You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

নভেম্বর ১৯৭১

খাইছে রে খাইছে। বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় হাজার হাজার বিছু অখন মছুয়াগাে মুখামুখি বাইড়া বাইড়ি শুরু কইরা সমানে অউগাইয়া যাইতাছে। একদিন-দুইদিন, এক হাপ্তা-দুই হাপ্তা, এক মাস-দুই মাস এমতে কইরা সাতমাস পার হইয়া লাড়াই অখন আট মাসে পা দিছে। চব্বিশ বচ্ছর ধইর্যা আটার পরাটা আর ভইস্যা ঘি খাইয়া গতরের মাইদ্দে জেল্লা বানাইয়া বিদেশী অস্ত্রপাতি লইয়া যে মছুয়া বাহিনী তৈরী হইছিল, তাগাে একটু ব্যস্ত আর পাগলা রাখনের লাইগ্যা যেসব বাঙালি বিছু গেরিলারা ময়দানে নামছিল, তারা World-এর মাইদ্দে রেকর্ড কইর‌্যা বইছে। যেখানেই মছুয়া হেইখানেই বিচ্ছু। এগাে চোরাগুপ্তা আর আকা মাইরের মুখে হানাদার সােলজারগাে ত্রাহি মধুসূদন ডাক শুরু হইছে।
চিটাগাং চালনার বন্দর আর ঢাকা টাউন থাইক্যা শুরু কইর‌্যা যশােরের মাঠ, রংপুরের পাথার, সিরাজগঞ্জ-গােপালগঞ্জের চর, সিলেট-কিশােরগঞ্জের হাওড়, শ্রীপুরমধুপুরের জঙ্গল, এমন কি পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদী হগ্গল জায়গায় যেকোনাে টাইমে এই বাঙালি বিচ্ছুরা ইচ্ছামতাে কারবার চালাইতাছে। খালি ছেল্ কুৎ কুৎ, ছেল কুকুৎ, ছেল কুৎ কুৎ, টাই-ই-ই। এরকম হা ডা-ডু-ডু-ডু খেইল চলতাছে। আর এরি মাইদ্দেই বিচ্ছুরা রেললাইন গায়েব করতাছে; লঞ্চ ইস্টিমার ডুবাইতাছে; ব্রিজ-কালভার্ট উড়াইতাছে, পাের্ট ডাবি করতাছে; দালাল মহারাজগাে মেরামত করতাছে? হাজারে হাজার রাজাকার শ্যাষ করতাছে, আর মছুয়াগাে আলগা পাইলেই আজরাইল ফেরেশতার দরবারে পাঠাইয়া দিতাছে। হানাদার সােলজারগাে Supply Line নাইক্যা। এইসব ক্যাচকা মাইরের নমুনা না পাইয়াই টিক্কা খান ফুইট্যা পড়ছে। লাড়কানার লাড়া আর মছুয়া ম্রাট সেনাপতি ইয়াহিয়া বঙ্গাল মুলুকে আহনের নাম হুনলেই বলির জোড়া পাঁঠার মতাে থ। থর কইর‌্যা কাঁপতাছে। খালি কইতাছে কেইডা কী?
এই রকম তাে কথা আছিলাে না। আমাগাে পাতলা খান গল্লির মেরূহামত মিয়া বগা সিকরেটাের মাইদ্দে শেষ সুখ টান দিয়া আক্তা ফাল পাইড়া উঠলাে, ভাইসাব। আপনার হাতের মাইদ্দে একটা খত দেখতাছি, এইডার মাইদ্দে কেয়া লিখুখিস? কইতাছি, কইতাছি। তপন ধইর্যা টান দিয়েন না, তপন ধইরা টান দিয়েন না। চিটাগাং থাইক্যা অউগা পুয়ার হাতে আঁর কাছে এই চিডি আইছে। তাই সাব আমার সালাম নিবেন। এইখানকার অবস্থা Normal. হইছে। চট্টগ্রামের পটিয়া, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাউজান সব বিচ্চুগাে নিজস্ব এলাকা। হােতইনরা প্রকাশ্যে মার্চ করতাছে, বাংলাদেশের পতাকা উড়াইতাছে। মছুয়ারা যাইবার টেরাই করলেই বেধড়ক মাইর খাইতাছে। হেইদিন তাে দিনের বেলায় New market-এর মতাে জায়গায় বিচ্ছুরা একটা স্টেট বাসের সব Passenger নামাইয়া বােমা মাইর্যা দিব্ব স্টেনগান চালাইলাে। তাজ্জবের ব্যাপার মাত্র তিন-চারশ’ গজ দূরে Head post office-এ মছুয়া থাকা
সত্ত্বেও মাইরের ডরে বাইরায় নাই। এছাড়া টেরেন উড়তাছে, জাহাজ ডুবছে। চিটাগাং-এ এইসব অখন Normal ব্যাপার। এইতাে হেইদিন লালদিঘীর পাড়ে জাতিসংঘের গাড়িগুলা যেইখানে ছিল, হেইখানে বিচ্চুগাে জোর বােমাবাজি হইছে। কুমিল্লাতে Army বােঝাই টেরেন ধ্বংস হইছে। চিটাগাং-এর মাইদ্দে যতােগুলা Electric sub station রইছে, সব গুলাতেই বােম ফাটছে। কাপ্তাই লাইনের বহুতগুলা খাম্বা নষ্ট হইছে। মদিনা ঘাটের Electric sub station বিক্ষুরা গুড়া করনের গতিকে চিটাগাং টাউন প্রায় দুই মাস আন্ধার আছিলাে। চিটাগাং Steel Mill এর গ্যাস টারবাইন। দিয়া কোনোেমতে Radio ইস্টিশন ও টাউনে আলাে Supply কইর‌্যা বেটারা ইজ্জত বাঁচাইবার চেষ্টা করছে। বিচ্ছুরা জাহাজ ডুবায় বইল্যা কোনাে জাহাজই আর Port- এ আহে না। ফ্রিগেটে কইর‌্যা আনে। বিচ্ছুরা এইসব ফ্রিগেটও ডুবাইতাছে। ব্যবসা-বাণিজ্য পরায় বন্ধ। বেচাকেনা নাই। ফ.কা. চৌধুরীর ঘেটুরা খুবই অত্যাচার করতাছিল। তাই বিচ্ছুরা মওলবী সা’বরে একটু ঘইষ্যা দিছে। হাসপাতালে ফ, কার একটা ঘেটুআখেরি দম ছাড়ছে। চিটাগাং-এ বইস্যা যেইসব ব্যডারা MNA-MPA-এ হওনের চিরকিতে নমিনেশন পেপার দাখিল করছিল, বিচ্ছুরা তাগাে লগে মশকরা করতাছে। দুইজন হবু। MNA- এর এ্যার মাইদ্দেই বিচ্চুরা রাস্তায় গুলি কইর‌্যা মারছে। এছাড়া পােলাপানরা স্টেনগান ধইর্যা Bank থনে টাকা লইয়া গেছে। এইসব টাকা লাড়াইয়ের খরচ। হেই কাম তাে অখন Easy matter-হেরা ইচ্ছামতাে খেলতাছে। সিনেমা হলে প্রায়ই বােমা ফাটতাছে- মার্কেটেও একই অবস্থা। রাইতের বেলায় খালি গুলির আওয়াজ। দলে দলে বিহারীরা জাহাজ আইলেই ভাগতাছে। সন্ধ্যার পর মছুয়ারা আর টাউনে বাইরায় না। কোনহান খনে যে গুলি আহে, ঠাওর করা মুস্কিল। শুধু মছুয়াগাে লাশ পইড়া থাকেঅস্ত্র গায়েব। দুশমনগাে অস্ত্রই নাকি গেরিলাগাে অস্ত্র । হেইদিন নেভীর গেটে মাইন ফাটছে। আওয়াজ হুইন্যাই মছুয়ারা কি দৌড়। আমাদের মিলে মেলেটারি বহাইছে। ওরা বেলুচ আর পাঠান। খুবই দইম্যা গেছে। সব সময়ই অস্ত্র নিয়া ঘােরাফিরা করে। তবে মিলের বাইরে যায় না। বলে কী ‘ইয়ে তাে’ আপকো মুলুক হ্যায়। হামতাে দো’ দিনকা মেহমান হ্যায়। হিন্দুস্থানী এজেন্ট কো সাথ লাড়াই চলতা- হামলােগ আয়া উস্কা সাথ মােকাবেলা করণে কি লিয়ে। আভি দেখতা হ্যায় ইয়ে তাে’ দুসরা চীজ হ্যায়।
চিটাগাং-এ যুদ্ধের পাঁয়তারা চলতাছে। চাইর দিকে খালি কামান। মনে হইতাছে খুব শীঘ্রি সামনা-সামনি লাড়াই লাগবাে। হেইদিন এক কাণ্ড হইছে। একটা বিদেশী জাহাজ জয় বাংলা পতাকা উড়াইয়া চিটাগাং পাের্টে আইস্যা হাজির। মছুয়ারা তাে মহারাগ- কিচ্ছু কইবারও পারে না, সইবারও পারে না। জাহাজের ক্যাপটেন ভাঙ্গাভাঙ্গা ইংরেজিতে কইলাে ‘জাহাজের নিরাপত্তার জন্যি এইরকম কারবার করা হইছে। পাকিস্তানী পতাকা দেখলেই গেরিলারা জাহাজ ডুবাইতাছে। তােমরা এইসব জাহাজের একটাও রক্ষা করতে পার নাই।’ পাের্টের ইনচার্জ কইলাে, “ঠিক আছে, জাহাজের লােকসান হইলে ক্ষতিপূরণ দিমু। তবুও দুশমনগাে ফ্ল্যাগ উড়াইতে পারবা না। এরপর খাইক্যা হগুগল জাহাজই মছুয়াগাে কাছ থনে ক্ষতি পূরণের লিখিত দলিল লইতাছে।
হেইদিন একটা গ্রিক জাহাজ এইরকম লিখিত দলিল বগলে কইর‌্যা পাের্টে জাহাজ ভিড়াইলাে। তাজ্জব ব্যাপার দলিল সই করার এক ঘণ্টার মাইদ্দে গ্রিক জাহাজটা ডুইব্যা গেল। একেবারে মেজিক কারবার। এইতাে হাল। আর কি শুনবেন? এর কি শেষ আছে? দিন রাইত খালি ফুটফাটের কারবার বাইড়াই চলতাছে। এই রকম Normal অবস্থার মাইদ্দে চিটাগাং-এ দিন কাটাইতাছি। ইতি…
হ-অ-অ-অ চিটির কাথা কইতে কইতে টাইম গেছে গা। এদিককার কারবার। হুনছেন নি? কইছিলাম না কিছু টাইমের দরকার আছিলাে। হেই টাইমের মাইদ্দে কামান। মর্টার লইয়া হাজারে হাজারে আসল বাঙালি সােলজার তৈরী হইয়া গ্যাছেগা। একদিকে বিগে চোরাগুপ্তা, আকা আর ক্যাচকা মাইর- আর একদিকে শুরু হইছে বাঙালি সােলজারগাে মুখামুখি বাইড়া-বাইড়ি। এখন থাইক্যা মচুয়ারা বুঝতে শুরু করছে মাসে কয়দিন যায়। পবিত্র ঈদুল ফেতর থাইক্যাই এই নয়া কিছিমের লাড়াই শুরু হইছে। মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মাইদ্দে মছুয়ারা দশটা ঘাটির থাইক্যা লাশ ফালাইয়া ভাগােয়াট হইছে।
রেডিও গায়েবী আওয়াজে খালি কাঁন্দাকাটির আওয়াজ পাওয়া যাইতাছে। গেছিরে, গেছি, গেছি- ঘট। জাতিসংঘে আগা শাহী, প্যারিস-বনে ফরিন সেক্রেটারি সােলতাইন্যা, খালি চিক্কুর পাড়তাছে Help Help. | খুলনার কালিগঞ্জ, সাতক্ষীরা, রাজশাহীর ইসলামপুর, রংপুরের রায়গঞ্জ ও বড়খাদা, সিলেটের জাকিগঞ্জ ও হাওড় এলাকা, যশােরের ভােমরা, নােয়াখালীর পরশুরাম-ফেনীতে আরে বাড়ি-রে বাড়ি। বাড়ির চোটে মছুয়াগাে দুইডা পেলেন ডাবিস্ হইছে। একটা ট্যাংক পাইয়া বিচ্ছুরা মহা খুশি। এইবার হেই ট্যাংক লইয়া খালি মছুয়া খুঁইজ্যা। বেড়াইতাছে। সিলেট, রংপুর, রাজশাহী, যশাের, খুলনায় বিচ্চুগাে মাইদ্দে Competition শুরু হইছে। খালি শ্লোগান হইতাছে ‘চলাে চলাে, ঢাকা চলাে। সামনে বিছু পিছনে বিচ্চু। এরা মাইর ছাড়া জানে না আর কিচ্ছ। হেইর লাইগ্যাই কইছিলাম, ‘খাইছে রে খাইছে।

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল