পূর্ববাংলার নাম পরিবর্তন
কনষ্টিটিউয়েন্ট এসেশেলীর সভ্য চট্টগ্রামবাসী জনাব আহমদ সাহেব পূর্ববাংলার নাম পরিবর্তনের জন্য এসেমব্রীর আগামী ২৮শে সেপ্টেম্বর তারিখের অধিবেশনে দুইটি বিল আনয়ন করিবার নােটিশ দিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন যে, পূর্ববাংলার নাম “ইষ্ট বেঙ্গল” বা “ইষ্ট পাকিস্তান না হইয়া বেঙ্গল (ইষ্ট বেঙ্গল গভর্ণমেন্ট, ইষ্ট বেঙ্গল রেলওয়ে প্রভৃতি নামের সঙ্গে একটা গােলমালের কারণ হইয়া পড়ে। তেমনি “ইষ্ট পাকিস্তান” বলিলে “ইষ্ট পাকিস্তান পুলিশ “ইষ্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট ” প্রভৃতি নামের যথেষ্ট যােগসূত্র থাকায় একটা গােলমালের সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব নয়। অতএব তাহার মতে বেঙ্গল (ইষ্ট পাকিস্তান) নামই সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত ও সাদিক্রমে গ্রহণযােগ্য।
তাহার দাবী যুক্তিপূর্ণ বটে। কারণ পাঞ্জাবের নাম পাঞ্জাব (ভারত) এবং পাঞ্জাব (পাকিস্তান যখন হইতে পারে তখন বেঙ্গল (ইষ্ট পাকিস্তান বা পাকিস্তান না হওয়ার কোন কারণ থাকিতে পারে না। যদিও পশ্চিমবাংলার নাম পরিবর্তনের জন্য ভারত গভর্ণমেন্ট আদ্যপি কোন প্রস্তাব আনয়ন করেন নাই তবুও জনাব নূর আহম্মদ সাহেবের বর্তমান প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিবার কোন কারণ নাই।
উর্দুভাষীরা কিন্তু পূর্ববাংলাকে বেঙ্গল (ইষ্ট পাকিস্তান) নামে পরিবর্তনের প্রস্তাবে অগ্নিশৰ্ম্মা হইয়া উঠিবে। আর যদি পূর্ববাংলার সভ্যদের ভােটাধিক্যে জনাব নূর আহম্মদ সাহেবের প্রস্তাব গৃহীত হয়, তাহা হইলে তাহারা শুধু অগ্নিশৰ্ম্মা হইয়াই ক্ষান্ত রহিবেন না আগ্নেয়গিরির মত গর্জিয়া উঠিয়া যতকাল এই নাম পরিবর্তন করিয়া “ইষ্ট পাকিস্তান” রাখা না হইবে, ততকাল অগ্নিবৃষ্টি করিয়া পূর্ববাংলাকে অতিষ্ট করিয়া তুলিবেন। পূর্ব-বাংলার উর্দু -ওয়ালাদের মুখপত্র সহযােগী “মর্নিং নিউজ” নিজের কথায় বেশ জোড়ালাে ভাষায় এই ভাবেই ব্যক্ত করিয়াছেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলির নাম পাঞ্জাব (পাকিস্তান), সিন্ধু নর্থ ওয়েষ্ট ফ্রন্টিয়ার, বেলুচিস্তান, প্রভৃতি পূর্বের ন্যায়ই আছে। এই সকল প্রদেশগুলি নিজ নামের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়া চলিবে। কিন্তু পূর্ববাংলা ইষ্ট পাকিস্তান বলিয়া পরিচিত হইলে ইহার স্বাতন্ত্র্য অচিরেই লােপ পাইবে, ইহা পূর্ববাংলার অধিবাসীদের মােটেই ইচ্ছা নহে। বাংলা ভাষার উপর, পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের উপর, উর্দুভাষীদের যেরূপ ঘৃণা বা অবহেলা, তাহাতে তাহার বাংলা শব্দটি একেবারে লােপ করিবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করিবে না, তাহা পূর্ববাংলার অধিবাসী মাত্রেই জানেন। অতএব সেইদিক দিয়া জনাব নূর আহম্মদ সাহেবের প্রস্তাবকে আমরা গ্রহণ করিতে প্রস্তুত। কিন্তু আমাদের ভাষাগত কৃষ্টি রক্ষা করিয়া প্রস্তাবিত নামের পরিবর্তে যদি
কেহ অন্য কোন ভাল নাম প্রস্তাব করিতে পারেন তাহা হইলে সেই নামই অধিকতর গ্রহণযােগ্য হইবে।
এই প্রসঙ্গে আমরা একটা কথা বলিয়া রাখি। হয়তাে অনেকেই জানে না যে, পাকিস্তান সৃষ্টির বহু পূর্বে বিলাতে পাকিস্তান মুভমেন্ট সােসাইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। মিঃ চৌধুরী · রহমতউল্লা ইহার একজন কর্মী, বলিতে গেলে ইনিই উহার সৃষ্টিকারক। এই সােসাইটি হইতে পাকিস্তান লাভের জন্য নানা প্রকার পুস্তকাদি পৃথিবীর সবত্র বিনামূল্যে বিতরিত হইত। পাকিস্তানের রূপ যাহারা দিয়াছেন তাহাদের মধ্যে তার নাম বিশেষ উল্লেখযােগ্য। কিন্তু দুঃভাগ্যবশতঃ কাহারও মুখে পত্রিকায় এর কথার কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। ইনি পাকিস্তানের যে ম্যাপ আকিয়া দেশে দেশে বিতরণ করিয়াছেন তাহাতে তিনি কতগুলি প্রদেশের ও তন্নিকটবর্তী সাগরের নাম পরিবর্তন করিবার প্রস্তাব করিয়াছিলেন, যথা -বাংলা ও আসামের নাম দিয়াছেন “বঙ্গ আসাম” হায়দ্রাবাদের নাম দিয়াছিলেন “ওসমানিস্তান” ইত্যাদি। অবশ্য তিনি যে প্রদেশগুলি পাকিস্তানের অন্তর্গত করিবার কল্পনা করিয়াছিলেন কাৰ্য্যত তাহা হয় নাই। আসাম পাওয়া দূরের কথা, বাংলাদেশও বিভক্ত হইয়াছে। আসামের মধ্য হইতে লাভ হইয়াছে আগেকার সিলেট জেলার কতকাংশ মাত্র। তাহার দেওয়া নাম “বঙ্গআসাম এখন যুক্তিযুক্ত নয়। তবে ইহাকে পরিবর্তন করিয়া “বঙ্গস্তান” বা এইরূপ একটা নাম রাখিলে হয়তাে সকলেরই গ্রহণযােগ্য হইতে পারে। আশা করি ভাষাগত কৃষ্টির রক্ষা ইহাতে আছে।“ বেলুচিস্তান” নাম ঠিক হইলে বঙ্গস্তান নামের স্বপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে জনসাধারণ ইহা বিচার করিয়া দেখিবেন।
ঢাকা প্রকাশ
৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৫০
পৃ. ১
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত