সরকারী শিক্ষা সংস্কার কমিটি
সম্প্রতি সরকার একটি শিক্ষা কমিটি গঠন করিয়াছেন, এজন্য সরকারকে আমাদের অশেষ ধন্যবাদ। শিক্ষা কমিটি একটি বরাবরের জন্য থাকিলেই ভাল হয়। কেননা আজ এ কমিটি, কাল অন্য কমিটি করিয়া সময়ই নষ্ট করা হয়, কোন সত্যিকারের কাজ হয় না। গত দুই বৎসর আমরা দেখিয়াছি কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা বিভাগের কমিটির হিরিক। তার ফলাফল আমরা বাইরে বাস্তব কাজে কিছুটা দেখিতে পাইতেছি না। শুনিতেছি যে, তাহারা ২/১ খান রিপাের্ট ইংরেজীতে বাহির করিয়াছেন, কমিটি গঠন করার সার্থকতা যদি ২/১ টি ইংরেজী রিপাের্টে পৰ্য্যাবসিত হয় তবে আর আমাদের কোন কমিটির দরকার নেই একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে।
নূতন কমিটি তৈরী হবার আগে কতদিন পর্যন্ত আমাদের মাশরেকি বাংলার ডিরেক্টর বাহাদুর একজন সহকর্মীসহ বহুত প্লানিং করিয়াছেন। আশা ছিল তার কোন সক্রিয় ফলাফল আমরা দেখিতে পাইব। কিন্তু কই তেমন কিছু দেখি না। বােধ হয় কোন রিপাের্টও বাহির করা হয় নাই।
আবার অনেক শাখা-প্রশাখা সম্বলিত নুতন একটি কমিটি গঠিত হইয়াছে দেখিয়া আমরা আশংকিত। মনে হচ্ছে এ দেশের শিক্ষা-সংস্কার আর শীগগীর হইতেছে না। শিক্ষার ব্যাপারে একটি প্রাদেশিক কমিটির কি কর্তব্য সেই সম্বন্ধেই বােধ হয় সরকারের মনে একটা স্পষ্ট ধারণা যদি থাকিত তবে আর বারবার এত এ কমিটি সে কমিটি করিত না। তাহারা আগেকার কমিটিগুলির সােপারেশ অনুসারে কিছু না কিছু কাজ করিতেন। আজকাল সার্জেন্ট স্কীমের নাম প্রায় সবাই জানেন, প্রথম যখন এই রিপাের্ট বাহির হয় তখন চারিদিকে হৈ চৈ পড়িয়া গিয়াছিল। কিন্তু বাংলাদেশে (বিশেষতঃ মাশরেকী বাংলায়) এর কোন সােপারেশ কাৰ্য্যকরী হইয়াছে বলিয়া আমাদের জানা নেই। এ বিষয়ে কেউ বলিতে পারেন যে পাকিস্তানের জন্য নতুন পরিকল্পনার দরকার। কিন্তু একথা আমরা স্বীকার করিতে পারি না সার্জেন্ট রিপাের্টের ব্যাসিক স্কীম বলে যে প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিক শিক্ষা প্রথার কথা আছে তাহার প্রায় সকল পাকিস্তানের বেলায় প্রযােজ্য। অথচ সরকারের এ বিষয়ে কোন চেষ্টা বা উৎসাহ দেখা যাইতেছে না। ডেমােক্রেটিক দেশসমূহে কমিটি প্রথা অনেক সময় অত্যন্ত জরুরী এবং গুরুতর সমস্যা চাপা দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হইয়া থাকে। আমরাও একটু একটু ডেমােক্রেটিক হওয়াই কি তাদের ঐ নীতি অনুসরণ করিতেছি না?
ক্লাসে পড়ানের প্রক্রিয়া আজকাল সব উন্নত দেশে এত বদলে গিয়েছে যে আমাদের দেশে শুধু এই ব্যাপারেই যতটা সংস্কার হওয়া উচিত ও সম্ভব তার যদি কিছুমাত্রও সরকার করিতেন তবে এদেশের শিক্ষার বিস্তার লাভ হইত একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে।
ইহাতে কোন প্রানিং কমিটির দরকার নাই। আছে শুধু প্রকৃত কাৰ্য্যক্ষেত্রে এইসব পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া অবলম্বন করার পরিশ্রম ও সৎসাহস। কথার নয়, দরকার কাজের।
শিক্ষা সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রাদেশিক কমিটির কাজ কখনই খুব detailed হতে পারে। ছেলে শিক্ষার রূপ ও পদ্ধতির সঙ্গে প্রত্যেক গ্রামের বিশিষ্ট অবস্থার এত নিবিড় ও নিকট সংযােগ যে তাহার সংস্কার কোন প্রাদেশিক কমিটি দ্বারা হইতে পারে না। এমন কোন প্রাদেশিক পদ্ধতি বা নীতি যদি সব দেশ জুড়ে চাপান হয় তবে তাহাদের শিক্ষার প্রগতি ও উদ্দেশ্য ব্যহত হইবে। এজন্য দরকার স্থানীয় শিক্ষক-ও ইনসপেক্টরদের সহযােগিতা ও কর্ম তৎপরতা। তাহাদের এ বিষয়ে অবশ্য উপযুক্ত শিক্ষা ও ধারণা থাকা চাই। এ ব্যাপারে সরকারের চেষ্টা হওয়া উচিৎ কোন না কোন সত্যিকারের স্কুলে একটু আধটু সংস্কারের দিকে নজর দেওয়া। কমিটি তারা করতে চান করুন কিন্তু তাহারা যেন শুধু কথার ব্যবসায় করিয়া ক্ষান্ত না হয়েন, তাহারা, আজ পর্যন্ত ও যে কোন সংস্কার করেনি তাহাই তাদের শৈথিল্য ও অপরাগতার চরম নিদর্শন স্বরূপ মেনে নিতে হয়। তবুও পাকিস্তানের গরীব দুঃখী অশিক্ষিত লােকদের হয়ে আমরা এই কথাই বলতে চাই যে, প্রানিং ও কমিটি রিপাের্ট আমাদের যথেষ্ট হয়েছে। কিন্তু সত্যিকারের কাজ চাই।
অবশেষে আমাদের আর একটি আরজ এই যে, যেন ভবিষ্যতে তাহারা রিপাের্টগুলি বাংলা হরফে বাহির করেন। ইংরেজী বা উর্দুতে বাহির করিলে দেশবাসীর বুঝিতে একটু অসুবিধা হইতে পারে।
ঢাকা প্রকাশ
১ম, ১৯৪৯
পৃ. ২
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত