You dont have javascript enabled! Please enable it! 1949.05.14 | পূর্ববাংলার শিক্ষার মাধ্যম কি হবে - সংগ্রামের নোটবুক

১৯৪৯ সালের ৭ মে ভােলার শুকদেব মদনমােহন উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বাখরগঞ্জ জিলা শিক্ষক সমিতির উনত্রিশতম অধিবেশনে পূর্ববঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খানের অভিভাষণের অংশ বিশেষ।

পূর্ববাংলার শিক্ষার মাধ্যম কি হবে, এই বিংশ শতাব্দীতে এ প্রশ্নের উত্থাপন অত্যন্ত হাস্যাস্পদ। চার শ বছর আগে বাংলার পূর্বোল্লিখিত কবি ছৈয়দ সুলতান ওফাতে রছুলে লিখেছেন। (১৪৩-১৪৬ লাইন)
বঙ্গদেসি সকলেরে কিরূপে বুজাইব।
বাখানি আরব ভাসা বুজাইতে নারি।
জারে জেই ভাসে প্রভু করিছে সীজন।
সেই ভাস তাহার য়মুল্লি সেই ধন ৷
বাস্তবিক স্বয়ং সরকারও ঘােষণা করেছেন যে এ প্রদেশের শিক্ষার মাধ্যম বাংলাই হবে।
কিন্তু তবু এখানে কথাটা উঠছে এই জন্য যে আমাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক অতি-ভক্ত আছেন যারা মনে করেন যে যেহেতু বাংলা কাফেরী ভাষা এবং যেহেতু উর্দু আমাদের ধর্ম ভাষা, সেইহেতু বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে আমাদের মাতৃভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করা উচিত। কথাটা যখন উঠেছে তখন চুপ থাকলে পাছে কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাড়ায় এই জন্য এ সম্বন্ধে দুটি কথা বলা আবশ্যক।
উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হয়েছে, এতে যথেষ্ট বেড়ে গেছে। আমরা এ গুরুত্ব স্বীকার করি। হিন্দু-মুছলমান নির্বিশেষে পূর্ব-পাকিস্তানের শিক্ষিত জনগণ উর্দুর মােটামুটি জ্ঞান অর্জন করুন এবং আমাদের বিদ্যালয়সমূহে তার জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা হােক এ আমরা চাই।
কিন্তু বাংলা ভাষাকে উৎখাত করে তারই শূন্য স্থানে উর্দুকে বসাতে চাই না। কারণ অমন অপচেষ্টা পরিণামে ব্যর্থ হতে বাধ্য এবং রাজশক্তির চাপে যদি সাময়িক ভাবেও এ অঘটন খানিকটা সম্ভব হয় তবে তা পূর্ব-পাকিস্তানের বাসিন্দাদেরকে তাদের এই স্বাধীন জীবনের নব যাত্রায় হাজার মাইল পিছিয়ে দিবে।
প্রথম কথা : বাংলা কাফেরী ভাষা নয়। যারা এ ভাষার কথা কয় তাদের বেশীর ভাগ মুসলমান, কাজেই এ ভাষাকে কাফেরদের ভাষা বলা চলে না। নিম্নের লাইনগুলি কি কাফেরী ভাষার লক্ষণ?
কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা।
দাড়ী মুখে সারি গান-লা শরীক আল্লা
***
বেদুঈন তার ছেড়ে দিয়ে ঘােড়া ছুড়ে ফেলে বল্লম
পড়ে সাশ্লাল্লাহ আলায়হে সল্লম
***
বাজিছে নাকাড়া হাকে নকীবের সূৰ্য্য
হুশিয়ার ইসলাম ডুবে তব সূৰ্য্য।
বাংলাভাষায় কোরান হাদীছের এত অনুবাদ, এত ভাষ্য, মহানবীর এত জীবনী, ইছলাম সম্পর্কিত সাধারণ আলােচনামূলক এত বই- এসব কি কাফেরী ভাষার লক্ষণ? শুধু আজ হিন্দুদের দেখাদেখি মুছলমানেরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা শুরু করেছে এমন ত নয়। বাংলাদেশের দণ্ডমুণ্ডের সর্বময় কর্তা যখন মুছলমানেরা ছিল তখন ত তারাই বাংলা ভাষাকে আদর করে জাতে তুলেছে, বাংলা ভাষায় নিজেরা বই লিখেছে, অন্যকে লিখতে উৎসাহ দিয়েছে, নিজ ধর্ম মত বাংলা ভাষায় প্রচার করেছে।
দ্বিতীয় কথা : উর্দু ভাল ভাষা, উর্দু আরবী হরফে লেখা, উর্দুতে ইছলাম সম্পর্কিত বহু বই আছে; উর্দু সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় থাকা লাভজনক। কিন্তু এসব সত্ত্বেও উর্দু মুছলমানের ধর্মভাষা নয়; মুছলমানের ধর্মভাষা আরবী।
তৃতীয় কথা : বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বিদায় দিতে যাওয়া মানে বাংলার বাসিন্দাদের সর্বনাশ ডেকে আনা। বাংলার মুছলমানদের বাংলা সাহিত্য চর্চার সঙ্গে তাদের নব জাগরণ ও উন্নতি অতি ঘনিষ্টভাবে জড়িত। একটিকে বাদ দিলে অন্যটিও সেই সাথে যাত্রা করবে।
চতুর্থ কথা : মায়ের দুধে ছেলে তাড়াতাড়ি বাড়ে, কারণ অতি সহজে সে তা হজম করে আত্মস্থ করতে পারে; তােলা দুধে অনেক সময়ই বদ হজম হয়-ছেলে রিকেটী হয়ে পড়ে।
তেমনই বাংলার ছেলে বাংলার মাধ্যমে যা শিখতে পারবে, তাতে যত সহজে তার মানসিক শক্তির বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটবে, বাইরের কোন ভাষার মাধ্যমেই তা সম্ভব নয়।
পঞ্চম কথা : পরদেশী ভাষা দিয়ে মাতৃভাষাকে স্থায়ীভাবে জয় করা দুনিয়ার ইতিহাসে কোন দেশে কোন যুগে সম্ভব হয় নাই। বিজয়ী নর্মানেরা ইংলন্ডের উপর, আরবেরা পারস্যের উপর, মুরেরা স্পেনের উপর, মােগল-পাঠনেরা ভারতের উপর তাদের নিজ ভাষা চাপিয়ে দিয়ে দেশী ভাষাকে মেরে ফেলতে পারে নাই।
হরফ সমস্যা : কিছু দিন আগে পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ড বাংলা ভাষার জন্য আরবী হরফের সুপারিশ করেছেন। তারা মনে করেন, (১) আরবী হরফে বাংলা ভাষা লিখলে বাংলা হরফ শিক্ষার বােঝা হতে মুক্তি পাওয়া যাবে, (২) আরবী হরফের মারফত পশ্চিম পাকিস্তান, আফগানিস্তান, আরব, পারস্যের সঙ্গে পূর্ব-পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা জমে উঠবে। (৩) এতে ইছলামী তমুদুনের বিকাশ ঘটবে। আমরা শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের সঙ্গে একমত হতে পারি নাই। কেন পারি নাই, তাই সংক্ষেপে বলছি।
১. আরবী হরফে বাংলা ভাষা লিখতে গেলে অনেকগুলি নতুন অক্ষর যােগ করতে হয় : যথা ঘ,থ,ট,ঠ,ড,ঢ,ছ,ঝ,এ,ঐ,ও,ওঁ ইত্যাদি। এই নতুন হরফগুলি শিক্ষার জন্য যতখানি শক্তি ক্ষয় হবে, তা ব্যয় করে বাংলা হরফ মােটামুটি লিখে দেওয়া চলে।
২, আরবী হরফে বাংলা ভাষা লিখলেই যদি আরব, পারস্য, ইরাক, মিসরের সাথে বন্ধুত্ব গজিয়ে উঠত, তবে আগের কালে আরবে পারস্যে লড়াই হত না এবং ইদানীং ইংলণ্ড, জার্মানী, ফ্রান্স ইটালীতেও যুদ্ধ হত না; কারণ এই শেষােক্ত দেশগুলির বাসিন্দারা সবাই খ্রিস্টান এবং তাদের সবারই ভাষা রােমান হরফে লিখিত হয়।
৩, হরফ দ্বারা তমুদুনের বিকাশ বা মিলন সংঘটিত হয় না; তার জন্য চাই পরস্পরের মধ্যে সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন ও আলােচনা মারফত ভাবের আদান প্রদান। আরবীতে বাংলা ভাষা লিখলেই কি বাঙ্গালীরা কাবুল, কান্দাহার, ইরাণ, আরব, মরক্কো, মিসর সব দেশের লােকের সঙ্গে কথা বলতে পারবে, তাদের সাহিত্য বুঝবে?
৪. হরফ হিসাবে বাংলা হরফই অধিকতর বিজ্ঞান সম্মত। বাংলা হরফ ধ্বনি-অনুগামী, আরবী হরফ ব্যাকরণ-অনুগামী। বাংলা হরফ দিয়ে লিখলে ব্যাকরণ-অজ্ঞদের পক্ষেও ভুল উচ্চারণের সম্ভাবনা নাই; কিন্তু ব্যাকরণ অজ্ঞদের পক্ষে আরবী উচ্চারণ শুদ্ধভাবে করা কঠিন। আবদুর রহমান-এর উচ্চারণে ভুল হওয়ার পথ নাই, কিন্তু এই কথাই আরবীতে লেখা হবে— ‘আবদ-আল-রহমান’-আর ব্যাকরণ মতে সন্ধি করে পড়তে আবদুর রহমান। বাংলা ‘আমি’ শব্দকে যদি আরবী আলিফ, মীম, ইয়া দিয়ে লিখি তবে পড়াকালে তা আমি, আমি, উনি, ইমি—যে কোন উচ্চারণে পড়া চলবে। ইরাব বসিয়ে দিলে অবশ্য শব্দটিকে ফর্মার মধ্যে ফেলা যায় কিন্তু ইরাব দেওয়া সময় ও পরিশ্রম সাপেক্ষ এবং জিনিষটাও কিছু জঞ্জালে রকমের।
৫. প্রথমে, মধ্যে ও শেষে বসার জন্য আরবী হরফ রূপ পরিবর্তন করে। প্রথম শিক্ষার্থীর পক্ষে এই রূপান্তর ভেদ বিশেষ জটিল হবে এবং এর ফলে তাদের শিক্ষা অনেকাংশে ব্যাহত হবে।
৬. এ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় যে হাজার হাজার পুঁথি পুস্তক লেখা হয়েছে কে তাদেরকে আরবী হরফে নতুন করে লিখবে?
এই সব কারণে আমাদের বিশ্বাস, এই যুগ-পরিবর্তনের পরমক্ষণে হরফ পরিবর্তনের বিশৃঙ্খলা উপস্থিত করলে তাতে পূর্ব-পাকিস্তানের তামাবদ্দুনি জীবনের অপূরণীয় ক্ষতি হবে, তার রাষ্ট্রীয় জীবনও ষােল আনা রক্ষা পাবে না।
Government of East Bengal, B-Procedings, Home, Education, National Archives, of Bangladesh Bundle-96, July, 1953, Proceedings No. 244-47.

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত