You dont have javascript enabled! Please enable it! 1952.03.13 | সমকালীন পত্রিকায় বাংলা প্রচলনের দাবী - সংগ্রামের নোটবুক

সমকালীন পত্রিকায় বাংলা প্রচলনের দাবী

‘নতুন কিছু কর’
নতুন কিছু করার দুর্দমনীয় বাসনা পূর্ববঙ্গ শিক্ষা দফতরকে পাইয়া বসিয়াছে। এই বিভাগের বিজ্ঞ পরিচালক ও কর্ণধাররা গত সাড়ে চার বছরে শিক্ষা সংস্কারের নামে এতসব উদ্ভট নীতি ও ব্যবস্থা প্রবর্তন করিয়াছেন, যার ফলে শিক্ষার স্বকীয় স্বাভাবিক ধারা রুদ্ধ হইবার উপক্রম হইয়াছে।
পাকিস্তানী জামানায় নতনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা-ব্যবস্থা সংস্কার করার যে জরুরী প্রয়ােজন রহিয়াছে, একথা কেহই অস্বীকার করে না। কিন্তু সেই সংস্কার কোন অর্ডিন্যান্স’ জারী করিয়া করা সম্ভব নয়। শিক্ষা-বিভাগীয় কর্তারা কোন একটা উদ্ভট ও অভিনব ব্যবস্থা উপর হইতে চাপাইয়া দিবার চেষ্টা করিলেও তা চলিবে না। যা কিছু করার তা শিক্ষাবিদ ও সুধীসমাজের পরামর্শ অনুসারেই করিতে হইবে। অন্যথায় সরকারী ‘নববিধান’ ব্যর্থ হইতে বাধ্য।
গােড়ার দিকে প্রাদেশিক শিক্ষা বিভাগ এই নীতিই গ্রহণ করিয়াছিলেন। তারা ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে জনাব মাওলানা আকরাম খাঁ সাহেবের সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষ্যা ব্যবস্থা পুনর্গঠন কমিটি নামে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করিয়া সঠিক পথেই পা বাড়াইয়াছিলেন। কমিটি প্রায় এক বৎসর যাবৎ এই জটিল বিষয়টি পুংখানুপুংখরূপে পরীক্ষা করিয়া ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে একটি রিপাের্ট সরকারের কাছে পেশ করেন। শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কীয় অন্যান্য বিষয়ের চূড়ান্ত সােপারিশও কমিটি কর্তৃক ১৯৫১ সালের জুন মাসে সরকার সমীপে প্রেরিত হয়। ইহা ছাড়া বাংলা ভাষা সংস্কার সম্পর্কেও সরকার একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়ােগ করিয়াছিলেন। সেই কমিটিও প্রায় দুই বৎসর আগে তাদের রিপাের্ট পেশ করিয়াছেন।
উপরােক্ত কমিটি দুইটি ঘঁহাদের লইয়া গঠিত হইয়াছিল, তারা পূর্ববঙ্গের সেরা শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞ বলিয়া পরিচিত। তারাই শিক্ষা-সংস্কার ও ভাষা-সংস্কার সম্পর্কে বিজ্ঞ পরামর্শ দিবার যােগ্যতম লােক বলিলেও বােধ হয় অত্যুক্তি হইবে না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সরকারী শিক্ষা বিভাগ তাদের পরামর্শগুলি গ্রহণ করা ত দূরের কথা, সেগুলােকে কোন কারণ না দর্শাইয়াই অবলীলাক্রমে নাকচ করিয়া দিয়াছেন। ভাষাকমিটি সর্বসম্মতভাবে এই সোপারিশ করিয়াছিলেন যে, অন্ততঃ কুড়ি বছরের মধ্যে বাংলা ভাষার বর্ণমালা পরিবর্তন করা চলিবে না। সেই বিজ্ঞ পরামর্শ অগ্রাহ্য করিয়া কর্তৃপক্ষ উর্দু হরফে বাংলা চালাইতেছেন। বয়স্কদের তথাকথিত শিক্ষা কেন্দ্রগুলিতে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে ও প্রাদেশিক শিক্ষা দফতরের সহযােগিতায় উর্দু হরফে বাংলা প্রবর্তনের ব্যায়বহুল এক্সপেরিমেন্ট চালানাে হইতেছে। ড, শহীদুল্লাহর মত পৃথিবী বিখ্যাত ভাষা- তত্ত্ববিদ এ ব্যাপারে বহু সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোন কিছুই কানে তুলেন নাই।
শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন কমিটি পরামর্শ দিয়াছিলেন যে, প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষা শিক্ষা দেওয়া উচিৎ হইবে না। কিন্তু শিক্ষা বিভাগ সে পরামর্শ অগ্রাহ্য করিয়া প্রথম শ্রেণী হইতে আরবী শিক্ষাদান এবং চতুর্থ শ্রেণী হইতে উর্দু অবশ্য পাঠ্যরূপে প্রবর্তনের ব্যবস্থা করিয়াছেন। অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক-বালিকারা এই অস্বাভাবিক চাপ সহ্য করিতে পারিবে কিনা, শিক্ষা বিভাগীয় দিগগজরা তা’ একটি বারও ভাবিয়া দেখেন নাই।
শিক্ষা বিভাগ সম্প্রতি আরও একটি অভিনব আদেশ জারী করিয়াছেন। তারা সােয়া তিন হাজার শব্দ-সম্বলিত একটি শব্দকোষ” প্রকাশ করিয়া এই হুকুম দিয়াছেন যে, অতঃপর
বাহিরের কোন শব্দ ব্যবহার করিতে পারিবেন না, কোনাে বিশেষ ক্ষেত্রে তাহা করিতে হইলে টেক্সটবুক কমিটির আগাম অনুমতি লইতে হইবে। এই নতুন শব্দকোষ’ কণ্ঠস্থ করিয়া বই লিখিয়া সচিত্র আকারে ছাপাইয়া মাত্র সাড়ে তিন মাসের মধ্যে তাহা কমিটির অনুমােদনের জন্য দাখিল করা সম্ভব কিনা, শিক্ষা-ডাইরেক্টরেট তা একটিবার চিন্তা করার প্রয়ােজন বােধ করেন নাই।
এই শব্দকোষ’ নামক চিজটি কে বা কাহারা তৈয়ার করিয়াছেন, তা আমরা জানি না। তবে মনে হয়, ইহা সরকারের শিক্ষা বিভাগীয় ল্যাবরেটরীতে উর্বর মস্তিষ্ক-সম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের সুদীর্ঘ গবেষণার ফলে আবিষ্কৃত হইয়াছে। তা না হইলে চিজটির আকৃতি প্রকৃতি এরূপ কিম্ভুতকিমাকার হইবে কেন? বানানে ও শব্দচয়নে এরূপ পাণ্ডিত্য আর কার কাছেই বা আশা করা যায় ?
সরকারী হুকুমনামায় বলিয়া দেওয়া হইয়াছে যে, ‘শব্দকোষের বাহিরের কোন শব্দ পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহার করা চলিবে না। অথচ ‘ইসলাম’, হযরত, ফরজ, ফজর, সুন্নত, রােজা, কায়েদ, কায়েদে আজম, আরজ, অলস, অধম, গরম, শান্তি, রুগ্ন, সাল, ছাল, সরল প্রভৃতি অতি প্রয়ােজনীয় ও নিত্য-ব্যবহৃত শব্দগুলির কোন উল্লেখ এই শব্দকোযে’ নাই। এমনকি সর্বাপেক্ষা শুতিমধুর ও বহুল ব্যবহৃত ‘শালা’-র সাক্ষাতও ইহাতে পাওয়া যায় না। এই শ্রেণীর অভিনব আবিষ্কারের পশ্চাতে গাঁজা, আফিম প্রভৃতি জিনিষের প্রভাব অল্পবিস্তর থাকা অস্বাভাবিক নয়। অথচ ঐ শব্দগুলিও বেমালুম বাদ দেওয়া হইয়াছে। শব্দকোষ (অথবা শব্দকোশ’?) প্রণেতারা ‘অমর, অমল’, ‘আভা’ প্রভৃতি মধুর নামগুলি ভুলেন নাই, কিন্তু কায়েদে আজমকে ভুলিতে পারিয়াছেন। তারা ‘কমল’কে মনে রাখিয়াছেন, (আর ‘কে’ বা কলিকা-র কথা ভুলাত সম্ভব নয়ই। কিন্তু হাতের কলম এর কথাটি তারা মনে রাখিতে পারেন নাই। শব্দকোয়ে’ রেডিও স্থান পাইল, কিন্তু রােজা’ স্থান পাইল না। হাজী আছে, হজ নাই, শ্রী পঞ্চমী আছে, রমজান নাই, আর হয়ত শনির ভয়েই ‘শনিবার’-কে একেবারে বাদ দেওয়া হইয়াছে।
সরকারী ‘শব্দকোষ’টি পরীক্ষা করিলে উহাতে এমনি আরও অনেক অতি প্রয়ােজনীয় ও বহুল ব্যবহৃত শব্দের অভাব পরিলক্ষিত হইবে। অথচ ‘ফইজত’ ‘ফক’ প্রভৃতি উদ্ভট শব্দ উহাতে স্থান পাইয়াছে। (ফইজত না হয় বােঝা গেল, কিন্তু ‘ফক’ শব্দটি কোন ভাষা হইতে সংগ্রহ করিয়া কি অর্থে ব্যবহার করা হইয়াছে, শিক্ষা বিভাগের নিকট হইতে তা জানিতে পারিলে আমরা বাধিত হইব)। এইসব ত্রুটিবিচ্যুতি সম্পর্কে আমরা বারান্তরে আরও আলােচনা করব, কারণ বিষয়টি এতই গুরুতর যে, যথাসময়ে ইহার প্রতিবিধান না-হইলে পূর্ববাংলার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাই ধ্বংস হইবে। আপাততঃ আমরা শিক্ষামন্ত্রীকে এই অনুরােধ করিতেছি, তিনি যেন তার বিভাগের এইসব সর্বনাশা ছেলেখেলা অবিলম্বে বন্ধ করেন। নতুন কিছু করার নামে জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে সমূলে ধ্বংস করিবার কোন অধিকার তার বা তার দফতরের নাই। তােগলকী জামানা হাজার বছর আগে শেষ হইয়া গিয়াছে-এটা পাকিস্তানী জামানা।
ইনসাফ, ১৩ মাৰ্চ্চ, ১৯৫২ পৃ. ২।

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত