রাষ্ট্রভাষা
মােতামেরই আলম-ই-ইসলামীর করাচী বৈঠকে নিজ হাইনেস দি আগাখানের রাষ্ট্রভাষা সম্বন্ধে সুদীর্ঘ ও চিন্তাশীল এক বক্তৃতা পাঠ করা হয়। ইহাতে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবীর পক্ষে ও উর্দুর বিপক্ষে জোড়ালাে ও সারগর্ভ যুক্তি তর্কের অবতারণা করেন। আরবী ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে ব্যবহারের জন্য তিনি মুখ্যভাবে তিনটি কারণ দর্শাইয়াছেন। যথা :
১। মুছলমানদের অধঃপতনের সময়ে যে ভাষার প্রচলন হয় উহাই উর্দু। অতএব উর্দু মুছলমানদের স্নান গৌরব সূচনা করে।
২। পাকিস্তানের স্বাভাবিক বা জাতীয় ভাষা উর্দু নহে।
৩। উর্দুভাষা রাষ্ট্রভাষা রূপে ব্যবহৃত হইলে পাকিস্তান পৃথিবীর সকল মুছলমান রাজ্য হইতে বচ্ছিন্ন হইয়া পড়িবে কিন্তু আরবী ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা রূপে ব্যবহার করিলে পাকিস্তান সমস্ত মােসলেম জগতের সঙ্গে যােগসূত্র রক্ষা করিয়া চলিতে পারিবে।
বক্তৃতার প্রারম্ভে তিনি বলিয়াছেন যে, তিনি বিশেষভাবে জানেন যে তাহার উক্ত মত প্রকাশে তিনি পাকিস্তানের কতেক নেতা শ্রেণীর লােকদের কাছে শত্রু হইয়া পড়িবেন, কিন্তু তিনি যাহা মুছলমানদের জন্য ইসলামের জন্য ভাল মনে করেন তাহা তিনি না বলিয়া নিজেকে কর্তব্য বিচ্যুতির দোষে দোষণীয় করিতে পারেন না।
তিনি বলেন আরবী ভাষায় খােদার কালাম “কোরান শরিফ” নাজেল হইয়াছে। হাদিস ও এই ভাষায় লেখা হইয়াছে, অতএব পৃথিবীর সকল মুসলমান মনে করেন, আরবী ভাষা পবিত্র ভাষা, এই ইসলামী ভাষা সমগ্র মুসলিম জাতির কাছে প্রিয়। কোন মুছলমানই এই ভাষার প্রতি অবমাননা সহ্য করিতে পারে না। অতএব পৃথিবীর প্রত্যেক মুছলমানই কম-বেশী আরবী ভাষা শিক্ষা করিয়া থাকে।
আরবী ভাষা পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা। এই ভাষা সমৃদ্ধশালী ও অসংখ্য অমূল্য গ্রন্থ সকল এই ভাষায় প্রণয়ন হইয়াছে। পশ্চিমে আফগান, ইরান, আরব, তুরস্ক, মিশর, মরক্কো সুদূর স্পেন পৰ্যন্ত পূর্বের মালয়, সিঙ্গাপুর ইন্দনেশিয়া পৰ্য্যন্ত ও দক্ষিণে আফ্রিকার অনেক দেশেই এই আরবী ভাষার পূর্ণ প্রচলন আছে। অতএব পাকিস্তানকে সমগ্র মুসলিম জগতের মধ্যে যােগাযােগ স্থাপন করিয়া দিতে পারে একমাত্র এই ভাষাই। উর্দু ভাষা মুছলমানদের অগৌরবের সময় প্রচলিত ভাষা। ইহা মােটেই সমৃদ্ধশালী নহে, যে দুই চারিজন কবির নাম এই ভাষার অনুকূলে উল্লেখ করা হয়, তাহারা প্রকৃতপক্ষে ফার্সি ভাষাই অধিকন্তু ব্যবহার করিয়াছেন তাহাদের রচনায়, দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তানের কোন প্রদেশেরই উর্দু ভাষা মাতৃভাষা নহে, ইহা সৰ্ব্ববাদী সম্মত। অতএব তিনি পাকিস্তানের নেতাগণকে অনুরােধ করিয়া বলিয়াছেন যে, আরবী ভাষাকে যেন তাহারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে ব্যবহার করেন।
হিজ হাইনেস দি আগা খান পৃথিবীর একজন মনীষি। তঁাহার এই মতামতের অনেক খানি মূল্য আছে। উর্দু লাভারের দল হয়তঃ তাহার যুক্তি তর্কের বিরুদ্ধে অনেক বাজে কথার অবতারণা করিতে চেষ্টা করিবে কিন্তু জনসাধারণের তাহার মতবাদকে ভাল করিয়া বিবেচনা করিয়া দেখা কর্তব্য। ঢাকা শহরে একদল লােক আছে যাহার উর্দু ভাষার ভিতরে দুনিয়ার সকল ভাষার সংমিশ্রণ করিয়া উহাকে চোস্ত উর্দু বলিয়া মনে করে ও উর্দু ভাষা না জানিয়াও উহাকে রাষ্ট্রভাষা করিবার জন্য মত প্রকাশ করে। এই দলের মুখপত্র হিজ হাইনেস আগাখানের বক্তৃতাকে যুক্তিহীন করিবার মহা চেষ্টা করিলেও পূর্ববাংলার জনগণ ভাল করিয়াই জানে যে আরবীর সম্পর্কে উর্দু ভাষার প্রচলন কেহই স্বীকার করিবে না, মুষ্টিমেয় ঢাকা শহরবাসীর মতামত বিরাট পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের তুলনায় নগণ্য। অতএব তাহাদের এই মতামত বিরাট জনগণ মােটেই আমল দেয় না। ইহা কি ইহারা বুঝিয়াও বােঝে না?
উর্দু ভাষাকে বাধ্যতামূলক করিয়া বর্তমানে পূর্ব-পাকিস্তানের সমস্ত বিদ্যালয়ে প্রচলন হইয়াছে, যদিও পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ ইহাকে অন্তরের সহিত স্বীকার করে নাই। আমাদের মতে সরকার বিশেষ করিয়া শিক্ষা বিভাগ একবার ভাবিয়া দেখুন যে উর্দু ভাষার পরিবর্তে আরবী ভাষাকে বাধ্যতামূলক করিলে আমাদের ধর্মীয় ও ইসলামিক কৃষ্টির সাফল্য সুনিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা। উর্দু ভাষাকে “ক্লাসিকেল” ভাষা না “সেকেণ্ড” ভাষা হিসাবে খুশী মত পড়ার সুবিধা ছাত্রগণকে দিলে ভাষা সমস্যা সমাধান হইতে পারে। যাহাদের মাতৃ ভাষা উর্দু তাহারা বাংলার পরিবর্তে উর্দু অবশ্যই নিতে পারিবে তাহাদের মেজর ভারনা কুলার।
ঢাকা প্রকাশ
১৮ ফ্রেব্রুয়ারী, ১৯৫১
পৃ. ৩
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত