেকে গিয়েছে, সে এই দেশের দেশজ ভাষা। বিদেশী শব্দের প্রাধান্য অপ্রাচুর্য নিয়ে ভাষার বর্ণ, গােত্রের বিচার হয় না। পূর্ববঙ্গের আলিম-ফাজিলগণ যখন অকাতরে আরবী ফার্সী শব্দ প্রয়ােগ করে বাংলায় ‘ওয়াজ বা ‘পালিক লেকচার’ দেন তখন সে ভাষা আরবী, ফার্সী বা উর্দু নামে পরিচিতি হয় না, সে ভাষা বাঙলাই থেকে যায়।
ঘােড়াটি আমার ভালবাসিত গাে শুনিতে আমার গান
এখন হইতে যে ঘােড়াশালেতে বাধা রবে দিনমান।
জিনি তরঙ্গ সুন্দরী মাের তাতার বাসিনী সাকী।
লীলাচঞ্চলা রঙ্গ নিপুণা শিবিরে এসেছি রাখি।
ঘােড়ার আমার জুটিবে সােয়ার ইয়ার পাইবে সাকী
শুধু মা আমার এ বুড়া বয়সে কঁদিয়া মুদিবে আঁখি।
– সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত
শব্দের প্রাচুর্য অপ্রাচুর্য ভেদে যদি ভাষার বংশ বিচার করতে হয় তাহলে বলতে হবে এই কবিতার চতুর্থ ছত্ৰ সংস্কৃত, পঞ্চম ছত্র আরবী-ফার্সী ও গােটা কবিতাটা খােদায় মালুম কি। কিন্তু উপস্থিত এ আলােচনা মুলতুবি থাক- উর্দু কি হিসাবে ‘পাক’ ও বাঙলা ‘না-পাক’ সে আলােচনা পরে হবে।
এ প্রসঙ্গে উর্দুওলাদের কাছে আমাদের শেষ প্রশ্ন ; ত্রয়ােদশ শতকে মুসলমান কর্তৃক বঙ্গবিজয় থেকে আরম্ভ করে ঊনবিংশ শতকের প্রায় মধ্যভাগ পর্যন্ত ফার্সী উর্দু এদেশে চালু ছিল। শাহজাহানের আমল থেকে আজ পর্যন্ত বেশুমার মৌলবী-মৌলানা, আলিম-ফাজিল দেওবন্দ রামপুর থেকে উর্দু শিখে এসে এদেশে উর্দুতে ওয়াজ ঝেড়েছেন, উর্দুতে ‘গুফতগু’ করেছেন ; মনে পড়েছে ছেলেবেলায় দেখেছি উদ্ধত অর্বাচিন তরুণ যখনই তর্কে মােল্লাদের কাবু করেছে তখনই তারা হঠাৎ উর্দুতে কথা বলতে আরম্ভ করে (আজ জানি সে উর্দু কত ন্যাক্কারজনক ভুলে পরিপূর্ণ থাকত) আপন যুক্তির অভাব বা দুর্বলতা ঢাকবার চেষ্টা করেছেন এবং চাষাভূষার কাছে মুখ বাচিয়েছেন। সে কথা থাক, কারণ এমন মৌলবী মৌলানার সংস্পর্শেও এসেছি যাদের সঙ্গে তর্কে হেরেও আনন্দ পেয়েছি, কিন্তু আসল প্রশ্ন এইসব আলিম-ফাজিলগণ বাংলাদেশের শিক্ষা ও কৃষ্টি নির্মাণের সম্পূর্ণভার হাতে পেয়েও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চেষ্টা করা সত্ত্বেও এদেশের আপামর জনসাধরণকে ‘নাপাক’ বাঙলা ভুলিয়ে ফার্সী বা উর্দু চালাতে সক্ষম হলেন না কেন? ইংরেজী স্কুল তখন ছিল না, সংস্কৃত টোল তখন অনাদত, আরবী-ফার্সী-উর্দু শিখলে তখন উমদা উমদা নােকরী মিলত, বাদশাহ সুবেদারের মজলিসে শিরােপা মিলত, মনসব মিলত, আর আরবী ফার্সীর জরিয়ায় বেহেস্তের দ্বার তাে খুলতই। হইলােক পরলােক উভয় লােকের প্রলােভন সত্ত্বেও বাঙালী মুসলমান নাপাক বাঙলায় কেন কথাবর্তা বলল, জারীমর্সিয়া রচনা করল, ভাটিয়ালী-পীরমুর্শিদী, আউল-বাউল, সঁই-দরবেশী গান গাইল, কেচ্ছা সাহিত্য তৈরী করল, রাধার চোখের পানি নিয়ে বিদাত’ কবিতা পর্যন্ত লিখল? এবং একথাও তাে জানি যে মৌলবী-মৌলানারা এসব লােক সাহিত্যের প্রতি উদাসীন ছিলেন না, তারা বারবার ফতােয়া দিয়েছেন যে এসব সাহিত্য ‘বিদাত’, ‘নাজাইজ’, ‘কুফর, শিরক। তৎসত্ত্বেও এগুলাে এখন খেয়াঘাটে, বাগানে, চাষার বাড়ীতে পড়া হয়, এসব বই এখনাে ছাপা হয়, হাটবারে বটতলায় বিক্রি হয়। শুধু তাই? পাঠান বাদশাহরা পয়সা খরচ করে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মহাভারত, রামায়ণ বাংলায় অনুবাদ করালেন! বাদশাহদের দরবারে বিস্তর আলিম-ফাজিল ছিলেন। তারা তখন নিশ্চয়ই এই ‘ফুজুলে’, ‘বিদাত’, ‘ওয়াছিয়াত’, ইসরাফের বিরুদ্ধে তারস্বরে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাে তত্ত্বকথা এই যে, আজ পর্যন্ত এদেশে পরাগল খান, ছুটিখানের নাম রয়ে গিয়েছে বাঙলা ভাষার পৃষ্ঠপােষক হিসাবে।
কিন্তু আমাদের আসল প্রশ্নটা যেন ধামাচাপা পড়ে না যায়। উর্দুওলাদের কাছে আমার সবিনয় প্রশ্ন ; বাঙলাদেশের কৃষ্টিজগতে প্রায় ছয়শত বৎসর একাধিপত্য করে তারা যখন উর্দু চালাতে পারেন নি তখন বর্তমান যুগের নানা কৃষ্টিগত দ্বন্দ্ব, বহুনিদারুণ দারিদ্র্য, ক্রমবর্ধমান বাংলাসাহিত্য ও ভাষার সঙ্গে বিজড়িত মুসলমান হিন্দুকে তাদের মাতৃভাষা ভুলিয়ে উর্দু চালানাে কি সম্ভবপর ?
আরব ইরান পাশাপাশি দেশ, একদেশ থেকে আকে দেশ গমনাগমনে কোনাে অসুবিধা ছিলনা, উর্দুর তুলনায় আরবী বহু পূত-পবিত্র ভাষা ও সে ভাষা ইসলামের তাবত দৌলত ধারণ করে ; তৎসত্ত্বেও ইরানে যখন আরবী চলল না যে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানেও আবার পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষা প্রচলিত সেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একজোট হবেই বা কি করে আর একে অন্যকে উর্দু শিখাবেই বা কি প্রকারে? এ তাে দুপাচ জন মাষ্টারের কথা নয়, আমাদের দরকার হবে হাজার হাজার লােকের। আর হাজার হাজার নবাগতকে পােষবার ক্ষমতা যদি পূর্ব-পাকিস্তানের থাকতই তবে পূর্ব-পাঞ্জাব থেকে বিতাড়িত হতভাগ্য মুসলমানদের কি পূর্ব-পাকিস্তান এতদিনে আমন্ত্রণ করে চোখের জল মুছিয়ে দিত না, মুখে অন্ন তুলে ধরত না?
হয়ত উর্দুওলারা বলবেন যে, সমস্ত দেশকে উর্দু শেখানাে তাদের মতলব নয় ; তাদের মতলব প্রাইমারী স্কুলে অর্থাৎ গ্রাম্য পাঠশালায় বাঙলা শেখানাে এবং হাইস্কুল ও কলেজ য়ুনিভার্সিটিতে উর্দু চালননা।
তাই যদি হয় তবে ফল হবে এই যে, হাইস্কুল-কলেজে উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত গুণীজ্ঞানীরা কেতাব লিখবেন উর্দুতে। তাতে ইসলামের প্রাচীন ইতিহাস থাকবে, সে ঐতিহ্যের সঙ্গে কঁাধ মিলিয়ে পাকিস্তানের নবীন রাষ্ট্র কিকরে গড়ে তুলতে হবে তার কায়দা-কানুনের বয়ান থাকবে, আল্লা রসুলের বাণী সেসব কেতাবে নতুন করে প্রচারিত হবে এবং এ-সব তাবত দৌলতের ভােগী হবেন উর্দু জননেওলারা। অথচ পূর্ব-পাকিস্তানের শতকরা ৮০/৯০ জন চাষা মজুর তাদের শিক্ষা সমাপ্তি যে পাঠশালা পাশের সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে যাবে সে কথাও নিশ্চয় জানি এবং তারা এসব কেতাব পড়তে পারবেন না। এই শতকরা আশিজনের উপর যে নবীন রাষ্ট্র নির্মিত হবে তার আদর্শ নতুন, আকাখা নতুন এবং সে আদর্শে পৌছানাের জন্য যেসব বয়ান উর্দু ভাষাতে লেখা হবে তারা সেসব পড়তে সক্ষম হবে না। অর্থাৎ শতকরা আশিজন কোনাে কিছু না জেনে শুনে আদর্শ রাষ্ট্র গড়াতে উঠে পড়ে লেগে যাবে।
এ বড় মারাত্মক ব্যবস্থা, এ বড় অনৈসলামিক কব্যবস্থা। প্রাচীন ঐতিহ্যপন্থী মৌলবীমৌলানাকে যত দোষ দিতে চান দিন কিন্তু এ দোষ তঁাদের জানী দুষমনও দিতে পারবেন না যে তারা ধনী এবং গরীবের জন্য পৃথক পৃথক শিক্ষা ব্যবস্থা করেছিলেন। ধনীর ছেলেকে তারা যেমন আরবী-ফারসী-উর্দু শিখিয়েছিলেন, গরীবের ছেলেকেও ঠিক সেই কারিকুলামের ভেতর দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। যদি পাকচক্রে আমাদিগকে কোনদিন উর্দু গ্রহণ করতেই হয় এবং স্বীকার করে নিতেও হয় যে আমাদের সাহিত্য এবং অন্যান্য সৃষ্টি উর্দুতেই হবে, তবে আমরা পাঠশালায়ও উর্দু চালাবাে। দেবভাষা ও গনভাষা বলে পৃথক পৃথক বস্তু স্বীকার করা ইসলাম ঐতিহ্য পরিপন্থী।
পাকিস্তান বড়লােকের জন্য নয়, গরীবের হক পাকিস্তানে বেশী।
ইংরেজও ‘ভদ্রলােক’ ও ‘ছােটলােকের ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা করে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। ইংরেজ কৃষি রিপাের্ট বের করত ইংরেজি ভাষায় এবং চাষাভূষাদের শিখাতাে বাঙলা। বােধহয় ভাবতাে বাঙালি মাছিমারা’ কেরানী যখন ইংরেজি না জেনেও ইংরেজি দলিলপত্র নকল করতে পারে তখন ইংরেজি অনভিজ্ঞ চাষাই বা ইংরেজিতে লেখা কৃষি রিপাের্ট, আবহাওয়ার খবরাখবর পড়তে পারবে না কেন? এই পাগলামি নিয়ে আমরা কত ঠাট্টা-মস্করা করেছি সেকথা হয়ত উর্দুওলারা ভুলে গিয়েছিলেন কিন্তু আমরা ভুলিনি। তাই শুধাই, এবার কি আমাদের পালা? এখন আমরা কৃষি-রিপাের্ট, বাজারদর, আবহাওয়ার খবরাখবর বের করব উর্দুতে আর চাষীদের শেখাব বাঙলা ! খবর শুনে ইংরেজ লন্ডনে বসে যে অট্টহাসি ছাড়বে আমরা সিলেটে বসে তার শব্দ শুনতে পাব। উর্দুওলারা বলবেন, ‘ক্ষেপেছ? আমার উর্দু কৃষিরিপাের্ট বাংলাতে অনুবাদ করে চাষার বাড়ীতে পাঠাব।
উত্তরে আমরা শুধাই সে অনুবাদটি করবেন কে? কৃষি রিপাের্টের অনুবাদ করা তাে পাঠশালা পাসের বাঙলা বিদ্যে দিয়ে হয় না। অতএব অতখানি বাঙলা শেখানাের জন্য হাইস্কুলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙলা পড়াতে হবে। অর্থাৎ আমাদের সকলকে স্কুল কলেজে বাঙলা উর্দু দুই-ই বেশ ভালাে করে শিখতে হবে (কৃষি রিপাের্ট ছাড়া উর্দুতে লেখা অন্যান্য সৎসাহিত্যও তাে বাঙলাতে তর্জমা করতে হবে); ফলে দুই কুলই যাবে, যেমন ইংরেজ আমলে গিয়েছিল–না শিখেছিলুম বাঙলা লিখতে, না পেরেছিলুম ইংরেজি ঝাড়তে।
ইংলণ্ড, ফ্রান্স, জার্মানীতে যে উচ্চ শিক্ষার এত ছড়াছড়ি সেখানেও দশ হাজারের মধ্যে একটি ছেলে পাওয়া যায় না যে দুটো ভাষায় সড়গড় লিখতে পারে। আরব, মিশরের আলিম ফাজিলগণও এক আরবী ছাড়া দ্বিতীয় ভাষা জানেন না।
না হয় সব কিছুই হল কিন্তু তবু মনে হয়, এ বড় অদ্ভুত পরিস্থিতি – যে রিপাের্ট পড়নেওলার শতকরা ৯৯ জন জানে বাঙলা সে রিপাের্টের মূল লেখা হবে উর্দুতে! ব্যবস্থাটা কতদূর বদখত বেতালা তার একটা উপমা দিলে আমার বক্তব্য খােলাসা হবে ; যেহেতুক পূর্ব পাকিস্থানে উপস্থিত শ’খানেক রুটিখানেওলা পাঞ্জাবী আছেন অতএব তাবৎ দেশে ধান চাষ বন্ধ করে গম ফলাও! তা সে আল-বাধা, জলে-টি-টুম্বর ধানক্ষেতে গম ফলুক আর নাই ফলুক ! উর্দুওলারা তবু বলবেন, ‘সব না হয় মানলুম, কিন্তু একথা তাে তােমরা অস্বীকার করতে পারবে না যে কেন্দ্রের ভাষা যে উর্দু সে সম্বন্ধে পাকাপাকি ফৈসালা হয়ে গিয়েছে। পূর্বপাকিস্তানের লােক যদি উর্দু না শেখে তবে করাচীর কেন্দ্রীয় পরিষদে তারা গাকগাক করে বক্তৃতা ঝাড়বেনই বা কি প্রকারে, এবং আমাদের ছেলে ছােকরারা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে ডাঙর ডাঙর নােকরীই বা করবে কি প্রকারে ?
বক্তৃতা দেওয়া সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য এই যে, আমরা যত ছেলেবেলা থেকে যত উত্তম উর্দুই শিখি না কেন, উর্দু যাদের মাতৃভাষা তাদের সঙ্গে আমরা কস্মিনকালেও পাল্লা দিয়ে পেরে উঠব না। আমাদের উচ্চারণ নিয়ে উর্দুভাষীগণ হাসি-ঠাট্টা করবেই এবং সকলেই জানেন উচ্চারণের মস্করা ভেংচানি করে মানুষকে সভাস্থলে যত ঘায়েল করা যায় অন্য কিছুতেই ততটা সুবিধে হয় না। অবশ্য যাদের গুরদা কলিজা লােহার তৈরি তারা এসব নীচ ফন্দি-ফিকিরে ঘায়েল হবেন না কিন্তু বেশীর ভাগ লােকই আপন উচ্চারণের কমজোরী সম্বন্ধে বেশ সচেতন থাকবেন, বিশেষতঃ যখন সকলই জানেন যে প্রথম বহু বৎসর ধরে উত্তম.উচ্চারণ শেখবার জন্য আমরা ভালাে শিক্ষক জোগাড় করতে পারব না, এবং একথাও বিলক্ষণ জানি যে একবার খারাপ উচ্চারণ দিয়ে বিদ্যাভাস আরম্ভ করলে অপেক্ষাকৃত বেশী বয়সে সে জখমী উচ্চারণ আর মেরামত করা যায় না। দৃষ্টান্তের জন্য বেশী দূর যেতে হবে না। পূর্ববঙ্গের উর্দুভাষাভাষী মৌলবী সাহেবদের উচ্চারণের প্রতি একটু মনােযােগ দিলেই তাদের উচ্চারণের দৈন্য ধরা পড়ে। সে উচ্চারণ দিয়ে পূর্ব বাঙলায় ওয়াজ দেওয়া চলে কিন্তু যাদের মাতৃভাষা উর্দু তাদের মজলিসে মুখ খােলা যায় না। এমনকি দেওবন্দ রামপুর ফের্তা কোনাে কোনাে মৌলবী সাহেবকে উচ্চারণ করতে শরমিন্দা হতে দেখেছি, অথচ বহু ক্ষেত্রে নিশ্চয় জানি যে, এঁদের শাস্ত্রজ্ঞান দেওবন্দরামপুরের মৌলানাদের সঙ্গে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারে। কিন্তু এরা নিরুপায়, ছেলেবেলা ভুল উচ্চারণ শিখেছিলেন, এখনাে তার খেসারতি ঢালছেন।
কিন্তু কি প্রয়ােজন জান পানি করে ছেলেবেলা থেকে উর্দু উচ্চারণে পয়লানশ্বরী হওয়ায় ? অন্য পন্থা কি নেই?
আছে। গণতন্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ ভূমি সুইজারল্যাণ্ডে চারটি ভাষা প্রচলিত। তাদের পার্লামেন্টে সকলেই আপন আপন মাতৃভাষায় বক্তৃতা দেন। সেসব বক্তৃতা অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করা হয়। উর্দুওলারা প্রশ্ন শুধাবেন এসব বক্তৃতা অনুবাদ করে কারা ?
সেই তত্ত্বটা এইবেলা ভাল করে বুঝে নেওয়া দরকার। এই ধরুন আপনার মাতৃভাষা বাঙলা, আপনি উর্দুও জানেন। কিন্তু উর্দুতে বক্তৃতা দিতে গেলে আপনি হিমসিম খেয়ে যান। অথচ অল্প উর্দু জানা সত্ত্বেও যদি আপনাকে কোন উর্দু বক্তৃতা বাঙলায় তর্জমা করতে হয় তবে আপনি সেটা অনায়াসে করে দিতে পারেন। রবীন্দ্রনাথ যখন ফ্রান্স, জার্মানী, হল্যাণ্ড প্রভৃতি দেশে সফর করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তখন তিনি দুনিয়ার বাহান্নটা ভাষায় বক্তৃতা দেন নি বক্তৃতা দিয়েছিলেন হামেশাই ইংরেজিতে এবং অনুবাদকেরা আপন আপন মাতৃভাষায় সেসব বক্তৃতা অনুবাদ করেছিলেন।
মার্শাল বুলগানিন, আইজেনহাওয়ার, চার্চিল, মাও-সে-তুঙ, চিয়াংকাই-শেক যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ আলােচনা করেন আর চাচিল তাে মামুলি কথা বলতে গেলেও ওজস্বিনী বক্তৃতা ঝাড়েন – তখন সকলেই আপন আপন মাতৃভাষাতেই কথা বলেন। দোভাষী তজুমানরা সেসব আলাপ-আলােচনার অনুবাদ করেন।
এত বড় সে ইউনাইটেড নেশনস অরগানাইশেন (উনাে), Cখানে দুনিয়ার প্রায় তাবৎ ভাষাই শুনতে পাওয়া যায়, সেও চলে তর্জুমানদের মধ্যস্ততায়।
পাঠক হয়ত বলবেন অনূদিত হলে মূল বক্তৃতার ভাষার কারচুপি অলঙ্কারের ঝলমলানি, গলা ওঠানাে-নাবানোের-লম্ফঝম্ফ মাঠে মারা গিয়ে বক্তৃতা রসকষহীন সাদামাঠা হয়ে বেরােয়, ওজস্বিনী বক্তৃতা তখন একঘেয়ে রচনা পাঠের মত শশানায়। সে কথা ঠিক – যদিও প্রফেশনাল এবং বিচক্ষণ তজুমান মূলের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ জৌলুস রাখতে সমর্থ হন। কিন্তু যখন সব বক্তারই বক্তৃতা অনূদিত হয়ে সাদামাঠা হয়ে গেল তখন সকলেই সমান লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন।
গুণীরা বলেন, আলাপ-আলােচনা যেখানে ঝগড়া-কাজিয়ায় পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেখানে কদাচ বিপক্ষের মাতৃভাষায় কথা বলবে না ; তুমি একখানা কথা বলতে না বলতে সে দশখানা বলে ফেলবে। বিচক্ষণ লােক মাত্রই ষ্টেশনে লক্ষ্য করে থাকবেন যে হুঁশিয়ার বাঙালী বিহারী মুটের সঙ্গে কদাচ উর্দুতে কথা বলে না। আর মুটে যদি তেমনি ঘুঘু হয় তবে সেও বাঙলা জানা থাকলেও, আপন উর্দ চালায়। তবু তাে বিহারী মুটেকে কিছুটা ভালাে উর্দু জানা থাকলে ঘায়েল করা যায়, কিন্তু করাচীতে যেসব উর্দুভাষীদের মােকাবেলা করতে হবে তাদের উর্দুজ্ঞান পয়লনম্বরী হবে নিশ্চয়ই। প্রেমালাপের কথা স্বতন্ত্র, সেখানে কোন ভাষারই প্রয়ােজন হয় না, টোটিফুটি উর্দু বললেও আপত্তি নেই। তুলসী দাস কহেন,-
‘জো বালক কহে তােতরি বাতা
সুনত মুদিত নেন পিতু অরু মাতা—
‘বালক যখন আধা-আধা কথা বলে তখন পিতামাতা মুদ্রিত নয়নে (গদগদ হয়ে) সে কথা শােনেন। কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তানের সদস্যগণ শুধুমাত্র রসালাপ করার জন্য করাচী যাবেন – স্বার্থের দ্বন্দ্ব উপস্থিত হলে, দরকার বােধ করলে তাদের তাে বাকবিতণ্ডাও করতে হবে।
কেন্দ্রের ডাঙর ডাঙর নােকরীর বেলাও এই যুক্তি প্রযােজ্য। আমরা যত উত্তম উর্দুই শিখি কেন প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষায় উর্দু-মাতৃভাষীর সঙ্গে কখনােই টক্কর দিতে পারব না। অথচ আমরা যদি আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় পরীক্ষা দিই, এবং উর্দু মাতৃভাষীরা তাদের মাতৃভাষায় পরীক্ষা দেন তবে পরীক্ষায় নিরপেক্ষতা রক্ষা করা হবে। তখন প্রশ্ন উঠবে বাঙালী ছেলেরা উর্দু না জেনে কেন্দ্রে নােকরী করবে কি করে? উত্তরে বলি, সিন্ধি বেলুচি ছেলে যে। প্রকারে কেন্দ্রে কাজ করবে ঠিক সেই প্রকারে তাদের মাতৃভাষাও তাে উর্দু নয়। পাঠানেরা পশতুর জন্য যে রকম নড়াচড়া আরম্ভ করেছেন তাদের ঐ একই অবস্থা হবে। অথবা বলব উর্দু মাতৃভাষীরা যে কৌশলে বাংলাদেশ নােকরী করবেন ঠিক সেই কৌশলে। এ সম্বন্ধে বাকী বক্তব্যটুকু অন্য প্রসঙ্গে বলা হবে।
উর্দুওলারা এর পরও শুধাতে পারেন, “আমরা যদি উর্দু না শিখি তবে কেন্দ্র থেকে যেসব হুকুম, ফরমান, আইন-কানুন আসবে সেগুলাে পড়ব কি করে?” উত্তরে বলি, “তার জন্য ঢাকাতে তর্জুমানদের ব্যবস্থা করতে হবে।” একথা শুনে উর্দওলারা আনন্দে লাফ দিয়ে উঠবেন। বলবেন “তবেই তাে হ’ল। তর্জুমানদের যখন উর্দু শেখাতেই হবে তখন তামাম দেশকে উর্দু শেখালেই পারাে।”
এবড় অদ্ভুত যুক্তি। উদাহরণ না দিলে কথাটা খােলসা হবে না বলে নিবেদন করি, “আরব, ফ্রান্স, জার্মানী, স্পেন, রাশিয়া, চীন ইত্যাদি দেশে পাকিস্তানের লােক রাজদূত হয়ে যাবে। তাই বলে কি পাকিস্তানের লােককে আমরা দুনিয়ার তাবৎ ভাষা শেখাই ?”
ইতিহাস দিয়ে যদি বা সপ্রমাণ করা যায় যে পূর্ব-পাকিস্তানের মত বিশাল দেশের বিপুল সংখ্যক লােককে কখনাে তাদের মাতৃভাষা ভুলিয়ে অন্যভাষা শেখানাে সম্ভবপর হয় নি, ইরান, তুকী প্রভৃতি দেশে এ প্রকারের চেষ্টা সর্বদাই নিষ্ফল হয়েছে, তবু এক রকমের লােক আছে যারা আপন স্বাধিকার প্রমত্ততায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ‘নাথিঙ ইজ ইমপসিবল বুলি কপচান। এ সম্প্রদায়ের লােক যদি দেশের দণ্ডধর না হতেন তবে আমাদের ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজই আর পাঁচজনকে সত্যনিরূপণ করাতে সমর্থ হত। তাই প্রশ্ন, এসব দণ্ডধরদের সামনে অন্য কোন যুক্তি পেশ করা যায়, কি কৌশলে বােঝানাে যায় যে পূর্বপাকিস্তানে ব্যাপকভাবে উর্দু চালানাে সম্পূর্ণ অসম্ভব।
ফার্সীতে বলে জান-মাল’, বাংলায় বলি ‘ধন-প্রাণ মানুষ এই দুইবস্তু বড় ভালােবাসে; ইতিহাস যা বলে বলুক, এই দুই বস্তু যদি মানুষের হাত এবং দেহ ছাড়ার উপক্রম করে তবে দণ্ডধরেরা পর্যন্ত ব্যাকুল হয়ে পড়েন ; হাতের পাখী এবং প্রাণপক্ষী বাঁচাবার জন্য তখন ঝােপের ‘ইমপসিবল’ চিড়িয়ার তালাশী বন্ধ হয়ে যায়। তাই প্রথম প্রশ্ন, ঝোপের উর্দু চিড়িয়া ধরতে হলে যে ফঁাদ কেনার প্রয়ােজন তার খর্চার বহরটা কি?
ধরা যাক আমরা পূর্ব-পাকিস্তানের পাঠশালা, স্কুল, কলেজ সর্বত্র উর্দু চালাতে চাই। পূর্ব-পাকিস্তানে ক’হাজার পাঠশালা, ক’জন গুরুমহাশয়, দ্বিতীয় শিক্ষক, স্কুলমাষ্টার, কলেজ প্রফেসর আছেন জানিনা কিন্তু একথা নিশ্চয় জানি যে কেবলমাত্র পাঠশালাতেই যদি আজ আমরা উর্দুচালাবার চেষ্টা করি তবে আমাদের হাজার হাজার উর্দু শিক্ষকের প্রয়ােজন হবে। সেসব শিক্ষকরা আসবেন বিহার এবং যুক্ত প্রদেশ থেকে। তারা আঠারাে কুড়ি টাকার মাইনেতে পূর্ব বাঙলার গায়ে পরিবার পােষণ করতে পারবেন না।
আমাদের পাঠশালার পণ্ডিত মশাইদের কিছু কিছু জমি-জমা আছে, কেউ কেউ হাল ধরেও থাকেন, এবং তৎসত্ত্বেও তারা যে কি দারিদ্র্যের ভিতর দিয়ে জীবনযাপন করেন সে নিদারুণ কাহিনী বর্ণনা করার মত শৈলী এবং ভাষা আমাদের কলমে নেই। লেখাপড়া শিখেছেন বলে গ্রামের আর পাঁচজনের তুলনায় এঁদের সূক্ষ্মানুভূতি, স্পর্শকাতরতা এবং আত্মসম্মান জ্ঞান হয় বেশী। মহাজনের রূঢ়বাক্য, জমিদারের রক্তচক্ষু এদের হৃদয়-মনে আঘাত দেয় বেশী এবং উচ্চশিক্ষা কি বস্তু তার সন্ধান তারা রাখেন বলে মেধাবী পুত্রকে অর্থাভাবে উচ্চশিক্ষা না দিতে পারাটা এঁদের জীবনে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি। ইত্তেহাদ’, ‘আজাদ’ মাঝে মাঝে এঁদের হস্তগত হয় বলে এঁরা জানেন যে যক্ষারােগী স্বাস্থ্যনিবাসে বহুস্থলে রােগমুক্ত হয়, হয়ত তার সবিস্তর বর্ণনা ও কোনাে রবিবাসরীয়তে তারা পড়েছেন এবং তারপর যখন পুত্র অথবা কন্যা। যক্ষ্মারােগে চোখের সামনে তিলে তিলে মরে তখন তারা কি করেন, কি ভাবেন, আমাদের জানা নেই। বাইবেলি ভাষায় বলতে ইচ্ছা হয়, ‘ধন্য যাহারা অজ্ঞ, কারণ তাহাদের দুঃখ কম। পণ্ডিতের তুলনায় গায়ের আর পাঁচজন যখন জানে না স্বাস্থ্য নিবাস’ সাপ না ব্যাঙ না কি, তখন তারা যক্ষ্মারােগকে কিস্মতের গর্দিশ বলেই নিজকে সান্ত্বনা দিতে পারেন।
সুদূর যুক্ত প্রদেশ, বিহার থেকে যারা উর্দু শেখাবার জন্য বাঙলার জলেভেজা, কাদাভরা, পানাটাকা, জ্বরেমারা পাড়াগায়ে সপরিবার আসবেন তারা মাইনে চাইবেন কত? আমাদের গায়ে গায়ে ফালতাে জমিজমা আর নেই যে চাকরী দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের লাখেরাজ বা ব-খেরাজ ভূ-সম্পত্তি দিয়ে দেব আর তার সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে চন্দ রােজের মুসাফিরী কোনাে সুরতে গুজার করে নেবেন। তাই তাদের মাইনে অন্ততঃপক্ষে কত হওয়া উচিত, আপনারা এবং আর পাঁচজন গাওবুড়ারা মাথা মিলিয়ে ধরে নিন। আমরা মেনে নেব।
যত কমই ধরুন না কেন তার দশমাংশ দেবার মত তাগদও পূর্ব-পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রীর নেই (শুধু পূর্ব-পাকিস্তান কেন, এরকম পাগলা প্লান চালাতে চাইলে ইংলণ্ড, ফ্রান্সেরও নেই)। জমির সার, হালের বলদ, কলকজ্জা কেনা সব কিছুর জন্য পয়সা খরচা বন্ধ করে এই কি এডুকেশনাল এক্সপেরিমেন্ট করার মােকা! এতক্ষণ
‘ধনের কথা হচ্ছিল, এখন ‘প্রাণের কথাটা তুলি।
বিহার, যুক্ত-প্রদেশ থেকে শিক্ষক আনিয়ে তাে আমাদের পাঠশালাগুলাে ভর্তি করা হল। আটার অভাবে তাঁরা মাসহারা পেয়েও অর্ধাহারী রইলেন। তা থাকুন, কিন্তু যেসব হাজার হাজার পাঠশালার বাঙলা শিক্ষককে পদচ্যুত করে বিদেশীদের জায়গা করা হ’ল তারা যাবেন কোথায়? কোনাে দোষ করেন নি, ‘এনিমিজ অব দি ষ্টেট’ এঁরা নন, এঁদের বরখাস্ত করা হবে কোন হক্কের জোরে, কোন ইসলামি কায়দায় ?
পাকিস্তান সফল করেছেন কারা? গ্রামে গ্রামে পাকিস্তানের প্রােপাগাণ্ডা ছড়াল কে, সিলেটের প্রেবিসিটের সময় কুর্তা বিক্রয় করে নৌকা ভাড়া করল কারা, পােলােয় করে মরণপন্ন ভােটারকে বয়ে নিয়ে গেল কার বেটা বাচ্চারা ?
এরাই লড়েছে পাকিস্তান বিরােধীদের সঙ্গে। এরা কুসীনশীন মােটর সওয়ার পলিটিশিয়ান নয়। এরা লড়তে জানে। দরকার হলে এঁরা ঢাকার দিকে ধাওয়া করবে, সঙ্গে যাবে তাদের বাধ্য চাষা-মজুর। তাদের সংখ্যা কি হবে অনুমান করতে পারছিনে, কিন্তু শুনেছি এক ঢাকা শহরের বাঙলাভাষী মুষ্টিমেয় ছাত্র সম্প্রদায়ের হাতেই বাঙলা-উর্দু বাবদে কোনাে কোনাে দণ্ডধর কর্তা ব্যক্তি লাঞ্ছিত অপমানিত হয়েছেন। ছাত্ররা শহরবাসী কিন্তু এরা ‘গ্রাম্য’, এরা প্রাণের ভয় দেখাতে জানে। ধন’ তাে আগেই গিয়েছিল বিদেশ থেকে শিক্ষক আনিয়ে, তখন আরম্ভ হবে প্রাণের উপর হামলা।
খুদা পনাহ। আমরা এ অবস্থার কল্পনাও করতে পারিনে। আমাদের বিশ্বাস, কর্তাব্যক্তিরা তার বহু পূর্বেই “কিতাবুম্মুবীন’ দেখে ‘সিরাতুল মুস্তকীমের সন্ধান পাবেন; ‘ওয়া আম্মাইলা ফলা অহর’, অর্থাৎ ‘সাইল (প্রাথী) দের প্রত্যাখ্যান কোরাে না।” এস্থলে ‘সাইল’ শব্দ আরবী অর্থে নিতে হবে, উর্দু অর্থে নয়, এবং তাহলে কথাটা আমাদের গরীব গুরুমহাশয়দের বেলায়ই ঠিক ঠিক খাটে।
হিটলার কুরানের এ আদেশ মানেন নি। যে র্যোম ও তার সাঙ্গপাঙ্গের কর্মতৎপরতার দরুন তিনি জার্মানীতে তার তৃতীয় রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, দেড় বৎসর যেতে না যেতে তিনি রোম এবং তার প্রধান সহকর্মীদের গুলি করে মেরেছিলেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের কর্তাব্যক্তি কুতুব মিনাররা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন এবং ইসলামে গণতন্ত্রের অর্থ ‘হক’ ও ‘সবর’-এর উপর নির্ভর করা (ওয়া তত্তাসাও বিল হক্তি, ও তত্তাসাও বিস্-সবর)।
এতাে গেল পাঠশালার কথা। হয়ত উর্দওলারা বলবেন যে তারা পাঠশালায় বাংলাই চালাবেন কিন্তু স্কুল, কলেজ পড়াবেন উর্দু। দু’রকম শিক্ষা ব্যবস্থার অধর্ম ও কুফল আমরা পূর্বেই আলােচনা করেছি ; আপাতত শুধু এটুকু দ্রষ্টব্য যে স্কুল কলেজে তাবৎ বিষয়বস্তু উর্দুর মাধ্যমিকে পড়াতে হলে উপস্থিত যেসব শিক্ষকরা এসব বিষয় পড়াচ্ছেন তাদের সকলকে বরখাস্ত করাতে হবে এবং তাদের স্থলে যুক্ত প্রদেশ ও বিহার থেকে হাজার হাজার শিক্ষক আনতে হবে।
কাজেই প্রথম প্রশ্ন, এসব মাষ্টাররা কি অন্ন-হারা হওয়ার দুর্দৈবটা চোখ বুজে সয়ে নেবেন ? প্রত্যক অনুন্নত দেশের বেকার সমস্যার প্রধান অংশ সমাধান করে শিক্ষা বিভাগ, কারণ তার হাতে বিস্তর চাকুরী। পূর্ব পাকিস্তান সে সমস্যার সমাধান দূরে থাক, পূর্বপাকিস্তানী বাঙালী শিক্ষকদের বরখাস্ত করে এবং বাইরের থেকে লােক ডেকে সৃষ্টি করবেন বৃহৎ বেকার সমস্যা।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, ভূগােল, ইতিহাস, অভক এবং কলেজে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, কৃষিবিদ্যা, পূর্ত খনিজ বৈদ্য-শাস্ত্র পড়বার জন্য উর্দুভাষী শিক্ষক পাওয়া যাবে তাে? ভুললে চলবে না যে পূর্ব-পাকিস্তান যদি উর্দু গ্রহণ করে তবে সিন্ধু প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানও ঠিক আমাদের কায়দারই উর্দু গ্রহণ করবে ও উর্দু মাষ্টার, প্রফেসরের চাহিদা ভয়ঙ্কর বেড়ে যাবে। ফলে এখন আমরা ঢাকার স্কুল-কলেজে শিক্ষকদের যে মাইনা দিচ্ছি সে মাইনের দ্বিগুণ অথবা তিনগুণ দিতে হবে এইসব বহিরাগতদের। অত টাকা কোথায় ? এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস উর্দুর মাধ্যমিকে উপরে লিখিত তাবৎ বিষয় পড়াব্যর মত শিক্ষক বিহার, যুক্ত প্রদেশ পাঞ্জাবে প্রয়ােজনের দশমাংশ নেই।
তৃতীয় প্রশ্ন, তাবৎ পাঠ্যপুস্তক উর্দুতে লেখবার জন্য গ্রন্থকার কোথায় ? প্রয়ােজনীয় শিক্ষকের দশমাংশ যখন বাজারে নেই তখন লেখকের দশমাংশও যে পাব না সে তথ্যও
………………………………………………………………..
১. এই পদের উপর মৌলানা ইউসুফ আলীর টীকা : Then there are the people who come with petitions — who have to ask for something. They may be genuine beggars asking for financial help, or ignorant people asking for knowledge, or timid people asking for some lead or encouragement. The common attitude is to scom them or repulse them. The scorn may be shown even when alms or assistance is given to them. Such an attitude is wrong …….. Every petition should be examined and judged on its merits. (সুরা ১৩; ১০)
………………………………………………………………..

অবিসংবাদিত সত্য। কিছু বই লাহাের থেকে আসবে সত্য, কিন্তু বাংলার ভূগােল, ইতিহাস, কৃষিবিদ্যা তাে লাহােরে লেখা হবেনা এবং পূর্ব-পাকিস্তানে এসব বিষয় লেখার লােক নেই। এবং যে ব্যবস্থাই গ্রহণ করি না কেন, আমাদের পাঠ্যপুস্তক লেখকদের রুটি বহু বৎসরের জন্য নির্ঘাত মারা যাবে।
চতুর্থ প্রশ্ন, উর্দু ছাপাখানা, কম্পজিটর, প্রুফ রীডার কোথায়? বাংলা প্রেস, ফরীডাররা বেকার হয়ে যাবে কোথায় ?
এবং সর্বশেষ দ্রষ্টব্য : পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশের স্কুল-কলেজে এখনাে উর্দু শিক্ষার মাধ্যমিক হয় নি। বিবেচনা করি, আস্তে আস্তে হবে। কিন্তু পাঞ্জাবীদের পক্ষে একর্ম অপেক্ষাকৃত সরল হবে কারণ উর্দু তাদের মাতৃভাষা। দরকার হলে কেঁদে কুকিয়ে তারা উর্দুতে আপন আপন বিষয় পড়াতে পারবেন কিন্তু বাঙালী মাষ্টার প্রফেসারের পক্ষে উর্দু শিখে আপন কার্য সমাধান করতে বহু বহু বৎসর লাগবে। ততদিন আমরা ত্রি-লেগেড রেস রান করি? বিশেষ করে যখন কিনা পূর্ব-পাকিস্তানকে শক্তিশালী রাষ্ট্রাংশ করার জন্য আমাদের কর্তব্য (ফরজ বললে ভালাে হয়) উদ্ধশ্বাসে, তড়িৎগতিতে সম্মুখপানে ধাবমান হওয়া।
উর্দুওলারা যদি বলেন, “না আমরা স্কুল কলেজে উর্দু দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে শেখাব, আজ যে রকম ফার্সী, আরবী, সংস্কৃত অপশনাল সেকেণ্ড ল্যানগুইজ হিসাবে শেখাচ্ছি” তাহলে এ প্রস্তাবে যে আমাদের বিন্দুমাত্রও আপত্তি নেই শুধু তাই নয়, আমরা সর্বান্তকরণে সায় দেব। প্রসঙ্গান্তরে সে আলােচনা হবে।
এ বিষয়ে আরেকটি কথা এই বেলা বলে নেয়া ভালাে। সাধারণতঃ ওদিকে কেউ বড় একটা নজর দেয় না। আমাদের প্রশ্ন, সব বিষয় পড়াবার জন্য যদি আমরা উর্দ শিক্ষক পেয়েও যাই, উর্দু শিক্ষয়িত্রী পাব কি ? না পেলে আমাদের স্ত্রীলােকদের শিক্ষার কি ব্যবস্থা হবে উর্দুওলারা ভেবে দেখবেন কি ? আমাদের কাছে পাকাপাকি খবর নেই, কিন্তু শুনতে পাই। বাঙলা শিক্ষয়িত্রীর অভাবেই আমরা যথেষ্ট কাহিল হয়ে পড়েছি। (এস্থানে উল্লেখ করি শ্রীহট্ট শহরের মহিলা মুসলিমলীগ তথা অন্যান্য মহিলারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য গত নভেম্বর মাস থেকে একটানা আন্দোলন করে যাচ্ছেন। তাদের বক্তব্য, পাকিস্তান নবজাত শিশুর ন্যায় নবজাত রাষ্ট্র। মাতৃভাষারূপ মাতৃস্তন্য ব্যতীত অন্য যে কোন খাদ্য তার পক্ষে গুরুপাক হবে)।
উর্দুওলারা কেউ কেউ বলে থাকেন, “অতশত বুঝিনা, আমার চাই, বাংলা ভাষার আজ যে পদ পূর্বপাকিস্তানে আছে ঠিক সেইরকম থাক, এবং ইংরিজির আসনটি উর্দু গ্রহণ করুক।” তার অর্থ এই যে উর্দু উচ্চশিক্ষার মাধ্যমিক (মিডিয়াম অব ইনষ্ট্রাকশন) হােক।
মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোন ভাষা শিক্ষার মাধ্যমিক করলে যে কি প্রাণঘাতী বিষময় ফল জন্মায় তার সবিস্তর আলােচনা না করে উপায় নেই।
প্রথমতঃ পৃথিবীর কোন শিক্ষিত সভ্যদেশ মাতৃভাষা ছাড়া অন্য মাধ্যমে শিক্ষা দিচ্ছে? ইংলণ্ড, ফ্রান্স, জার্মানী, ইতালী, চীন, জাপান, রুশ, মিশর, ইরাক, তুকী, ইরান এমন কোন দেশ আছে যেখানকার লােক মাতৃভাষাকে অবমাননা করে আপন দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে ? আরবী পূত পবিত্র, ঐশ্বর্যশালিনী, ওজস্বিনী ভাষা, কিন্তু কই, তুকী, ইরান, চীন, জাভার কোটি কোটি লােকে তাে আরবীর মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করেনা বিদ্যাভ্যাস শাস্ত্রচর্চা করে না। তবে বাংলার বেলা এ ব্যত্যয় কেন? বাংলা ভাষা-ভাষী লােক সংখ্যা তাে নগণ্য নয়।
সংখ্যা দিয়ে যদি ভাষার গুরুত্ব নির্ণয় করি এবং সে নির্ণয়করণ কিছু অন্যায় নয়— তবে দেখতে পাই চীনা, ইংরিজি, হিন্দী, উর্দু, রুশ, জার্মান, ও স্পেনিশের পরেই বাংলার স্থান। পৃথিবীতে বাংলা ভাষাভাষী সংখ্যা ছয়কোটি (পূর্ব-পাকিস্তানে প্রায় সােয়া চার কোটি) এবং তার তুলনায় ভূবনবিখ্যাত ফরাসী ভাষায় কথা বলে সাড়ে চার কোটি, ইতালিয়ানে চারকোটি, ফার্সীতে এককোটি, তুর্কীতে সত্তর লক্ষ, এমনকি আরবীতেও মাত্র আড়াই কোটি। যে ভাষায় এত লােক সাহিত্য সৃষ্টি করবার জন্য সুযােগ অনুসন্ধান করছে তাদের এতদিন চেপে রেখেছিল মৌলবী মৌলানাদের আরবী-ফার্সী উর্দু এবং পরবর্তী যুগে ইংরেজি। বাংলার সময় কি এখনাে আসেনি, সুযােগ কি সে কোনাে দিনই পাবেনা?
মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য মাধ্যমিকে শিক্ষাদানের দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আছে এবং তার ফল কি সেকথাও ঐতিহাসিকদের অবিদিত নয়। ক্যাথলিক জগতে কেন্দ্র অর্থাৎ পােপের সঙ্গে যােগ রাখার প্রলােভনে (আজ পূর্ব-পাকিস্তান করাচীর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য যে রকম প্রলুব্ধ) একদা ইউরােপের সর্বত্র লাতিনের মাধ্যমিকে শিক্ষাদান পদ্ধতি জনসাধারণের মাতৃভাষার উপর জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছিল। এবং সে পাথর সরাবার জন্য লুথারের মত সংস্কারকও প্রােটেষ্টান্ট ধর্মের মত নবীন সংস্কার পদ্ধতির প্রয়ােজন হয়েছিল। পরবর্তী যুগে দেখতে পাই ফরাসী লাতিনের জায়গা দখল করেছে এবং তার চাপে দিশেহারা হয়ে ফ্রেডরিক দি গ্রেটের মত জার্মান সম্রাট মাতৃভাষা জার্মানকে অবহেলা করে ফরাসীতে কবিতা লিখছেন এবং সে কবিতা মেরামত করার জন্য ফরাসী গুণী ভলতেয়ারকে পৎসদামে নিমন্ত্রণ করেছেন। ঠিক সেই রকম রাশিয়ারও লেগেছিল ফরাসীর নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে। আজ উর্দওলারা বাঙলাকে যে রকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছেন ঠিক সেই রকম জার্মান ও রুশ আপন আপন মাতৃভাষাকে অবহেলা করে বহুবৎসর যশের মন্দিরে প্রবেশ লাভ করতে পারেন নি।
এসব উদাহরণ থেকে এইটুকু স্পষ্ট বােঝা যায় যে, যতদিন পর্যন্ত মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যমিকরূপে গ্রহণ না করা হয় ততদিন শিক্ষা সমাজের উচ্চস্তরের গুটিকয়েক লােকের সংস্কৃতিবিলাসের উপকরণ হয় মাত্র এবং যেখানে পূর্বে শুধু অর্থের পার্থক্য মানুষে মানুষে বিভেদ আনত সেখানে উচ্চশিক্ষা ও সংস্কৃতির পার্থক্য দুই শ্রেণীর বিভেদ বিরােধ কঠোরতর করে তােলে।
এ দেশে যে ইসলামী শিক্ষা কখনাে যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে নি তার প্রধান কারণ বাঙলার মাধ্যমিকে কখনাে শাস্ত্রচর্চা করা হয়নি। যে বস্তু মাতৃভাষায় অতি সহজ, অত্যন্ত সরল, বিদেশী ভাষায় সেই বস্তুই অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাড়ায়। তখন আরম্ভ হয় স্কুল থেকে পালানাের পালা এবং মধ্যবিত্ত ও ধনীর গৃহের চাপের ফলেই এই দুই শ্রেণীর ছেলে তখনাে লেখাপড়া শেখে, কিন্তু অনুন্নত গরীব তখন ভাবে যে পরিবারে যখন কেউ কখনাে লেখাপড়া শেখে নি তখন এই ছেলেই বা পারবে কেন, বাপ-দাদার মত এবও মাথায় গােবর ঠাসা।
মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য মাধ্যমিকে শিক্ষা দিলে যে দেশের কতদুর ক্ষতি হয় তার সামান্যতম জ্ঞান এখনাে আমাদের হয় নি। সে শিক্ষা বিস্তারে যে তখন শুধু অজস্র অর্থ ব্যয় হয় তা নয়, সে শিক্ষা ছাত্রের বুদ্ধিবৃত্তিকে অবশ করে তােলে, কল্পনাশক্তিকে পঙ্গু করে দেয় এবং সর্বপ্রকার সৃজনীশক্তিকে কণ্ঠরােধ করে শিক্ষার আঁতুড় ঘরেই তার গােরস্থান বানিয়ে দেয়।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি আমার অভিজ্ঞতা কলেজের অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষকরূপে অর্জিত সে পশ্চিম ভারতের কার্ভে স্ত্রী মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রীরা যদিও দু এক দিক দিয়ে বােম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের চেয়ে পশ্চাৎপদ তবু স্বাধীন ভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা যেমন তাদের বেশী তেমনি প্রকাশ ক্ষমতা, আত্ম পরিচয়দানের নৈপুণ্য তাদের অনেক বেশী। তার একমাত্র কারণ কার্ভে স্ত্রী মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রীরা আপন আপন মাতৃভাষার মাধ্যমিকে লেখা পড়া করে আর বােম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা লেখাপড়া শেখে ইংরেজির মাধ্যমিকে কার্ভের মেয়েরা সেই কারণে আপন মাতৃভাষায় নিঃসঙ্কোচে অবাধ গতিতে আপন বক্তব্য বলতে পারে, বােম্বাই, কলকাতা, ঢাকার ছেলেরা না পারে বাঙলা লিখতে না জানে ইংরেজি পড়তে।
এ কাহিনীর শেষ নেই কিন্তু আমাকে প্রবন্ধ শেষ করতে হবে। তাই পাঠককে সবিনয় অনুরােধ করি তিনি যেন শিক্ষা বিভাগের কোনাে পদস্থ ব্যক্তিকে এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেন। শ্রীহট্টের খ্যাতনামা আলিম মৌলানা সখাওতুল আম্বিয়া প্রমুখ গুণীগণ আমার সম্মুখে বহুবার স্বীকার করেছেন যে মাদ্রাসাতে যদি বাঙলা ভাষা সর্বপ্রকার বিষয় শিক্ষার মাধ্যমিক হত তবে আমাদের আরবী-ফার্সীর চর্চা এতদূর পশ্চাৎপদ হত না। এবং কৌতুকের বিষয় এই যে, উর্দুওলারা বাংলাকে এত ইনকার নফরৎ, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন তাদেরও অনেকেই কঠিন বিষয়বস্তু যখন উর্দুতে বােঝাতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যান, তখন নোেয়াখালি, সিলেটের গ্রাম্য উপভাষারই শরণাপন্ন হন।
এত সরল জিনিস উর্দুওলাদের কি করে বােঝাই ? কি করে বােঝাই যে পারস্যের লােক যখন ফার্সীর মাধ্যমিকে এবং অন্যান্য তাবৎ বিষয়) শেখে, তুকীর লোেক যখন তুকীভাষার মাধমিকে আরবী শিখে তখন বাঙলার লােক আরবী (এবং অন্যান্য তাবৎ বিষয়) শিখবে উর্দুর মাধ্যমিকে কোন আজগুবি কাণ্ডজ্ঞানহীনতার তাড়নায় ?
এ প্রসঙ্গের উপসংহারে শেষ কথা নিবেদন করি, মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যমিক না করলে সে ভাষা কখনাে সমৃদ্ধিশালী হবার সুযােগ পায় না।
স্বরাজ এলাে পাকিস্তান হ’ল কিন্তু হায়, গােলামী খাসল (মনােবৃত্তি ও আচার ব্যবহার) যাবার কোনাে লক্ষণ তাে দেখতে পারছিনে। এতদিন করলুম ইংরেজীর গােলামী, এখন স্বেচ্ছায় বরণ করে নিচ্ছি উর্দুর গােলামী। খতম আল্লাহ অলা কুলুবিহিম ইত্যাদি। খুদাতালা তাদের বুকের উপর সীল এঁটে দিয়েছেন। (কুরান থেকে এ অংশটুকু এখানে উদ্ধৃত করার কোনাে প্রয়ােজন হত না, যদি কোনাে কোনাে মৌলানা’ বাঙলা ভাষার সমর্থকদের ‘কাফির’ হয়ে যাওয়ার ফতােয়া না দিতেন)।
এইবার দেখা যাক, বাঙলাকে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয়, সরকারি ও সাংস্কৃতিক ভাষারূপে গ্রহণ করতে উর্দুওলাদের আপত্তিটা কি?
তাঁদের প্রধান আপত্তি বাঙলা ‘হেঁদুয়ানি’ ভাষা। বাংলা ভাষায় আছে হিন্দু ঐতিহ্য, হিন্দু কৃষ্টির রূপ। পূর্ব-পাকিস্তানী যদি সে ভাষায় তার রাষ্ট্র ও কৃষ্টির জন্য গ্রহণ করে তবে সে হিদুভাবাপন্ন হয়ে যাবে।
উত্তরে নিবেদন, বাঙলা ভাষা হিন্দু ঐতিহ্য ধারণ করে সত্য, কিন্তু এইটেই শেষ কথা নয়। বাঙলা ভাষার জন্ম হয়েছে হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে।
বুদ্ধদেব যে রকম একদিন বৈদিক ধৰ্ম্ম ও তার বাহন সংস্কৃতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে তৎকালীন দেশজ ভাষায় (পরে পালি নামে পরিচিত) আপন ধর্ম প্রচার করেন, ঠিক সেই রকম বাঙলা ভাষার লিখিত রূপ আরম্ভ হয় বৌদ্ধ চর্যাপদ দিয়ে। পরবর্তী যুগে বাঙলা সাহিত্য রূপ নেয় বৈষ্ণব পদাবলীর ভেতর দিয়ে। আজ পদাবলী সহিত্যকে হিন্দু ধর্মের অংশ হিসাবে গণ্য করা হয় কিন্তু যে যুগে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারিত সে যুগে তাকে বিদ্রোহের অস্ত্রধারণ করেই বেরুতে হয়েছিল। তাই শ্রীচৈতন্য প্রচলিত ধৰ্ম্ম সংস্কৃতে লেখা হয়নি, লেখা হয়েছিল বাংলায়। সঙ্গে সঙ্গে রামায়ণ মহাভারতের যে অনুবাদ বাংলায় প্রকাশিত হয় তার পিছনে ছিলেন মুসলমান নবাব গােষ্ঠী। কেচ্ছা সাহিত্যের সম্মান আমরা দি-হিন্দুরা দেন না এবং সে সাহিত্য হিন্দু ঐতিহ্যে গড়া নয়। এরপর উনবিংশ শতাব্দীতে যে বাংলা গদ্যের পত্তন হয় তার অনুপ্রেরণা খ্রীষ্টান সভ্যতা থেকে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নিজেকে হিন্দু বলে স্বীকার করে কিনা, সে কথা অবান্তর ~ তার অবদান যে উপনিষদ সংস্কৃতি ও ইয়ােরােপীয় প্রভাবের ফলে গঠিত সে কথা অনস্বীকার্য। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রচলিত নতুন ধারাকে বৈদিক কিংবা সনাতন বলা ভুল সে ধারা গণউপাসনার উৎস থেকে প্রবাহিত হয়েছে এবং সে উৎসকে গোড়া হিন্দুরা কখনাে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন নি। স্বামী বিবেকানন্দের জাতীয়তাবাদের মূল বেদ উপনিষদে নয়। উর্দওলারা বলবেন, ‘এসব খুঁটি হিন্দু না হতে পারে, কিন্তু আর যাই হােক না কেন, ইসলামি নয়।
আমরা বলি “ইসলামি নয় সত্য, কিন্তু এর ভিতরে যে ইনকিলাব মনােবৃত্তি আছে সেটি যেন চোখের আড়ালে না যায়। এই বিদ্রোহভাব বাঙলায় ছিল বলে কাজী নজরুল ইসলাম একদিন আপন ‘বিদ্রোহী’ দিয়ে রবীন্দ্রনাথের তথাকথিত ‘মরমিয়াপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করতে পেরেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে যে নবীন কৃষ্টি গঠিত হবে সেটা এই বিদ্রোহ দিয়েই আপন। বিজয় অভিযান আরম্ভ করবে।
এস্থলে সম্পূর্ণ অবান্তর নয় বলে আরেকটি কথা বলি : উত্তর ভারতের তাবৎ সংস্কৃত ভাবাপন্ন ভাষার মধ্যে (হিন্দী, মারাঠী, গুজরাতী ইত্যাদি) বাংলাই সবচেয়ে অসংস্কৃত। হিন্দী, মারাঠী পড়বার বা বলার সময় সংস্কৃত শব্দ খাটি সংস্কৃত উচ্চারণে পড়া এবং বলা হয় ‘পরীক্ষা’ পড়া হয় ‘পরীক’, ‘আত্মা’ পড়া হয় আমা’ কিন্তু বাংলায় সংস্কৃত শব্দ, এমনকি সংস্কৃত ভাষা উচ্চারণ করার সময়ও, উচ্চারণ করা হয় বাংলা পদ্ধতিতে। এ বিষয়ে বাঙালী হিন্দু পর্যন্ত উর্দুভাষী মুসলমানের চেয়ে এককাঠি বাড়া। উর্দুভাষী মুসলমান তার ভাষার সংস্কৃত শব্দ উচ্চারণ করে খাটি সংস্কৃত কায়দায়, বাঙালী হিন্দু উচ্চারণ করে ‘অনার্য, কায়দায়।
না হয় স্বীকার করেই নিলুম, বাঙলা ‘হেঁদুয়ানী’ ভাষা কিন্তু প্রশ্ন, এই ভাষা এতদিন ধরে ব্যবহার করে পূর্ব-পাকিস্তানের মুসলমান কি না-পাক’, হির্দু হয়ে গিয়েছে? পাকিস্তান স্বপ্ন সফল করাতে কি পূর্ব-পাকিস্তানের ‘না-পাক’ মুসলমানদের কোনাে কৃতিত্ব নেই? পাকিস্তান স্বপ্ন কি সফল হল লাহাের, লাক্ষ্মেীর কৃপায়? পূর্ব পাকিস্তানে যারা লড়ল তারা কি সবাই উর্দুর পাবন্দ আলিম, ফাজিল, মৌলানা মৌলবীর দল? না তাে। লড়ল তাে তাড়াই যারা উর্দু জানেনা, এবং বাঙলার জন্য আজ যারা পূনরায় লড়তে তৈরী আছে। এইসব লড়নেওলারা এত দিনকার ইংরেজ আধিপত্য এবং হিন্দু প্রভাবের ফলেও যখন হিন্দুভাবাপন্ন হয়ে যায়নি, তখন পাকিস্তান হওয়ার পর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করলেই তারা রাতারাতি ইসলামি জোশ হারিয়ে পাকিস্তানের শত্রু বনে যাবে? এতাে বড় লজ্জার কথা ! বাঙলা ভাষার এত তাগদ?
দ্বিতীয় বক্তব্য আমরা ইতিহাস নিয়ে আরম্ভ করি। পূর্বেই বলেছি ফিরদৌসীর আমলে ইরানের সর্বত্র আরবী প্রচলিত ছিল – ইরানের রাষ্ট্রভাষা ছিল আরবী। তখনকার দিনে যেটুকু ফারসী প্রচলিত ছিল সে ছিল কাফির’, অগ্নি-উপাষক, জরথুস্ত্রীদের ভাষা। সে ভাষায় একেশ্বরবাদের নামগন্ধ তাে ছিলই না, তাতে ছিল দ্বৈতবাদের প্রচার, এক কথায় সে ভাষা ছিল ন’সিকে ইসলাম বিরােধী, ‘কাফেরী’। তবু কেন সে ভাষা চর্চা করা হল, এবং সে চর্চা করলেন কারা? কাফিরী জয়থুস্ত্রীরা করেনি, করেছিলেন আরবী জাননেওলা মুসলমানেরাই। কেন? তুকীতেও তাই। কেন?
এ দুটো খুঁটি ইসলামি দেশের উদাহরণ ; এবার স্বদেশে সেই দৃষ্টান্ত খোজা যাক। পাঠান মােগল যুগে এদেশে ফার্সী বহাল তবিয়তে রাষ্ট্রভাষার রাজ-সিংহাসনে বসে দেশী ভাষাগুলাের উপর রাজ করত। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সেই ফার্সীর সঙ্গে দেশ হিন্দী মিলিয়ে উর্দুভাষা কেন নির্মাণ করা হল ? কিন্তু সেটা আসল প্রশ্ন নয়, আসল প্রশ্ন যে হিন্দীকে নিয়ে উর্দু বানানাে হল সে ভাষা কি পাক’ ছিল ?
আমরা জানি সে ভাষায় তখন তুলসীদাসের রামায়ণ সর্বশ্রেষ্ঠ পুস্তক — এখনাে তাই। . সেই পুস্তকের আওতায় সমস্ত হিন্দী সাহিত্য গড়ে উঠেছে এবং তাতে আছে ইসলামদ্রোহী কট্টর মতবাদ। বাল্মীকির রামায়ণে যে ব্যক্তি মানুষ, রাজা এবং বীর তিনি তুলসীর রামায়ণে খুদ ভগবানের আসন তসরুপ করে বসে আছেন। ইসলামে মানুষকে আল্লার আসনে তােলা সবচেয়ে মারাত্মক কুফর।
আজকের বাংলাভাষা সেদিনকার হিন্দীর তুলনায় বহুগুণে পাক। আজ বাঙলা সাহিত্যে যে ঈশ্বর গানে কবিতায় নন্দিত হচ্ছেন তিনি সুফীর মরমের আল্লা, হক। তার সন্ধান ‘গীতাঞ্জলিতে’ সে পুস্তক তামাম পৃথিবীতে সম্মান লাভ করেছে।
এবার যে দৃষ্টান্ত পেশ করব সেটি সভয়ে এবং ঈষৎ অনিচ্ছায়। দৃষ্টান্তটি কুরানের ভাষা, নিয়ে এবং এ জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করার হক আলিম ফাজিলদের। কিন্তু শ্রদ্ধেয় গােলাম মােস্তফা সায়েব যখন রসুলুল্লার জীবনী থেকে নজির তােলে পূর্ব বঙ্গবাসী মুসলমানকে পাঞ্জাবী প্রভুত্ব’ বরদাস্ত করতে উপদেশ দিয়েছিলেন, (মক্কা হইতে মােহাজেরগণ যখন দলে দলে মদিনায় পৌছিতে লাগিলেন, তখন মদিনার আনসারগণ মক্কাবাসীদিগকে সাদরে গ্রহণ করিতেন, আজ তাহারা পাঞ্জাবীরা আমাদের দুয়ারে অতিথি। আমাদের কি উচিত নয় তাহাদের প্রতি একটু (!) সহানুভূতি দেখানাে?’ বিস্ময়বােধক চিহ্ন আমার। এখন আমিই বা এমন কি দোষ করলুম?
আরবী ভাষায় কুরান শরীফ যখন অবতীর্ণ হলেন তখন সে ভাষার কি রূপ ছিল ? সে ভাষা কি ‘পাক পবিত্র ছিল, না পৌত্তলিকতার গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত ছিল? আমরা জানি লতি, উজ্জা, মনতি প্রভৃতি দেব-দেবীর প্রশস্তিতে সে ভাষা পরিপূর্ণ ছিল এবং একেশ্বরবাদ বা অন্য কোনাে সত্য ধর্মের (খ্রীষ্ট অথবা ইহুদি) কণামাত্র ঐতিহ্য সে ভাষায় ছিল না।
পক্ষান্তরে আরব দেশে বিস্তর ইহুদি ও খৃীষ্টন ছিলেন। হজরতের বহু পূর্বেই হিব্রুভাষা তওরিত (তােরা’ এবং ওল্ড টেষ্টমেন্ট’) বুকে ধরে পবিত্র ভাষারূপে গণ্য হয়েছিল, এবং হিব্রু উপভাষা আরামমেইকের মাধ্যমে মহা পুরুষ ইসা ইঞ্জিল (এভানজেলিয়াম অথবা বাইবেলের ‘নিউ টেষ্টামেন্ট’) প্রচার করেছিলেন। কুরান অবতীর্ণ হবার প্রাক্কালে হিব্রুভাষা একেশ্বরবাদের চূড়ান্তে পৌঁছে গিয়েছে, এবং বাইবেল ভক্ত মাত্রেই জানেন সেই একেশ্বরবাদ, মৃত্যুর পরের বিচার, এর ফলস্বরূপ স্বর্ণ অথবা নরক ইত্যাদি ইসলামের মূল বিশ্বাস (নবুওত ব্যতীত) প্রচারের ফলে হিব্রুভাষা সেমিতি ধৰ্ম্ম জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করেছিল। তবু কেন সে ভাষায় অবতীর্ণ না হয়ে কুরান শরীফ পৌত্তলিকের ভাষায় নাজিল হলেন?
এ পরম বিস্ময়ের বস্তু এবং শুধু আমরাই যে আজ বিস্মিত হচ্ছি তা নয়, স্বয়ং মহাপুরুষের আমলেও এ বিস্ময় বহু মুখে প্রকাশ হয়েছিল।
কিন্তু সে বিস্ময়ের সমাধান স্বয়ং আল্লাতাল্লা কুরান শরীফে করে দিয়েছেন। পাছে বাংলা অনুবাদে কোন ভূল হয়ে যায় তাই মৌলানা আব্দুল্লা উসুফ আলীর কুরান অনুবাদ থেকে শব্দে শব্দে তুলে দিচ্ছি। আল্লাহ বলেন,
“Had we sent this as
A Quran (in a language)
Other than Arabic, they would
Have said : ‘why are not
It’s verses explained in detail?
What! (a book) not in Arabic
And (a messenger) an Arab?”
অর্থাৎ “আমরা যদি আরবী ভিন্ন অন্য কোন ভাষায় কুরান পাঠাতুম তাহলে তারা বলত এর বাক্যগুলাে ভালাে করে বুঝিয়ে বলা হল না কেন। সেকি! (বই) আরবীতে নয় অথচ (পয়গম্বর) আরব।”
খুদাতালা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, আরব পয়গম্বর এ যে আরবী ভাষায় কুরান অবতরণের আধার হবেন সেই তাে স্বাভাবিক অন্য যে কোন ভাষায় সে কুরান পাঠানাে হলে মক্কার লােক নিশ্চয়ই বলত : ‘আমরা তাে এর অর্থ বুঝতে পারছি না। কুরানের এই অঙ্গুলী নির্দেশমত চললেই বুঝতে পারব ভাষার কৌলীন্য অকৌলীন্য অত্যন্ত অবান্তর প্রশ্ন, আসল উদ্দেশ্য ধর্মপুস্তক যেন আপামর জনসাধারণ বুঝতে পারে। বার বার কতবার কুরানে বলা হয়েছে, এ বই খােলা বই, এ বই আরবীতে অবতীর্ণ হল যাতে করে সর্বসাধারণের জন্য এ বই সরল দিকনির্দেশক হতে পারে।
‘সর্বসাধারণ সনাতন ধর্মের বাণী মাতৃভাষায় বুঝুক এই মাহাত্ম যে কত গাম্ভীর্যপূর্ণ এবং গুরুত্বব্যঞ্জক সেকথা আমরা এখনাে সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করতে পারিনি।
আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস পূর্বচার্যগণ এ বাণী হৃদয়াঙ্গম করতে সক্ষম হয়েছিলেন, এবং সক্ষম হয়েছিলেন বলেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, ধর্মজ্ঞান যদি মুষ্টিমেয় পণ্ডিতের বিদ্যাচর্চার বিলাসবস্তু না হয়ে আপামর জনসাধারণের নিত্য অবলম্বনীয় সখারূপে প্রকাশ হতে চায় তবে সে ধর্মশিক্ষা মাতৃভাষাতেই দিতে হবে। কোনাে বিদেশী ভাষা দ্বারা জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে ধর্মশিক্ষা দেওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব, মাতৃভাষার সাহায্য নিতেই হবে, তা সে মাতৃভাষা পূত-পবিত্রই হােক আর ওছা নাপাকই হােক। এ তত্ত্বটা ইরানের মনীষীরা অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই একদা ইরানে আরবীর বহুল প্রচার থাকা সত্ত্বেও তারা নাপাক’ ফার্সী ভাষাকে ধর্মশিক্ষার বাহনরূপে ব্যবহার করেছিলেন। ভারতীয় মনীষীরা ঠিক সেই কারণেই এদেশে বিদেশী ফার্সী প্রচলিত থাকা সত্ত্বেও নাপাক’ হিন্দীর সঙ্গে আরবী ফার্সী মিলিয়ে উর্দু নির্মাণ করেছিলেন।
বাংলাদেশের মৌলবী মাওলানারা সস্তায় কিস্তিমাত করতে চেয়েছিলেন বলেই দেশজ বাংলাকে ধর্মশিক্ষার বাহনরূপে স্বীকার করেন নি উর্দু দিয়ে ফঁকতালে কাজ সারিয়ে নেবার চেষ্টাতেই ছিলেন। তাই পূর্ব-পাকিস্তানকে আজ এই খেসারত দিতে হচ্ছে যে, নিজ বাসভূমে পরবাসী হওয়ার মত নিজ মাতৃভাষায় সে কোনাে কিছুরই চর্চা করতে পারে নি। যুক্তপ্রদেশ তথা পাঞ্জাবের মৌলবী মৌলানাগণ যে রকম মাতৃভাষা উর্দুর শাস্ত্রচর্চা করেছিলেন, বাঙালী আলিমগণও যদি বাঙলায় সে-রকম শারক্ষা করে রাখতেন তাহলে সেই সূত্রপাতের খেই ধরে আজ বাঙ্গালী মুসলমান নানা সাহিত্য নির্মাণ করে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারত। এবং যখন দেখি, যে বাঙ্গালী আলিমগণ বাঙলায় শাস্ত্রচর্চা না করে, বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে অজ্ঞ রাখলেন তাঁরাই বাঙ্গালী তরঙ্গকে তার ধর্মশাস্ত্রের অজ্ঞতা নিয়ে তাচ্ছিল্য অবহেলা করেন তখন বিস্ময়ে বাক্যস্ফুরণ হয় না। আপন কর্তব্যচ্যুতি ঢাকবার এই কি সরলতম পন্থা? এবং তারা এ-কথাটিও বুঝলেন না যে, বাঙ্গালী হিন্দু যে রকম সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতকে শাস্ত্রগ্রন্থ বাঙলাতে অনুবাদ ও প্রচার করার জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়, তাঁরাও বাঙলায় ইসলামি শাস্ত্রের চর্চা করলে বাঙালী মুসলমানের কাছ থেকে সেরকম শ্রদ্ধাঞ্জলি পেতেন।
আবার বলি, এখনাে সময় আছে। উর্দু বাঙলার মাঝখানে দাড়িয়ে তারা সরল বাঙলা (লিসানু সুবীন) গ্রহণ করবেন, না আবার উর্দু দিয়ে ফোকটে কাজ সারবার তালে থাকবেন?
ধর্মজগতে পােপকে একদা এই দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তার খাস-পেয়ারা লাতিন সর্বদেশের সর্বমাতৃভাষাকে পদদলিত করে –
পাকা রাস্তা বানিয়ে বসে দুঃখীর বুক জুড়ি,
ভগবানের ব্যথার’ পরে হাঁকায় সে চার-ঘুড়ী
করবে, না তিনি লুথারের প্রস্তাব মত মাতৃভাষায় শাস্ত্রচর্চা করতে দেবেন? পােপ সত্যপথ দেখতে পান নি, তিনি ভুল করেছিলেন। ফলে খ্রীষ্টজগত দ্বিখন্ডিত হয়ে গেল।
আজ যদি জোর করে পােপের ভ্রান্তাদর্শ অনুসরণ করে উর্দুওলারা পূর্ব পাকিস্তানের স্কন্ধে উর্দু চাপান তবে লুথারের মত লােক পূর্ব-পাকিস্তানে খাড়া হতে পারে। যারা অখন্ড পাকিস্তান চান তারা এই কথাটি ভেবে দেখবেন।
ভাষার ‘পাকী না-পাকী সম্বন্ধে আমার শেষ দ্বিধাটি এইবার নিবেদন করি। আমরা যে এত তর্কাতর্কি করছি, কিন্তু নিজের মনকে কি একবারও জিজ্ঞেস করছি ‘পাকিস্তান’ শব্দটির জন্ম কোথায়, সে জাতে ‘পাক’ না ‘নাপাক’? ‘পাক’ কথাটি তাে আরবী নয়, স্পষ্ট দেখতে পারছি ‘প’ (অথবা ‘পে’) অক্ষরটি আরবী নয়, ‘প অক্ষরটি ফার্সী অথাৎ প্রাচীন ইরানি, অর্থাৎ অগ্নিউপাষক কাফিরদের শব্দ, এবং এই জেন্দা-আবেস্তার শব্দটির সঙ্গে যুক্ত আছে সংস্কৃতি ‘পক্ক’ শব্দ (পাক’ শব্দটি সংস্কৃত নয়, আবেস্তা ও সংস্কৃত যমজ ভাষা) এবং ‘স্তান’-কথাটি যে সংস্কৃত স্থানের সঙ্গ সংশ্লিষ্ট সে কথাও সকলেই জানেন। দুটি শব্দই আরবী নয়, প্রাচীন ইরানি এবং প্রাচীন ইরানি বাঙলা অপেক্ষা কোনাে দিক দিয়ে পাক’ নয়। ভাষার দিক দিয়ে যদি সত্যই সম্পূর্ণ ‘পাক’ নাম দিতে হয় তবে তাে পাকিস্তানকে ‘বয়তুল মুকুন্দসের ওজনে “মুমলকতুল মুকস’ জাতীয় কোনাে নাম দিতে হয়।
তাই বলি ‘পাক’ ‘না-পাকের প্রশ্ন সুধাননা ইসলাম ঐতিহ্য পরিপন্থী। কোন মানুষকে ‘নাপাক’ বলে যেমন তাকে কলমা থেকে বঞ্চিত করা যায় না, কোনাে ভাষাকে ঠিক তেমনি ‘না-পাক’ নাম দিয়ে ইসলামি শিক্ষা-ঐতিহ্যের বাহক হওয়া থেকে বঞ্চিত করা যায় না। ‘দুবাই ইসলামি মার্গ নয়।
কেন্দ্রের সঙ্গে যােগসূত্র স্থাপন, কেন্দ্রের চাকরী, কেন্দ্রীয় পরিষদে বক্তৃতাদান ইত্যাদি বিষয়ে বাঙলা কতদূর প্রতিবন্ধক হবে না হবে সে বিষয়ে আলােচনা অন্য প্রসঙ্গে প্রবন্ধের গােড়ার দিকে করা হয়ে গিয়েছে। বাঙলাকে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা সম্বন্ধে আর যেসব ছােট-খাটো আপত্তি আছে তার অন্যতম ব্যবসা-বাণিজ্য।
উর্দুওলারা বলেন, “ইংরেজি তাড়িয়ে দিলুম, উর্দু শিখলুম না, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানের। সঙ্গে ব্যবসা করব কি করে?
এর উত্তর এতই সরল যে দেওয়াটা বােধ হয় নিষ্প্রয়ােজন। ইংলন্ডের শতকরা ৯৯ জন ফরাসী জানে না, ফান্ডের ৯৯.৯ ইংরেজি জানে না, তৎসত্ত্বেও ব্যবসা চলে। তার চেয়েও সরল উদাহরণ আছে। মারােয়াড়ীরা প্রায় একশ’ বৎসর ধরে বাংলাদেশ শুষে খাচ্ছে, আমাদের কাফনের কাপড় বিক্রি করে তারা মারােয়াড়ে তিনতলা বাড়ী বানায় কিন্তু সমস্ত মারােয়াড় দেশে বাঙলা পড়াবার জন্য একটা স্কুল নেই, কোনকালে ছিলও না। এসব তাে হল খুচরা ব্যবসায়ের কথা। প্রাদেশে, প্রদেশে, দেশে দেশে ব্যবসায়ের যােগাযােগ হয় বড়বড় কারবারীদের মধ্যস্থতায়। দামস্কে যে জার্মান ভদ্রলােক সীমেন শুকার্টের কলকা বিক্রয় করতেন তিনি তড়তড় করে আরবী বলতে পারতেন তাই বলে গােটা জার্মানীর পাঠশালা, স্কুলে তাে আর আরবী পড়া হয় না।
পূর্ব-পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের যে বড় বড় ব্যবসা হবে, সে হবে করাচীর সঙ্গে। করাচীর ভাষা সিন্ধী কারবারী মহলে চলে ইংরেজি, সিন্ধী এবং কিঞ্চিৎ গুজরাতি। ব্যবসায়ের জন্য ভাষা শিখতে হলে তাে আমাদের সিন্ধী শিখতে হয়। ব্যবসা যে করে ভাষার মাথা ব্যথা তার। শিক্ষা বিভাগ এবং দেশের দায়িত্ব এইটুক যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স বিভাগে তার জন্য সামান্যতম বন্দোবস্ত করে দেওয়া সেটুকু কেন তার চেয়ে ঢের বেশী উর্দু আমরা পূর্ব-পাকিস্তানে শেখাব। সে কথা পরে হবে।
এজাতীয় খুঁটিনাটি আরাে অনেক সমস্যা আছে কিন্তু তাহলে মূল বক্তব্যে কখনই পৌঁছানাে যাবে না।
উর্দু-বাঙলা দ্বন্দ্বের শেষ মাধান করতে হলে বিচার বিবেচনা আবশ্যক যে পূর্বপাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদর্শ কি? আশা করি একথা কেউ বলবেন না যে একমাত্র উর্দুর সেবা করার জন্যই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
পাকিস্তান তথা পূর্ব-পাকিস্তানের আদর্শ কি সে সম্বন্ধে আমার ব্যক্তিগত মত দেবার কোন অর্থ হয় না। নানাগুণী যে নানা মত দিতেছেন তার মাঝখানে একটি সত্য কথা সকলেই স্বীকার করে নিয়েছে। সে হচ্ছে এই যে, পাকিস্তানকে সর্বপ্রথম সমৃদ্ধবান রাষ্ট্র করতে হবে।
তাহলেই প্রশ্ন উঠবে যে সমৃদ্ধশালী হতে হলে যে শক্তির প্রয়ােজন সে শক্তি সুপ্তাবস্থায় আছে কোনখানে?
পাকিস্তান তথা ভারত ইউনিয়নের স্বাধীনতা যে সফল হল তার প্রধান কারণ গণআন্দোলন। যতদিন কংগ্রেস বলতে ‘ষ্টেটসমেনের ভাষায় ‘ভদ্রলােক ক্লাশ, যতদিন লীগ বলতে রামপুর ভুপাল খানবাহাদুর, খানায়েবদের বােঝাত ততদিন ইংরেজ ‘স্বরাজ’ এবং ‘পাকিস্তানের থােড়াই পরােয়া করেছে। কিন্তু যেদিন দেখা গেল যে লীগের পশ্চাতে জনসাধারণ এসে দাড়িয়েছে, অর্থাৎ লীগ আন্দোলন গণআন্দোলনের রূপ ধারণ করেছে সেদিন আর পাকিস্তানের দাবী কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারল না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জনসাধারণের শক্তি প্রয়ােগে।
জনসাধারণের সেই শক্তি সেদিন বিদ্রোহের রূপ ধারণ করেছিল। আজ সে শক্তি সুষুপ্ত, এবং সেই শক্তি যদি পাকিস্তান গঠনে নিয়ােজিত না হয় তবে পাকিস্তান কখনােই পূর্ণাবয়ব, প্রাণবন্ত রাষ্ট্ররূপে দুনিয়ার মজলিসে আসন নিতে পারবে না। মার্কসবাদের মূল সিদ্ধান্ত ঠিক কিনা সে আলােচনা এস্থলে সম্পূর্ণ অবান্তর, ইসলামের সঙ্গে যাদের সামান্যতম পরিচয় আছে, তারাই জানেন, ইসলাম কোন বিশেষ বর্ণ, জাতি বা শ্রেণীতে শ্রেষ্ঠত্বের আশির্বাদ দিয়ে অজরামর করে তুলতে সম্পূর্ণ নারাজ।
যারা ধর্মকে – তা সে ইসলামই হােক আর হিন্দু ধর্মই হােক — রাজনীতি থেকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্র চালাতে চান তাদের উদ্দেশ্যে আমার এ স্থানে দু একটি বক্তব্য আছে। ধর্ম বিশ্বাস করুন আর নাই করুন ধর্ম যে এ দুনিয়ায় এখনাে প্রচন্ড শক্তির আধার সে কথা অস্বীকার করলে আমরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিপদে অপ্রত্যাশিত সংকটের সম্মুখে উপস্থিত হব। এই যে আমরা বার বার শুনতে পাই, ইয়ােরােপ নাস্তিক, ইয়ােরােপীয় রাজনীতি ধর্মকে উপেক্ষা করে চলে সে-কথা কতদূর সত্য? ফ্রান্স জার্মানীতে এখনাে ক্রীশ্চান পাটিগুলাে কতটা শক্তি ধারণ করে সে কথা সবচেয়ে বেশী জানেন কমুনিষ্টরা। ক্রীশ্চান ডেমােক্রেট, ক্যাথলিক সেন্টার এদের অবহেলা করে কোনাে ব্যাপক রাজনৈতিক আন্দোলন চালানাে এখনাে ফ্রান্স, জার্মানী, ইতালিতে অসম্ভব। এইতাে সেদিন রাজনীতি ক্ষেত্রে এখনাে পােপের কত ক্ষমতা সেটা ধরা পড়ল ইতালির গণভােটে। পােপ এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গ যেদিন সশরীরে কম্যুনিষ্টদের বিরুদ্ধে আসরে নামলেন সেদিন কমরেড তল্লাত্তি প্রমাদ গুনলেন।.শেষ রক্ষার জন্য ধর্মহীন তল্লাত্তিকে পর্যন্ত বলতে হল, ভবিষ্যৎ ইতালিয় কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্রে ধর্মপ্রতিষ্ঠানদের সম্পত্তি, বিষয় আশয়ে কোনাে প্রকারে হস্তক্ষেপ করা হবে না; এ যাবৎ তারা যে সব সুখ-সুবিধা উপভােগ করে আসছেন তার সব কটাই তারা নিশ্চিন্ত মনে উপভােগ করতে পারবেন। কিন্তু এ শুশান চিকিৎসায়ও ফল হল না, তল্লাত্তির নির্মম পরাজয়ের কথা সকলেই জানেন, পােপ এই ভােট মারে নেবে ভালাে করেছিলেন কি মন্দ করেছিলেন সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর, আমাদের শুধু এই টুকুই দেখানাে উদ্দেশ্য যে ধর্ম এখনাে বহু শক্তি ধারণ করে।
মৃত্যুর পর বেহেশৎ বা মােক্ষদান করাই ধর্মের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। বিশেষত ইসলাম সংসারের সর্বস্ব ত্যাগ করে গুহা-গহ্বরে বসে নাসিকাগ্রে মনােনিবেশ করার ঘােরতর বিরুদ্ধ মতবাদ প্রচার করে। আল্লাতা’লা কুরান-শরীফে বারংবার বলেছেন যে এই সংসারে তিনি নানা রকম জিনিস মানুষকে দিয়েছেন তার আনন্দ বর্ধনের জন্য। তাই মুসলিম মাত্রই প্রার্থনা করে, হে আমাদের প্রভু, ইহলােকে আমাদের শুভ হােক, পরলােকে আমাদের শুভ হােক।’ -এর থেকে স্পষ্ট বােঝা যায় ইহলােকের মঙ্গল অতীব কাম্য, তাই প্রশ্ন ওঠে পার্থিব বস্তু কোন পদ্ধতিতে উপভােগ করব যাতে করে অমঙ্গল না হয় ?
তাই বিশেষ করে ইসলামই পার্থিব বস্তুর ভাগ বাটোয়ারা সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন। কুরান শরীফ বারংবার ধন বণ্টন পদ্ধতি নিয়ে আলােচনা করেন, এবং সে-বিষয়ে প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত দেন।
মহাপুরুষ মুহম্মদের (দঃ) সঙ্গে মক্কাবাসীদের দ্বন্দ্ব হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ পার্থিব বস্তুর বণ্টন পদ্ধতি নিয়ে। সাইল’ অর্থ ভিখারী নয় ‘সাইল’ বলতে আজকাল আমরা ইংরিজিতে ‘হ্যাভ নট বাক্যে যা বুঝি তাই। সাইলকে বিমুখ করাে না’ এই আদেশ মক্কার ধনপতিগণ গ্রহণ করতে কিছুতেই সম্মত হয় নি, অথচ এই নবীন পদ্ধতি দুঃস্থ, নিপড়িত বিত্তহীনদের প্রাণে নুতন আশার বাণী এনে দিয়েছিল। ফলে দেখতে পাই মহাপুরুষের প্রথম শিষ্যদের ভিতর বিত্তহীন ও দাসের সংখ্যা বেশী।
ইহকাল পরকালের মঙ্গল আদর্শ নিয়ে এই যে আন্দোলন সৃষ্ট হল তার বিজয় অভিযান পৃথিবীর ইতিহাসে আপন স্থান করে নিয়েছে কিন্তু সে ইতিহাস আলােচনা করা এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু এইটুকু দেখাতে চাই, মহাপুরুষের চতুর্দিকে যে বিরাট আন্দোলন ক্রমে ক্রমে জাগ্রত হল সে আন্দোলন গণআন্দোলন। মহাপুরুষ যে নবীন আন্দোলন সফল করে তুললেন সে এই জনগণের সাহায্যে।
আজ পাকিস্তান যে বিরাট আন্দোলনের সামনে দাড়িয়ে রয়েছে সে আন্দোলন জনগণ দিয়েই গঠিত হবে। এ আন্দোলনে থাকবে নতুন ধর্মবন্টন পদ্ধতি, নতুন ধনার্জন পস্থা, শিক্ষার প্রসার গণতান্ত্রিক নির্বাচন পন্থা, স্বাস্থ্যের উন্নতি, সংস্কৃতি বৈধগ্ধ্য নির্মাণ প্রচেষ্টা, – এক কথায় প্রাচীন শােষণ নীতি সমূলে উৎপাদন করে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার সর্বাঙ্গীন সম্পূর্ণ বিকাশ।
কিন্তু যদি জনগণ এ আন্দোলনে অংশীদার না হয় তবে সমস্ত আন্দোলন ব্যর্থ হবে। জনসাধারণ যদি আন্দোলনের উদ্দেশ্য না বুঝতে পারে, এবং না বুঝতে পেরে আপন প্রচেষ্টা নিয়ােগ করতে কুণ্ঠিত হয়, অথবা প্রয়ােজনমত স্বার্থত্যাগ করতে প্রস্তুত না হয়, কিংবা ধনপতিদের উৎকোচে বশীভূত হয়, অথবা দু’চার আনা মজুরী বৃদ্ধিতেই যদি বৃহত্তর স্বার্থকে ত্যাগ করে তবে সম্পূর্ণ আন্দোলন নিস্ফল হবে।
এবং এ স্থলে আমার কণ্ঠে যত শক্তি আছে তাই দিয়ে আমি চিৎকার করে বলতে চাই, মাতৃভাষা বাঙলার সাহায্য বিনা জনসাধারণকে এই বিরাট আন্দোলনের বিস্তৃত শাখা প্রশাখা সম্বন্ধে সচেতন এবং ওয়াকিবহাল করা যাবে না, যাবে না, যাবে না।
উর্দুওলারা বলবেন, – উচ্চশিক্ষা উর্দুর মাধ্যমিকে দেব বটে কিন্তু শিক্ষিতেরা কেতাব লিখবেন বাংলায়।
আমার বক্তব্য, — ঠিক ঐ জিনিসটেই হয় না, কখনাে হয় নি। দৃষ্টান্ত স্বরূপ দেখাই, ইংরেজ আমাদিগকে কখনাে ইংরিজি বই লিখতে বাধ্য করেনি, তবুও ভারতবর্ষ সম্বন্ধে গতি একশত বছর ধরে যত উত্তম উত্তম ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব, দর্শন সম্বন্ধে বই বেরিয়েছে তার শতকরা ৯৫ খানা ইংরিজিতে কেন ? জ্ঞানচর্চা করব এক ভাষায় আর তার ফল প্রকাশ করবাে অন্য ভাষায় এই বন্ধ্যা প্রসব কখনাে কম্মিনকালেও হয়না। মানুষ যখন আপন মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয় চিন্তা করতে শেখে তখনই সে মাতৃভাষায় লিখতে শেখে। ‘ অর্থাৎ ইংরিজি আমলে যাহা হয়েছিল তারি পুনরাবৃত্তি হবে। একদল উচ্চশিক্ষিত লােক উর্দুতে লেখাপড়া শিখবেন, বড় বড় নােকরী করবেন, বহিরাগত উর্দুভাষীদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে এক নতুন অভিজাত সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন, আর বাদবাকী আমরা চাষাভূষাে পঁচজন যে তিমিরে ছিলুম, সেই তিমিরেই থাকব।
তাই পুনরায় স্মরণ করিয়ে দি, হজরতের চতুর্দিকে যে আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল, এবং পরে যে রাষ্ট্র সংগঠন অভিযান আরম্ভ হয়েছিল তার মাধ্যমিক ছিল আপামর জনসাধারণের ভাষা-আরবী। বিদগ্ধ হিব্রুকে তখন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছিল।
উর্দুওলারা বলবেন – বাঙলা জানলেই কি সব বাঙলা বই পড়া যায়? বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি বাঙলা চালাই, এবং ফলে যদি সকল রকমের বই-ই বাঙলাতে লেখা হয় তা হলেই কি আপামর জনসাধারণ সেসব বই পড়তে পারবে? উত্তরে বলি সকলে পারবে না, কিন্তু অসংখ্য লােক পারবে।
আমি যে শিক্ষা-ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছি তাতে দেশের শতকরা নব্বই জন মাইনর, মেট্রিক পর্যন্ত পড়বে। এবং সে মাইনর, মেট্রিকের শিক্ষাদান অনেক বেশী উন্নত পর্যায়ের হবে। ইংরিজি বা উর্দুর জন্য জান পানি করবে না বলে তারা অতি উত্তম বালা শিখবে এবং ইংলণ্ড, ফ্রান্স, মিশর ইরানে যে রকম সাধারণ শিক্ষিত লােক মাতৃভাষায় লেখা দেশের শ্রেষ্ঠ পুস্তক পড়তে পারে এরাও ঠিক তেমনি দেশের উন্নততম জ্ঞান চর্চার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। দেশের তাবৎ লােকই যে উত্তম উত্তম পুস্তক পড়বে সে কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয় – কারণ সকলেই জানেন জ্ঞানতৃষ্ণা কোনাে বিশেষ শ্রেণী বা সমাজের মধ্যে নিবদ্ধ নয়, এমনকি উচ্চশিক্ষা পাওয়া না পাওয়ার উপরও সে জিনিস সম্পূর্ণ নির্ভর করে না, কত বি, এ, এম, এ, পরীক্ষা পাসের পর চেক বই ছাড়া অন্য কোন বইয়ের সন্ধানে “সময় নষ্ট করেন না, আর কত মাইনরের ছেলে গােগ্রাসে যা পায় তাই গেলে কিন্তু মাতৃভাষা দেশের শিক্ষা-দীক্ষার বাহন হলে যে কোনাে তত্ত্বানুসন্ধিৎসু অল্প চেষ্টাতেই দেশের সর্বোত্তম প্রচেষ্টার সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। এর সত্যতা প্রমাণ হয় আরেকটি তত্ত্ব থেকে ইয়ােরােপের বহু সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক আবিষ্কর্তা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন না করেও যশস্বী সৃষ্টিকার হতে সমর্থ হয়েছেন।
তাই দেখতে হবে, মাতৃভাষার যে নিঝরিণী দিয়ে বিদ্যাভ্যাস আরম্ভ, সেই নিঝরিণীই যেন বিশাল এবং বিশালতর হয়ে বিশ্ববিদ্যার অগাধ সমুদ্রে গিয়ে পৌঁছয়। মাঝখানে ইংরিজি বা উর্দর দশ হাত শুকনাে জমি থাকলে চলবে না।
বিশেষ করে উর্দুওলা মৌলবী মৌলানাদের একথাটি বােঝা উচিত। বাংলাতে ধর্ম চর্চা না করার ফলে পূর্ব-পাকিস্তানের সাধারণ মুসলিম ধর্মের কুসংস্কারে নিমজ্জিত। ডানদিক থেকে বাঁ দিকে ছাপা বই দেখলেই সে ভয়ে ভক্তিতে বিমূঢ় হয়ে যায় তা সে গুল-ই-বাকাওলির কেচ্ছাই হােক আর দেওয়ান-ই-চিরকীই হােক। রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করবার জন্য তাকে শেখাতে হবে :
১। ইসলামের ইতিহাস এবং বিশেষ করে শেখাতে হবে এই তথ্যটি যে সে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করা অসম্ভব। আব্বাসী ওম্মাই যুগের ভেতর দিয়ে মুসলিম সংস্কৃতি যে রূপ নিয়েছে যে-রূপ পূর্ব পাকিস্তানে আবার নেবেনা। অথচ ইসলামের গণতন্ত্রের খুঁটি এবং ধনবণ্টনে সমতার নােঙ্গর জোর পাকড়ে ধরে থাকতে হবে।
২। শত শত বৎসরের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করা ইয়ােরােপ যে শক্তি সঞ্চয় করেছে মিশর দামেস্ক আজ তাই শিখতে ব্যস্ত। প্রাচীন ঐতিহ্য যে রকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করে গ্রহণ করা যায় না, ইয়ােরােপীয় কর্ম ও চিন্তা পদ্ধতি ঠিক সেই রকম বিনা বিচারে গ্রহণ করা চলবে না।
………………………………………………………………..
*পাকিস্তানকে Theocratic রাষ্ট্র করার কথা উঠছে না। আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস, ধর্মের যে রাজনৈতিক ধাপ্পা, অনৈতিক শােষণ চলে তার শেষ কোনদিনই হবে না, যতদিন না দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় ধর্মালােচনায় প্রবৃত্ত হন। ভারতীয় ইউনিয়ন সম্বন্ধেও এই নীতি প্রযােজ্য।
………………………………………………………………..

৩। ইসলাম আরবের বাইরে যেখানেই গিয়েছে সেখানেই তথাকার দেশজ জ্ঞানবিজ্ঞান, শিল্পকলাকে গ্রহণ করে নূতন সভ্যতা সংস্কৃতি নির্মাণ করেছে। ইরানের সুফীতত্ত্বের যশ কোন দেশে পৌঁছয় নি? তাজমহল এই করেই নির্মিত হয়েছে, উর্দুভাষা এই পদ্ধতিতেই গড়ে উঠল, খেয়াল গান এই করেই গাওয়া হল, মােগল ছবি এই করেই পৃথিবীকে মুগ্ধ করেছে।
পূর্ব পাকিস্তানের ভারতীয় ঐতিহ্য নগণ্য নয়, অবহেলীয় নয়। পূর্ববঙ্গের বহু হিন্দু ভারতবর্ষের ইতিহাসে স্বনামধন্য হয়েছেন, তাদের বংশধরগণ যে দিন নবীন রাষ্ট্রে আপন আসন গ্রহণ করে সভ্যতা কৃষ্টি আন্দোলনে যােগ দেবেন সে দিনই উভয় সম্প্রদায়ের অর্থহীন তিক্ততার অবসান হবে। (এ-স্থলে অবান্তর হলেও বলি ঠিক তেমনি ভারতীয় ইউনিয়নের মুসলমানদের অবহেলা করেও সে রাষ্ট্র পরিপূর্ণতায় পৌঁছতে পারবে না।) একথা কিছুতেই ভুললে চলবে না যে মামুন, হারুনের সময় যখন আরবেরা জ্ঞান -গড়িমায় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান ঠিক তখনই তারা প্রচুর অর্থব্যয় করে ‘চরক’ ‘সুশ্রুত’ ‘পঞ্চতন্ত্র আরবীতে অনুবাদ করেছিল, গজনীর মাহমুদের আমলে ঐতিহাসিক অল-বীরুনী কি বিপুল পরিশ্রম করে সংস্কৃত শিখে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে প্রামাণিক গ্রন্থ লিখেছিলেন।
আরবেরা সমুত্র উত্তীর্ণ হয়ে ভারতীয় সভ্যতার অনুসন্ধানে এদেশে এল, আজ আর পূর্ব-পাকিস্তানের লােক বাঙলা ভাষার গায়ে বৈষ্ণব নামাবলী দেখে ভড়কে যাচ্ছে। কিমাশ্চর্যমতঃপরম?
কত গবেষণা, কত সৃজনীশক্তি, কত শাস্রাশাস্ত্র বর্জন গ্রহণ কত গ্রন্থ নির্মাণ, কত পুস্তিকা প্রচার, কত বড় বিরাট, সর্বব্যাপী আপামর জনসাধারণ সংযুক্ত বিরাট অভিযানের সামনে দাড়িয়ে পূর্ব-পাকিস্তান!
এর উৎসাহ অনুপ্রেরণা যােগাবে কে?
প্রধানত সাহিত্যিকগণ, এবং আমি, বিশেষ জোর দিয়ে জানাতে চাই, সে সাহিত্য সৃষ্টি মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোনাে ভাষাতে হতে পারে না। আবার ইতিহাস থেকে নজীর সংগ্রহ করি।
ফ্রান্স এবং ইংলন্ডে আঠারাে মাইলের ব্যবধান। প্রতি বৎসর হাজার হাজার ইংরেজ প্যারিসে বেড়াতে আসে। বায়রন, শেলী উত্তম ফরাসী জানতেন কিন্তু কই, আজ পর্যন্ত তাে একজন ইংরেজ ফরাসী সাহিত্যে নাম অর্জন করতে পারেন নি, আজ পর্যন্ত একজন ফরাসী ইংরিজি লিখে পাচজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন না। অথচ বাঙলা উর্দুতে যে পার্থক্য ফরাসী ইংরিজিতে পার্থক্য তার চেয়ে ঢের কম। ফ্রেডরিক দি গ্রেটের যুগে বার্লিন এবং ভিয়েনার শিক্ষিত লােক মাত্রই ফরাসী চর্চা করত (আমরা যতটা ইংরিজি করি তার চেয়ে। ঢের বেশী। কিন্তু তবুও একজন জার্মান ভাষাভাষী ফরাসী লিখে নাম করতে পারেন নি, তুর্গেনিয়েক, তলস্তয়ের আমলে রুশ অভিজাত মাত্রই ফরাসী গভর্নেসের হাতে বড় হতেন, বাল্যকাল হতে ফরাসী লিখতেন (তলস্তয়ের রুশ পুস্তকে যে পরিমাণ পাতার পর পাতা সিফ ফরাসী লেখা আছে সে রকম ইংরিজি ভর্তি বাঙলা বই আমাদের দেশে এখনাে বেরােয় নি) কিন্তু তৎসত্ত্বেও একজন রুশও ফরাসীতে স্বার্থক সৃষ্টি কার্য করতে পারেন নি।
অত দূরে যাই কেন? সাতশত বৎসর ফার্সীর সাধনা করে ভারতবর্ষের সাহিত্যিকেরা এমন একখানা বই লিখতে পারেন নি যে বই ইরানে সম্মান লাভ করেছে। যে গালিব আপন ফার্সীর দম্ভ করতেন তার ফার্সী কবিতা ইরানে অনাদৃত, অপাংক্তেয়, অথচ মাতৃভাষায় লেখা তার উর্দু কবিতা অজয় অমর হয়ে থাকবে।
আরাে কাছে আসি। মাইকেলের বহু ভাষায় সুপন্ডিত দ্বিতীয় বাঙালী এদেশে জন্মান নি। তার পূর্বে বা পরে কোন বাঙালী তার মত ইংরিজি লিখতে পারেন নি, তবু দেখি আপ্রাণ চেষ্টা করে তিনিও ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে এতটুকু আঁচড় কেটে যেতে পারেন নি। অথচ অম্পায়াসে লেখা তার ‘মেঘনাদ’ বাঙলা সাহিত্য থেকে কখনও বিলুপ্ত হবে না।
আরাে কাছে, একদম ঘরের ভেতর চলে আসি, লালন ফকীরও বলেছেন, ‘ঘরের কাছে পাইলে খবর, খুঁজতে গেলেন দিল্লী শহর। পূর্ব-পাকিস্তানের আপন ঘরের মৌলবী-মৌলানারা যে শত শত বৎসর ধরে আরবী, ফারসী এবং উর্দুর চর্চ করলেন, এ-সব সাহিত্যে তাদের অবদান কি? গালিব, হালী, ইকবালের কথা বাদ দিন, পূর্ব-পাকিস্তান থেকে একজন দুসরা দরজার উর্দু কবি দেখাতে পারলেই আমরা সন্তষ্ট হয়ে যাব।
মৌলবী-মৌলানাদের যে কাঠগড়ায় দাঁড় করালুম তার জন্য তারা যেন আমার উপর অসন্তষ্ট না হন। নও-জোয়ানরা তাদের শ্রদ্ধা করুক আর নাই করুক, আমি তাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখি। উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের হিন্দুস্থানের’) বহু মৌলবী মৌলানার সংশ্রবে এসে আমার এ বিশ্বাস আরাে বদ্ধমূল হয়েছে যে পূর্ববঙ্গের আলিম সম্প্রদায় শাস্ত্রচর্চায় তাদের চেয়ে কোনাে অংশে কম নন। যেখানে সম্পূর্ণ বিদেশী ভাষা নিয়ে কারবার যেমন মনে করুন আরবী – সেখানে পূর্ববঙ্গের আলিম অনেক স্থলেই ‘হিন্দুস্থানের আলিমকে হার মানিয়েছেন কিন্তু উর্দুতে সাহিত্য সৃষ্টি তাে সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। যে স্পর্শকাতরতার, সূক্ষ্মানুভূতি, হৃদয়াবেগ মাতৃভাষার ভেতর দিয়ে পরিস্ফুট হয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করে সেসব তাদের আছে কিন্তু উর্দু তাদের মাতৃভাষা নয় বলে তাদের সর্ব প্রচেষ্টা পঙ্গু, আড়ষ্ট ও রসবর্জিত হয়ে যে রূপ ধারণ করে তাকে সাহিত্য বলা চলে না। বিয়ের প্রীতি উপহারেই’ তার শেষ হদ।
অথচ দেখি যৎসামান্য আরবী-ফারসীর কল্যাণে কাজী নজরুল বাঙলা সাহিত্যে কি অক্ষয় খ্যাতি অর্জন করলেন। মুসলমানও যে বাঙলাতে সফল সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে সে তথ্য একা কাজী সাহেবই সপ্রমাণ করে দিয়েছেন।
তাই পুনরায় বলি, মাতৃভাষার সাহায্য ব্যতিরেকে কেউ কখনাে, কোনাে দেশে স্বার্থক সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেন নি। আজ যদি আমাদের সাহিত্য প্রচেষ্টা উর্দু স্বর্ণ মৃগের পশ্চাতে ধাবমান হয় তবে তার চরম অবসান হবে অনুর্বর মরুভূমিতে। সমস্ত উনবিংশ ও এ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য উধ্বশ্বাসে প্রগতির দিকে ছুটে চলল ; অর্থাভাবে, শিক্ষাভাবে, দুঃখের তাড়নায় বাঙালী মুসলমান সে কাফেলাকে এগিয়ে যেতে দেখল কিন্তু সঙ্গী হতে পারল না। এখনাে কি সময় হয় নি যে তার সৃজনশক্তির সদ্ব্যবহার করার সুযােগ পায় ?
অথচ দেখি, অশিক্ষিত চাষা এবং অর্ধশিক্ষিত মুন্সী-মােল্লা আপন সাহিত্য সৃষ্টি করে। গিয়েছেন। পূর্ববঙ্গের লােকসাহিত্য যখন বিশ্বজনের সম্মুখে আত্মপ্রকাশ করল তখন দেশেবিদেশে বহু রসিকজন তার যে প্রশংসা করলেন সে প্রশংসা অন্য কোনাে দেশের লােক সাহিত্যের প্রতি উচ্ছসিত হয় নি। ভাষার বাজারে বহু বৎসর ধরে এ অধম বড় বড় মহাজনদের তামাক সেজে-ফাই-ফর্মাস খেটে দিয়ে তাঁদের আড়তের সন্ধান নিয়েছে, এবং সে হলপ খেয়ে বলতে প্রস্তুত, লােক-সাহিত্যের ফরাসী, জার্মান, ইতালি ইংরিজি আড়তের কোনটিতেই পূর্ববঙ্গ লােক-সাহিত্যের মত সরেস মাল নেই।
আমাদের ভাটিয়ালি মধুর কাছে ভলগার গান চিটেগুড়-হাসন রাজা, লালনফকির, সৈয়দ শাহ নূরের মজলিসে এসে দাড়াতে পারেন এমন একজন গুণীও ইয়ােরােপীয় লােক সাহিত্যে দেখাতে পারবে না।
অথচ কি আশ্চর্য, কি তিলিস্মাৎ, পূর্ববঙ্গের মুসলিম শিক্ষিত সম্প্রদায় কিছুই রচনা করতে পারলেন না! ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে শিক্ষিত বলতে বােঝাত উর্দুসেবীগণ, তারপরের দুঃখ-দৈন্যের ইতিহাস তাে পূর্বেই নিবেদন করেছি। কাজেই যারা শত শত বৎসর ফার্সী এবং উর্দুর সেবা করে কোনাে সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেন নি অন্ততঃ তাদের মুখে একথা শােভা পায়না যে বাঙালী মুসলমান বাঙলা সাহিত্যের সেবা করে সে ভাষাকে আপন করে নিতে পারে নি।
কিন্তু কার দোষ বেশী, আর কার দোষ কম সে কথা নিয়ে এখানে আর আলােচনা করব না। এখানে শুধু এইটুকু নিবেদন করি যে দেশের চাষী:-মাঝি ভূবনবরেণ্য লােক সঙ্গীত রচনা করতে পারল সে দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় সকল সাহিত্য রচনা করতে পারবে না সে কথা কি কখনাে বিশ্বাস করা যায়? ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে বাধাে বাধাে ঠেকে কিন্তু না বলে উপায় নেই, তাই অতি সবিনয় নিবেদন করছি, খুদাতা’লা এ-অধমের জন্য বহু দেশে রুটি রেখেছিলেন আরব মিশর, আফগানিস্তান, জার্মানী, ফুান্স প্রভৃতি নানা দেশে নানা পন্ডিত নানা সাহিত্যিকের সেবা করে এ অধমের ধ্রুব বিশ্বাস জন্মেছে পূর্ববঙ্গে সাহিত্য সৃষ্টির যে উপাদান আছে এবং পূর্ববঙ্গবাসীর হৃদয় মনে যে সামনে আছে তার বদৌলত একদিন সে অতি উচ্চাঙ্গের সাহিত্য সৃষ্টি করবে।
সােয়া চারকোটি মানুষ সাহিত্য সৃষ্টির জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। বহুশত বছর ধরে তাদের আতুর হিয়া প্রকাশের জন্য আকুলি-বিকুলি করেছে, কখনাে ফার্সীর কখনাে উর্দুর মরুপথে তাদের ফল্গুধারা উফবাষ্পে পরিণত হয়ে গিয়েছে, আজ সেসব হৃদয় শুধু মর্মবাণীরই সন্ধানে নয়, আজ নবরাষ্ট্র নির্মাণের প্রদোষে তারা ওজস্বিনী ভাষায় দেশের জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে চায়।
হাঙ্গেরির জাতীয় সঙ্গীতে আছে : দেশে দশের ডাক শােনাে ঐ ওঠো ওঠো মাডিয়ার
এই বেলা যদি পারাে তাে পারিলে নাহলে হ’ল না আর। আমরা বলি :
দেশের ভাষার ডাক শােনাে ঐ হে তরুণ বাঙলার এই বেলা যদি পারাে তাে পারিলে না হলে হ’ল না আর।
এই বিরাট সাহিত্য নির্মাণের সম্মুখে দাড়িয়ে পাকিস্তানী তরুণ যেন সাহস না হারায়। সে যেন না ভাবে যে উর্দু গ্রহণ করলে তার সব মুশকিল আসান হয়ে যেত। সাহিত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান বাবদে ইংরিজি বেশী মুশকিল আসান। উর্দুতে আছে অল্প-বিস্তর মসলা-মসাইলের কেতাব, এন্তার দোয়া-দরুদের বই। তুমি যে রাষ্ট্র নির্মাণ করতে যাচ্ছ তার মালমসলা উর্দুতে যা পেতে সে জিনিস সৃষ্টি করতে তােমার পাচ বছরও লাগবে না। ইরান দেশ যে রকম একদিন ইরানি সভ্যতা নির্মাণ করে ফিরদৌসী, রূমী, হাফিজ, সাদী, খৈয়ামের জন্ম দিয়েছিল সেইরকম তুমিও সম্মুখে আদর্শ রাখবে পূর্ব-পাকিস্তানে এক নুতন সভ্যতা গড়বার। ইরান আরবী এবং ফারসী দুই মিলিয়ে তার সাহিত্য সংস্কৃতি গড়েছিল, তুমি আরবী, বাঙলা ফরাসী সংস্কৃত, উর্দু, ইংরিজি মিলিয়ে ব্যাপকতর এবং মধুর সাহিত্য সংস্কৃতি সৃষ্টি করবে।
অন্যান্য সম্প্রদায় যেন ভয় না পান। বৌদ্ধচর্যাপদের সুতিকাগৃহে যে শিশুর জন্ম, বৈষ্ণবের নামাবলী যে শিশুর অঙ্গে বিজড়িত, আরবী-ফার্সীর রুটি গােস্ত যে শিশু বিস্তর খেয়েছে, গীতাঞ্জলি’র একেশ্বরের বন্দনা গেয়ে গেয়ে যে শিশু যৌবনে পৌছল, সে যুবক ইসলামের ইতিহাস চর্চা করলে কোনাে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। রাধাকৃষ্ণন, দাশগুপ্ত যেসব দর্শনের কেতাব ইংরিজিতে লিখেছেন তাতেও বিস্তর আরবী শব্দ আছে, তাই বলে ইংরিজি ভাষার জাতি যায় নি। ভারতচন্দ্র তার কাব্যে যে পরিমাণ আরবী ফার্সী শব্দ প্রয়ােগ করেছেন সে পরিমাণ যদি পুনরায় কাজে লাগে তাহলে আপত্তি কি? ‘আলালের ঘরে দুলাল ও তাে বাঙলা বই।
রামমােহন রায় বাঙলা ভাষায় যে চিন্তাধারা প্রবর্তন করেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে সে যুগে গোঁড়া হিন্দুরা প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন, রামকৃষ্ণকে কেন্দ্র করে বাঙলা ভাষায় যে নবচেতনার উৎপত্তি হয়েছিল তখনকার বিদগ্ধ (প্রধানত ব্রাহ্মণ) সমাজ সেটাকে গ্রহণ করতে চান নি, এবং বরীন্দ্রনাথ সনাতন ঐতিহ্যপন্থী নন বলে তাকে পর্যন্ত সুরেশ সমাজপতি, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, শরৎ চট্টোপাধ্যায়ের হাতে লাঞ্ছনা ভােগ করতে হয়েছিল। আজ এসব সংগ্রহের কথা লােকে ভূলে গিয়েছে, এবং বাঙলা সাহিত্যে এখন যদি মুসলিম সংস্কৃতির (এবং সেইটেই যে তার একমাত্র প্রচেষ্টা হবে তাও নয়) আলােচনা হয় তাহলে বিচক্ষণ লােক বিভীষিকা দেখবেন না।
আমার মত অজ্ঞ লােককে বহু হিন্দু মুসলমান যখন বাঙলাতে মুসলিম সংস্কৃতি সম্বন্ধে আলােচনা করতে অনুরােধ জানিয়ে থাকতে পারেন তখন যােগ্যজন এ কর্মে নিয়ােজিত হলে যে বহু লােক তাকে আশির্বাদ করবেন তাতে আর কি সন্দেহ? পূর্ব পাকিস্তানে তা হলে উর্দুর স্থান কোথায়?
প্রথমতঃ বলে রাখা ভালাে যে, বর্তমানে আমাদের দেশে যে শিক্ষাপদ্ধতি প্রচলিত আছে তার সঙ্গে আমাদের পরিকল্পনার শিক্ষা পদ্ধতির কোনাে তুলনাই হতে পারে না। উপস্থিত দেখতে পাই, ইস্কুলে চার বৎসর পড়েও সাধারণ ছাত্র চলনসই আরবী বা সংস্কৃতি শিখতে পারে না। কাজেই যখন বলি উর্দু অপশনাল ভাষা হিসেবে ম্যাট্রিকের শেষের চার শ্রেণীতে পড়ানাে হবে তখন উর্দুওলারা যেন না ভাবেন যে ছাত্রদের উর্দুজ্ঞান আমাদের গ্রাজুয়েটদের ফার্সী জ্ঞানেরই মত হবে। কলেজেও উর্দুর জন্য ব্যাপক বন্দোবস্ত থাকবে। একথা ভুললে চলবে না যে পাকিস্তানের কলেজে ‘ভারতীয় মুসলিম সংস্কৃতি’ নামক এক বিশেষ বিষয়বস্তু পড়ানাে হবে। মােগল স্থপতি, চিত্রকলা, সঙ্গীত যে রকম সকলেরই গর্বের বিষয় (কোনাে ইংরেজ বা মার্কিন যখন তাজমহলের প্রশংসা করে তখন কোনাে হিন্দু তাে তাজমহল মুসলমানের সৃষ্টি বলে নিজকে সে দায় থেকে মুক্ত করেন না, রবীন্দ্রনাথের নােবেল প্রাইজ পাওয়া সম্বন্ধে কথা উঠলে কোনাে বাঙালী মুসলমানকে ‘রবীন্দ্রনাথ হিন্দু বলে নতশির হতে তাে দেখিনি; অবনীন্দ্রনাথ মােগল শৈলীতে ছবি আকেন, তার শিষ্য নন্দলাল অজন্তাশৈলীতে, তাই বলে একথা কারাে মুখে শুনিনি যে নন্দলাল গুরুর চেয়ে বড় চিত্রকার) ঠিক তেমনি উর্দু ভাষা এবং সাহিত্য হিন্দু মুসলমান উভয়েরই শ্লাঘার সম্পদ। যেসব ছাত্র ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব অথবা আরবী-ফারসী সাহিত্য অধ্যয়ন করবে তাদের বাধ্য হয়ে উর্দুর প্রতি মনযােগ দিতে হবে। বেশীরভাগ রাজনৈতিক এবং কেন্দ্রীয় পরিষদে জানেওয়ালা সদস্য এইসব বিষয়ের সঙ্গে ছাত্র জীবনে সংযুক্ত থাকবেন বলে উর্দুর সঙ্গে তাদের যথেষ্ট পরিচয় হবে। যারা ভাষা ব্যাপারে অসাধারণ মেধাবী তঁারা হয়তাে করাচীতে উর্দু ভাষায় বক্তৃতা দিতে হবে এবং সেজন্য যে অসুবিধা হবে সেটা কি করে সরাতে হবে তার আলােচনা প্রবন্ধের গােড়ার দিকেই সবিস্তর করেছি।
কেন্দ্রের চাকরী সম্বন্ধে বক্তব্য, যেদিন পূর্বপশ্চিম উভয় পাকিস্তান থেকে ইংরিজি অন্তর্ধান করবে সেদিন পাঞ্জাবী মুসলমান পূর্ব-পাকিস্তানে যে প্রকার চাকরী করবে, পূর্বপাকিস্তানের লােক ঠিক সেই প্রকারেই কেন্দ্রে চাকরী করবে। এবং একথা তাে কেউ অস্বীকার করবেন না যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বদৌলতে আমরা আরবী-ফার্সীর ভেতর দিয়ে উর্দুর সঙ্গে যুক্ত আছি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর দিয়েও থাকব কিন্তু পাঞ্জাবী সিন্ধীর সে রকম বাঙলার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কোনাে ঐতিহ্য নেই। কাজেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আমরা হারব কেন? কিন্তু এ বিষয়ে অতিরিক্ত ব্যয় করার কোনাে প্রয়ােজন নেই। উর্দুওলারাই স্বীকার করে নিয়েছেন যে, সকল অবস্থাতেই বাঙালীর জন্য করাচীতে ওয়াটেজ থাকবে। অথাৎ স্বয়ং উর্দুওলারাই মেনে নিচ্ছেন যে আমরা প্রাণপণ উর্দু শিখলেও পশ্চিম পাকিস্তানী উর্দুভাষাভাষীদের সঙ্গে প্রতিযােগিতা করতে পারব না। তাদের এই মেনে নেওয়াটা খুব সম্ভব। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা প্রসূত। আমরাও বলি আমাদের আলিম-ফাজিলগণ যখন উর্দুতে যুক্ত প্রদেশের মৌলবীগণকে পরাজিত করতে পারেন নি তখন আমাদের মত ‘তিফলে মক্তব, ‘কমসীনদের’ দিয়ে কোন অঙ্গ-ই-জবান জয় সম্ভবপর ?
এ সম্পর্কে আরেকটি কথা বলে রাখা ভালাে। পরাধীন এবং অনুন্নত দেশেই চাকরী নিয়ে মাথা কাটাকাটি খুন-রেজী। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকলা, কৃষি-খনিজ, দুগ্ধ-ঘৃত উৎপাদন করে যে-দেশ সমৃদ্ধশালী সে দেশে চাকরী করে অল্প লােক, তাদের সম্মানও অনেক কম। দৃষ্টান্তস্বরূপ অঙ্গুলী নির্দেশ করি চাটগাঁয়ের দিকে। পাকিস্তান হয়েছে মাত্র এক বছর – মাঝেই শুনতে পাই চাটগায়ের কোনাে কোনাে বড় সরকারী কর্মচারী নােকরী ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা আরম্ভ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন। দেশ সমৃদ্ধশালী হলে কটা লােক বিদেশ যায়, তাও আবার চাকরীর সন্ধানেই ? দেশের ভেতরেই দেখতে পাই, যে বৎসর খেত –খামার ভালাে হয়। সে বৎসরে শহরে বাসার চাকরের জন্য হাহাকার পড়ে যায়। মুসলিম ঐতিহ্যও চাকরীর প্রশংসা করে নি, প্রশংসা করেছে ব্যবসা বাণিজ্যের। ইসলাম দেশ দেশান্তরে বিস্তৃতি লাভ করেছে ধর্ম প্রচারকদের কম তৎপরতায় এবং সদাগরদের ধর্মানুরাগে। এখনাে মধ্য আফ্রিকায় ক্রীশ্চান মিশনরিদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে হাতীর দাঁতের ব্যবসায়ী মুসলমান সদাগরেরা। ক্রীশ্চান মিশনরিরা সবাই মাইনে পায়, তারা চাকুরে। তাদের দুঃখের অন্ত নেই যে তারা সদাগরের সঙ্গে পেরে উঠছে না।
পূর্বপাকিস্তানের আদর্শ কি সে সম্বন্ধে বিচার করার সময় উর্দওলারা একটা ভয়ঙ্কর জুজুর ভয় দেখান। তারা বলে, পূর্ব-পাকিস্তান যদি উর্দু গ্রহণ না করে তবে সে পশ্চিম পাকিস্তান তথা কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং তারি সুযােগে ভারতীয় ডােমিনিয়ন পূর্বপাকিস্তানটিকে বিনা নুন লঙ্কায় কপাৎ করে গিলে ফেলবে !
ভারতীয় ইউনিয়নে এবং পাকিস্তানে লড়াই হবে কিনা, হলে কবে হবে এ আলােচনায় এত ‘যদি’ এবং ‘কিন্তু’ আছে যে সে আলােচনা যুক্তিতর্কের বিষয়বস্তু না হয়ে ফলিত জ্যোতিষের ভবিষ্যদ্বাণীর জিনিস হয়ে দাড়িয়েছে। আমরা ফলিত জ্যোতিষ জানিনে, উপস্থিত আমরা ধরে নিচ্ছি যে লড়াইটা লাগবে, কারণ সেটা ধরে না নিলে জুজুর ভয় ভাঙানাে যাবে।
অন্ধকার ঘরে বাচ্চা ছেলেকে ‘ভূত নেই’ বললে তার ভয় যায় না, বরঞ্চ ভূত মেনে নিলেও আপত্তি নেই যদি সঙ্গে সঙ্গে আলাে জ্বালানাে হয়। তাই আলাের সন্ধানই করা যাক।
কে মিত্র, কে শত্রু সে কি ভাষার উপরই নির্ভর করে? আমেরিকা, ফ্রান্স, রুশ, লড়ল জার্মান, ইতালির বিরুদ্ধে। আমেরিকা ফ্রান্স এবং রুশ তাই বলে কি একই ভাষায় কথাবার্তা কয়, না জার্মানী ইতালির ভাষাই বা এক ? আজ বলছি রুশের বিরুদ্ধে ধনতান্ত্রিক ফ্রান্সের একমাত্র ভরসা মার্কিন সাহায্য। আজ যদি উর্দুওলাদের কায়দায় ফুাম্পকে বলা হয়, তােমরা যদি ইংরিজি গ্রহণ না করে তবে তােমরা আমেরিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, এবং রুশ ফুটিকে বিনা নুন মাষ্টার্ডে কপাৎ করে গিলে ফেলবে’ তাহলেই কি ফ্রান্সের লােক মাতৃভাষা বর্জন করে মাথায় গামছা বেঁধে ইংরিজি শিখতে লেগে যাবে ?
পক্ষান্তরে একভাষা হলেই তাে হৃদ্যতা চরমে পৌঁছয় না। আমেরিকা যখন ইংরেজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াই লড়েছিল তখনাে সে ইংরিজি বলত। আইরিশমেনের মাতৃভাষা ইংরিজি, তাই বলে সে কি ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়ে নি? পশতুভাষী মুসলিম পাঠানের একদল লড়ল সুভাষচন্দ্রের ঝান্ডার নীচে দাঁড়িয়ে জাপানের হয়ে, আরেকদল লড়ল ইংরেজের ঝান্ডার নীচে দাড়িয়ে তাদের হয়ে। তার চেয়েও ভালাে উদাহরণ আছে আরব দেশে। আরবের লােক কথা বলে আরবী ভাষায়, তারা সকলেই একগােষ্ঠীর লােক (একবর্ণ), তারা সকলেই মুসলিম, অথচ আজ সে দেশ (১) ইরাক, (২) সিরিয়া, (৩) লেবানন, (৪) ফলস্তীন, (৫) ট্রাম্প জর্ডন (৬) সউদী-আরব, (৭) য়েমেনে খন্ডিত, বি খন্ডিত (এগুলাে ছাড়া আরবী ভাষা-ভাষী মিশর, টুনিস, আলজেরিয়া, মরক্কোও রয়েছে)।
এই সাত রাষ্ট্রের মধ্যে মন কষাকষির অন্ত নেই। ইবনে সউদ এবং মক্কার শরীফের মধ্যে যে লড়াই হয়েছিল সে তাে আমাদের সকলেরই স্পষ্ট মনে আছে। তার জের এখনাে চলছে আমীর আব্দুল্লা এবং ইবনে সউদের শত্রুতার মধ্যে। আজ যে ফলস্তীন অসহায় হয়ে ইহুদির হাতে মার খাচ্ছে তার প্রধান কারণ এই যে ইবনে সউদ এবং আবদুল্লার মধ্যে ঠিক ঠিক মনের মিল হচ্ছেনা। আরব লীগের সর্ব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে সকলেই জানেন যে উপযুক্ত রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে সমঝতা হয়ে গেলে দশ দিনের ভেতর ইহুদিদের রাজ্যলিষ্প ‘ফি নারি জাহান্নামে পাঠানাে সম্ভবপর হবে।
পক্ষান্তরে সুইজারল্যান্ডে তিনটি (চতুর্থটির লােকসংখ্যা অত্যন্ত কম) ভাষা, বেলজিয়ামে দুইটি, চেকোশ্লোভাকিয়ায় দুইটি, যুগােশ্লাভিয়ায় গােটা চারেক, কানাডায় দুইটি ইত্যাদি। সুইজারল্যান্ডের দৃষ্টান্ত বিশেষ করে দ্রষ্টব্য। সে দেশের প্রধান দুই অংশ জার্মান এবং ফরাসী বলে। বন্দোবস্ত থাকা সত্ত্বেও একে অন্যের ভাষা সাধারণতঃ রপ্ত করতে পারে না (ভাষা শেখা বাবদে সুইসরা বড়ই কাহিল। অথচ ফ্রান্স ও জার্মানীতে যখন লড়াই লাগে তখন ফ্রেঞ্চ সুইসরা একথা কখনাে বলে নি যে তারা ফ্রান্সের হয়ে লড়বে, জার্মান সুইসরাও অনুরূপ ভয় দেখায় নি। গত যুদ্ধে দুজনে মিলে নিরপেক্ষ ছিল, এবং হিটলার জানতেন যে সুইস-জার্মান যদিও তার জাত ভাই তবু তাদের কাছ থেকে কোন সাহায্য পাওয়া যাবে না।
তাই বলি Unity (ঐক্য) Uniformity (সমতা) এক জিনিস নয়। সমতা হলেই ঐক্য হয় না। আর যারা সমতা চায় তাদের জেদ বয়-নাক্কার অন্ত নেই। আজ তারা বলবেন ভাষার সমতা চাই, পূর্ব-পাকিস্তান উর্দ নাও ; কাল বলবে পােষাকের সমতা চাই, শেলওয়ার কুর্তা পাগড়ী পরাে; পরশু বলবে খাদ্যের সমতা চাই, মাছ-ভাত ছেড়ে গােস্ত রুটি ধরাে ; তারপর বলবে নৌকা বদখদ জিনিস, তার বদলে গরুর গাড়ী চালাও। তারপর যদি একদিন পূর্বপাকিস্তানী পাঞ্জাবীদের বলে, দৈর্ঘ্যের সমতা হলে আরাে ভালাে হয়, লড়াইয়ের জন্য য়ুনিফর্ম বানাতে তাহলে সুবিধা হবে, কিন্তু তােমরা বড্ড উচু, তােমাদের পায়ের অথবা মাথার দিকের ইঞ্চি তিনেক কেটে ফেলাে, তাহলেই হয়েছে!
ঐক্য বা য়ুনিটি অন্য জিনিস। প্রত্যেকে আপন বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে যখন সংঘবদ্ধ হয়ে মানুষ একই স্বার্থ, একই আদর্শের দিকে ধাবমান হয় তখনই তাকে বলে ঐক্য। তুলনা দিতে গিয়ে গুণীরা বলেছেন, বীণার প্রত্যেক তারের আপন আপন ধ্বনি আছে– সব তার যখন আপন আপন বিশিষ্ট ধ্বনি প্রকাশ করে একই সুরের ভিতর দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে তখনই সৃষ্ট হয় উচ্চাঙ্গের সঙ্গীত। সবকটা তারই যদি এক ধরনে বাধা হয় তবে বীণায় আর এক তারায় কোনাে তফাৎ থাকেনা। সে যন্ত্র বিদগ্ধ সঙ্গীত প্রকাশ করতে অক্ষম।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে আপন আপন বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে, কি প্রকারে এক আদর্শের রাখী বেঁধে সম্মিলিত করা যায় তার সাধনা করবেন রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ। উপস্থিত শুধু আমরা এইটুকু বলতে পারি, পূর্ব-পাকিস্তানের অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি তার ঘাড়ে উর্দু চাপানাে হয় তবে স্বভাবতই উর্দু ভাষাভাষী বহু নিষ্কর্মা শুধু ভাষার জোরে পূর্ব-পাকিস্তানকে শােষণ করার চেষ্টা করবে- এ জিনিস অত্যন্ত স্বাভাবিক, তার জন্য উর্দু ভাষাভাষীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই এবং ফলে জনসাধারণ একদিন বিদ্রোহ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। বর্ণের কৌলিন্য যেমন শােষণের কারণ হতে পারে, ভাষার কৌলিন্যও ঠিক সেই রকম শােষণপন্থা প্রশস্ততর করে দেয়। তারি একটি মর্মন্তুদ দৃষ্টান্ত নিন : তুকী একদা তাবৎ আরব খন্ডের উপর রাজত্ব করত। তুর্কীর সুলতান সর্ব আরবের খলিফাও ছিলেন বটে। তৎসত্ত্বেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সমস্ত আরব ভূখন্ড খলিফার জিহাদ ফরমান উপেক্ষা করে নসারা ইংরেজদের সঙ্গে যােগ দিয়ে তুকীকে পর্যুদস্ত করল। আমাদের কাছে এ কতবড় বিস্ময়ের কথা, খলিফার জিহাদ হুকুমের বিরুদ্ধে লড়া মানে তাে কাফির হয়ে যাওয়া। যে আরবদের ভেতর দিয়ে ইসলাম প্রথম প্রকাশ হলেন তারা ধর্মবুদ্ধি হারালাে?
তাই আমাদের সবিনয় নিবেদন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান যেন কোনাে মহত্তর আদর্শের অনুপ্রেরণায় ঐক্য সূত্রে আবদ্ধ হয়। পূর্বেই নিবেদন করেছি, গুণীরা সে আদর্শের সন্ধান করবেন। আমার জ্ঞান অভিজ্ঞতা অত্যল্প কিন্তু নানা দেশের গুণীদের মুখে শুনেছি নানা সৎগ্রন্থে পড়েছি, দীন ইসলাম বলেন, সে আদর্শ হবে রাষ্ট্রের দীন-দুঃখীর সেবা করা। উভয় পাকিস্তান যদি এই আদর্শ সামনে ধরে যে তাদের রাষ্ট্র ভিত্তি নির্মিত হবে চাষা মজুরকে অন্ন দিয়ে, দুঃস্থকে সেবা করে, অজ্ঞকে জ্ঞান দান করে, এক কথায় ‘সাইল’কে (অভাবে আতুর কে ‘গণী’ (অভাব মুক্ত) করে, তাহলে আর ভয় নেই, ভাবনা নেই। উভয় প্রান্তে গণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তারা যে ঐক্যসূত্রে সম্মিলিত হবে সে সূত্র ছিন্ন হওয়ার ভয় নেই।
সেই মহান আদর্শের দিকে উদ্দীপ্ত উদ্বুদ্ধ করতে পারে সতেজ সবল সাহিত্য। সে জাতীয় সাহিত্য মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোন ভাষাতে কেউ কখনাে নির্মাণ করতে পারে নি। জনগণের মাতৃভাষা উপেক্ষা করে গণরাষ্ট্র কখনােই নির্মিত হতে পারে না।
উপসংহারে বক্তব্য : যুদ্ধ কাম্য বস্তু নয়। অন্যের বিনাশ বাসূনা সর্বদা বর্জনীয়। পাকিস্তান বিনষ্ট হলে ভারতীয় ইউনিয়নের লাভ নেই, ভারতীয় ইউনিয়ন বিনষ্ট হলে পাকিস্তানের লাভ নেই। উভয় রাষ্ট্র সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে বিত্তবান হােক, এই আমাদের প্রধান কাম্য। ইয়ােরােপের তান্ডবলীলা থেকে আমরা কি কোনাে শিক্ষা গ্রহণ করব না? শিক্ষা গ্রহণ করি আর নাই করি, কিন্তু আক্রান্ত হওয়ার ভয় অহরহ বুকে পুষে সেই দৃষ্টিবিন্দু থেকে সর্ব সমস্যার সমাধান অনুসন্ধান করা মারাত্মক ভুল। বাড়ীতে আগুন লাগার ভয়ে অষ্টপ্রহর চালে জল ঢালা বুদ্ধিমানের কর্ম নয়।
আজ যদি আক্রান্ত হওয়ার আশায় মাতৃভাষা বর্জন করি তবে কাল প্রাণ যাওয়ার ভয়ে মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হব।
চতুরঙ্গ, শ্রাবণ ১৩৫৬ (১৯৪৮)।

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!