আরবী হরফের প্রবর্তন
সম্প্রতি পেশােয়ারে পাকিস্তানের শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে। ইহা শিক্ষা সংক্রান্ত বহুবিধ ছােট-বড় সমস্যার আলােচনা হইয়া গিয়াছে এবং কতকগুলি সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হইয়াছে। একটি প্রস্তাবে উক্ত কমিটি পাকিস্তান গভর্নমেন্টকে আরবী হরফে বাংলা ভাষা লিখিবার পদ্ধতি প্রবর্তন করিতে সুপারিশ করিয়াছেন। এ সম্বন্ধে ইতিমধ্যে বেশ সমালােচনাও আরম্ভ হইয়াছে এই সিদ্ধান্ত কতটা সমিচীন হইয়াছে তাহা আমাদের আলােচ্য বিষয়।
যাহারা এই মতের বিরােধিতা করেন তাদের প্রধান যুক্তি এই যে, আরবী হরফ প্রবর্তনের ফলে বাংলা ভাষা তাহার বেশিষ্ট্য হারাইয়া ফেলিবে এবং উহা বাংলা শিক্ষার পথে এক অন্তরায় হইয়া দাড়াইবে। কিন্তু হরফের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার আভ্যন্তরীণ মূল বিষয়বস্তুর বাস্তব কোন পরিবর্তনের আশঙ্কা অহেতুক মনে হয়। ইহার ফলে বাঙ্গালীদের প্রথমে কিছু অসুবিধা হইবে তাহাতে কোন সন্দেহ নাই কিন্তু পরিণামে যে সকল সুবিধা হইবার সম্ভাবনা আছে তাহাও বিবেচনা করা প্রয়ােজন। বর্তমানে পাকিস্তান রাষ্ট্র দুই অংশে বিভক্ত পশ্চিম ও পূর্ব-পাকিস্তান এবং এই দুই অংশের মধ্যে ব্যবধান প্রায় দুই হাজার মাইল। পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা বিভিন্ন এবং বর্তমানে এক অংশ অপর অংশের ভাষা গ্রহণ করিতে পারে না এবং তাহা যুক্তিসঙ্গতও নয়। কাজেই সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা হইবে যথাক্রমে বাংলা ও উর্দু। এই দূরবর্তী দুই দেশের মধ্যে ভাষাগত পার্থক্য দূর করিবার একমাত্র উপায় উভয়ের মধ্যে একই অক্ষরের প্রবর্তন। বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাই আরবী অক্ষরে লেখা হইলে উর্দুভাষী বাংলা বই পড়িবার সুযােগ পাইবে আর বাংলাভাষী উর্দু বই পড়িতে পারিবে। এইভাবে পরিণামে বাংলা উর্দু ভাষার সমবায়ে ও সংমিশ্রণে এক নূতন ভাষা গড়িয়া উঠিবে। অক্ষর পরিচয় থাকিলে বঙ্গালী উর্দু বই পড়িতে পারিবে এবং সামান্য চেষ্টা করিলে ভাবধারাও বুঝিতে পারিবার সম্ভাবনা থাকিবে। আর বাংলা ভাষা আরবী অক্ষরে লিখিত হইলে পশ্চিম পাকিস্তানবাসীর পক্ষেও অনুরূপ সুবিধা হইবে।
হরফ পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের মনে জাগিয়া উঠে আর একটি বড় সমস্যার কথা। আমাদের দেশ শিক্ষার নিতান্তই পিছনে পড়িয়া আছে। বেশিরভাগ লােকেরই বর্ণ পরিচয় হয় নাই। এই হরফ প্রবর্তনের সঙ্গে এমন ব্যবস্থা করিতে হইবে যাহাতে দেশের কোন নরনারীই নিরক্ষর না থাকে। দেশের আসল সমস্যা হইতেছে নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও শিক্ষার প্রসার। জনসাধারণের নিরক্ষরতা দূর করিবার কোন কার্য্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ করা, তাহার দ্রুত প্রবর্তনের ব্যবস্থা করা হইলেই হরফ পরিবর্তন ব্যবস্থা সার্থক হইবে। আমরা আশা করি আমাদের জাতীয় গভর্নমেন্ট আশু শিক্ষার প্রসার ও নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করিয়া দেশের জনসাধারণের উন্নতির পথ উন্মুক্ত করিবেন।
ঢাকা প্রকাশ
ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৯
পৃ. ২
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত