You dont have javascript enabled! Please enable it!

আরবী হরফে বাংলা ভাষা

আমরা জানিতে পারিলাম যে, সম্প্রতি পেশােয়ারে পাকিস্তানের শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের এক সম্মেলনে আরবী হরফে বাংলা ভাষা লিখিবার পদ্ধতি সম্বন্ধে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইয়াছে। এবং বাংলা সরকারকে নাকি উহা প্রবর্তনের জন্য সুপারিশ করা হইয়াছে।
আমরা আশ্চর্য্য হইলাম যে, বাংলা ভাষার পরিবর্তনের বা সংস্কার সমন্ধে সম্মেলন হইল পেশােয়ারে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবার আগে পূর্ববাংলার জনসাধারণের মতামত নেয়া দূরে থাকুক, তাদের এ বিষয়ে পূর্ণ আলােচনা করিবার সুযােগও দেওয়া হয় নাই। যে ভাষা আজ ভারত ও পাকিস্তানের যে কোন ভাষার চেয়ে সমৃদ্ধিশালী এবং যাহা পাকিস্তানের শতকরা ৬০ জন লােকের মাতৃভাষা তাহার আমূল পরিবর্তনের কোন প্রশ্ন উঠিলে তাহা পূর্ববাংলার জনসাধারণের মতামতের উপরই সম্পূর্ণ নির্ভর করে। তাহাদের পক্ষে হয়ত বলিবার আছে যে বাের্ডের সভ্যদের মধ্যে পূর্ববাংলার জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করিবার জন্য যাহারা আছেন তাহারা অবশ্যই এই আলােচনায় যােগদান করিয়াছেন এবং কেহ কেহ এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করিয়াছেন, কিন্তু আমাদের মতে বাংলা ভাষার এতবড় একটা পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে পৌছিবার পক্ষে এই সামান্য যুক্তি যথেষ্ট নহে। কেন না, আমরা মনে করি আরবী হরফে বাংলা লেখার বিরুদ্ধে যথেষ্ট এবং উপযুক্ত কারণ বিদ্যমান আছে।
ভাষার জন্মকথা গবেষণা করিলে দেখা যায় যে, মানুষের ভাষার সঙ্গে দেশের ভৌগােলিক অবস্থানের যথেষ্ট সম্বন্ধ আছে। এইরূপ অবস্থানের জন্য আবহাওয়া ও নানাবিধ নৈসর্গিক সংযােগ নানা দেশের মানুষের উচ্চারণ ক্ষমতার মধ্যে পার্থক্য হইয়া থাকে। ইহার ফলে বিভিন্ন দেশের জন্য বিভিন্ন ভাষা ও ভাষা প্রকাশের বিভিন্ন উচ্চারণ ইত্যাদির উদ্ভব হইয়াছে। বাংলাদেশের লােক বিদেশী ভাষায় যতই পাণ্ডিত হউক না কেন বিদেশী ভাষায় কথা বলিবার সময় ভাষাগত ভঙ্গি ও উচ্চারণের মধ্যে তাদের ত্রুটি থাকিয়াই যাইবে, এবং একথা সকল দেশের ও লােকের পক্ষেই বলা চলে।
এইরূপ পরিবর্তনের ফলে বাংলা ভাষা তার কৃষ্টি ও বৈশিষ্ট্য হারাইয়া ফেলিবে এবং ইহার সমৃদ্ধি দিন দিন ক্ষুন্ন হইয়া পড়িবে। পূর্ববাংলার শিক্ষা মূলে অন্ততঃ পক্ষে ৫০ বৎসর পিছাইয়া পড়িবে, শিক্ষিত লােকদের আবার বর্ণমালা আয়ত্ত করিতে হইবে, তারপর লিখন ও পঠনের অভ্যাস করতে কিছুকাল তাহাদের নষ্ট হইবে। নাম দস্তখত করিয়া যাহারা (বাংলাদেশের অধিকাংশ লােকই) শিক্ষিত বলিয়া গণ্য হইত, তাহাদেরও নিরক্ষরের পর্যায়ে পতিত হইতে হইবে।
আরবী ভাষায় বাংলা ভাষা উচ্চারণ করিবার মত কতগুলি হরফ নাই, যথা : ঘ, চ, ঝ, ট, ঠ, ড, ঢ, থ, ধ, প, ভ ইত্যাদি সংযুক্ত অক্ষরের উচ্চারণের কোন ব্যবস্থাই হয়ত সম্ভবই নয়। যদিও ঘ, ঝ, থ, ধ উচ্চারণ করিবার জন্য গাইন, জাল, তে ও দলের সঙ্গে হে যুক্ত করিয়া যুক্তাক্ষরের কাজ উর্দুর মত করা যাইতে পারে, তবুও তাতে বাঙ্গালীর মুখে বাংলাভাষার উচ্চারণ বিকৃতরূপেই প্রকাশ পাবে। আবার যদি উর্দুর টে, পে, বে, গাফ ইত্যাদি আরবী হরফের সঙ্গে যােগ করিয়া বাংলাভাষা প্রকাশের চেষ্টা করা হয় তা হলে আমরা চালাইবার ইহা একটি চাতুরী মাত্র। একথা কিন্তু খুবই সত্য যে ভাষার মধুরতা বজায় থাকে। যদি তার নিজস্ব হরফের দ্বারাই প্রকাশিত হয় এবং তার কৃষ্টি ও সমৃদ্ধি রক্ষা হয় যদি সে ভাষা উচ্চারিত হয় তার নিজ সন্তানের মুখে।
হয়ত কেহ কেহ বলেন যে, দুই পাকিস্তানের মধ্যে ভাষাগত পার্থক্য দূর করিবার একমাত্র উপায় উভয় দেশের ভাষা আরবী অক্ষরে লেখা, যাহাতে উভয় দেশের লােকই পরস্পরের ভাষা একই হরফের সাহায্যে অনায়াসেই শিক্ষা করিতে পারে। আমাদের কিন্তু মনে হয় যে একান্তই যদি এরূপ কোন সিদ্ধান্তের প্রয়ােজন হইয়া থাকে তাহা হইলে রােমান হরফ এই ভাষাগত পার্থক্য দূরীভূত করিয়া দিতে পারিবে। তাহাছাড়া আজকাল টাইপ মেশিন লিনাে টাইপ ইত্যাদিতে রােমান হরফ যত সহজে ও সুবিধামত ব্যবহার করা যায় আরবী বা বাংলা হরফে তাহা সম্ভব নয়।
সৰ্বসাধারণের পক্ষ হইতে আমরা বলি যে, বাংলা ভাষা যে রূপ আছে, দেশের সকলের সুবিধার জন্য সেইরূপই থাকুক। তবে যাহারা ভাষার উন্নতি ও পরিবর্তনে মন দিয়াছেন তাহারা যদি ক্রমশঃ ভাষার মধ্যে হইতে সংস্কৃত বা তদরূপ অমায়িক ও অবান্তর শব্দগুলি বিলােপ করিয়া তদপরিবর্তে বহুল আরবী, পারসিক ও উর্দু শব্দের প্রচলন করেন তাহা হইলে আমাদের মনে হয় যে অদূর ভবিষ্যতে দুই পাকিস্তানের এই ভাষাগত পার্থক্য অবশ্যই দূরীভূত হইবে। দ্বিতীয়তঃ আমরা যদি দুই পাকিস্তানেই, বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ও উর্দু পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য পারস্পরিক বাধ্যতামূলক ভাষা বলিয়া গণ্য করি, তাহা হইলে উভয় পাকিস্তানের ভাষাতে সংযােগ খুবই দৃঢ় হইবে সন্দেহ নাই।
মুছলিম হুদা, ঢাকা
ঢাকা প্রকাশ
১৩ মার্চ, ১৯৪৯
পৃ. ২

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!