You dont have javascript enabled! Please enable it! 1949.07.03 | শিক্ষা সমস্যা | ভাষা আন্দোলন - সংগ্রামের নোটবুক

শিক্ষা সমস্যা

(রুস্তম আলী, বি. টি, সুকদেব হাই স্কুলের শিক্ষক)
বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন এক বিষম সমস্যায় পঁাড়াইয়াছে। ইংরেজ শাসনে যে শিক্ষা প্রচলিত ছিল সেই শিক্ষাকে শিক্ষিত সমাজ অনেক দোষারােপ করিতে ত্রুটি করে নাই। তাহারা বলেন, যে সময় ভারতবাসী পরাধীনতা শৃখল পড়িয়াছে ঠিক সেই সময়েই জাপান স্বাধীনতা লাভ করিয়াছে। এই সুদীর্ঘ দেড়শত বৎসরের মধ্যে ভারতবাসী শিক্ষিত হইয়া গােলাপ সাজিয়াছে, আর জাপান প্রথম শ্রেণীর স্বাধীন রাষ্ট্রের ক্ষমতা অর্জন করিয়াছে। সুতরাং ভারতের তদানীন্তন শিক্ষিত সমাজ ভারতের শিক্ষার জন্য মেকলে ও রাজা রামমােহন রায়কে দোষারােপ করিতে এটি করে নাই।
বর্তমানে পাকিস্তানের শিক্ষাও সেইরূপ বিষম অবস্থায় দাড়াইয়াছে। কাজেই ইহার Solution করা প্রত্যেক শিক্ষিত ব্যক্তির একান্ত দরকার। যদি আমাদের এটিকে এই শিক্ষা একবার ভুল পথে পরিচালিত হয়, তবে আমরা আবার শত বৎসর পিছনে পড়িয়া যাইব। কাজেই শিক্ষিত লােকগণ তাহাদের ব্যক্তিগত মত কর্তৃপক্ষের নিকট পেশ করিলে বহু সমালােচনার পর উহা নিশ্চয়ই ঠিক পথে পরিচালিত হইবার সম্ভাবনা আছে। শিক্ষিত সমাজের এখন অলস বা নিস্তব্ধ থাকা কিছুতেই যুক্তিযুক্ত নহে।
পাকিস্তানী অধিবাসীর অধিকাংশই মুসলমান, সুতরাং শিক্ষা এই অধিকাংশের মঙ্গলার্থেই হওয়া উচিত। আমাদের ধর্মভাষা আরবী, মাতৃভাষা বাংলা, রাষ্ট্রভাষা ইংরেজী বা উর্দু। কাজেই প্রত্যেক ছাত্রকেই ভাষার জ্ঞান অর্জন করিতে হইবে। সাধারণ ছেলের পক্ষে এই চারটি ভাষায় জ্ঞান অর্জন করা কিছুতেই সম্ভবপর নহে। ধৰ্ম্মভাষা বাদ দিয়া যে শিক্ষা সে শিক্ষা কিছুই নহে। বর্তমানে ইংরেজী ভাষা Rich Language বলিয়া অভিহিত, কাজেই এই ভাষাকে। বর্তমানে কিছুতেই ত্যাগ করা চলে না। মাতৃভাষায় সুপণ্ডিত না হইলে অন্যান্য ভাষাও ভালরূপে আয়ত্ব করা যায় না। যেখানে মাতৃভাষা উর্দু সেখানে উর্দু ভাষাকে মাতৃভাষা রূপে প্রয়ােগ করা যাইতে পারে। পশ্চিম পাকিস্তানের মাতৃভাষা উর্দু সুতরাং সেখানে বাংলা ভাষাকে Compulsory 2nd Language রূপে শিক্ষা দেওয়া একান্ত কর্তব্য এবং ইহা Class IX হইতে আরম্ভ করা উচিত। যে সমস্ত ছাত্রদের পূর্ব পাকিস্তানের বাহিরে যাইবার সম্ভাবনা আছে তাহাদের জন্য উর্দু ভাষা Compulsory 2nd Language হওয়া উচিত। আর যে সমস্ত ছাত্র উচ্চ শিক্ষা লাভ না করিয়া পূর্ব পাকিস্তানেই বসবাস করিবার ইচ্ছা রাখে তাহাদের মতে উর্দু পড়িয়া সময় নষ্ট করা আমার মতে কিছুতেই যুক্তিযুক্ত নহে। পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা ভাষাকে অনুরূপ দৃষ্টিতে দেখা উচিত।
আমরা বর্তমানে স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছি, কাজেই অন্যান্য স্বাধীন রাষ্ট্রের ন্যায় আমাদেরও শতকরা ৯৮ জন শিক্ষিত হইতে হইবে। কিন্তু শিক্ষার বাহন সহজ না হইলে উহা কিছুতেই সম্ভবপর হইবে না। সুতরাং মাতৃভাষাকেই শিক্ষার বাহন করা একান্ত উচিত।
Class VI পর্যন্ত ধর্ষভাষা শিক্ষা করা প্রত্যেক বালক-বালিকার একান্ত কর্তব্য class V হইতে ইংরেজী ভাষা আরম্ভ হওয়া উচিত। উর্দু বা বাংলা ভাষাকে 2nd language হিসাবে উভয় পাকিস্তানে Class IX হইতে আরম্ভ করা উচিত।
বর্তমানে আমাদের দেশে যে প্রণালীতে আরবী ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয় তাহা একান্ত ভুল পথেই পরিচালিত হইতেছে। ছাত্রগণ F.Mবা Title পাশ করিয়া সমাজের খেদমত করিতে বাধ্য হয়। কিন্তু নিজের পরিবার প্রতিপালনের উপরে সকল ক্ষেত্রে জুটিয়া উঠে না। যাহারা ভাল বক্তা তাহাদের পক্ষে সংসার চালানাে সহজ হইয়া দাড়ায়। আর যাহারা ভাল বক্তা নন, তাহারা নিজের পরিবার রক্ষা করিতে অক্ষম। কাজেই যে শিক্ষা নিজের পরিবারের ভরণপােষণের সহায়ক নহে তাহা প্রকৃত শিক্ষা বলিয়া গণ্য করা উচিত নহে।
আরবী আমাদের ধর্মভাষা, সুতরাং এই ভাষায় অভিজ্ঞ লােক না থাকিলে ভবিষ্যতে ধৰ্ম্মও শিথিল হইয়া পড়িবে। কিন্তু তাই বলিয়া তাহাদিগকে ভরণপােষণের চিন্তা হইতেও মুক্ত করিতে হইবে। আরবী শিক্ষার সঙ্গে হেকিমী, Tailoring, soop Making, Toilet preparing ও অন্যান্য Technical Subject Compulsory হিসাবে শিক্ষা দেওয়া একান্ত কর্তব্য। তাহা হইলে তাহারা যেরূপ সমাজের খেদমত করিতে পারিবেন, সেইরূপ নিজের পরিবার পালনেও সক্ষম হইবেন।
শিক্ষাই সমাজের উন্নতির মূল। কাজেই সমাজে যাহাতে সুশিক্ষা প্রচলিত হইতে পারে তদ্বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া প্রত্যেক শিক্ষিত লােকের একান্ত কর্তব্য। শিক্ষা কর্তৃপক্ষের আশুদৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করা যাইতেছে। বর্তমান শিক্ষায় যে কি ত্রুটি আছে সে সম্বন্ধে ৪ঠা বৈশাখ তারিখের “ঢাকা প্রকাশ” নামক পত্রিকায় আমার ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করিয়াছি।
ঢাকা প্রকাশ
৩ জুলাই, ১৯৪৯

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত