You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

ডিসেম্বর ১৯৭১

খাইছে রে খাইছে। আমাগাে বকশি বাজারের ছক্ক মিয়া একটা জব্বর কাথা কইছে। হেরে জিগাইলাম, আবে এই ছক্কু মিয়া, একদিন না একদিন তােমারে মরতে হইবােই। তা আমারে কইবার পারাে মরণের পর তুমি কি বেহেশতে যাইবার চাও, না দোজখে যাইবার চাও? | ছক্ক একটা ম্যাচ বাত্তির কাঠি দিয়া দাঁত খোঁচাইতে খোচাইতে কইলাে, ভাইসাব আপনার কথার জওয়াব দেওনের আগে আমার একটু কথা আছিলাে। আচ্ছা কইবার। পারেন মরনের পর লাহােরের ফিলিম ইষ্টার নূরজাহান বেগম কোন্হানে যাইবাে?
আমি কাইলাম, কীর লাইগ্যা- দোজখেই যাইবাে। ছবিহা কোন হানে যাইবাে?’ ‘মনে লয় এইডাও দোজখেই যাইবাে।
ছকু আমার দিকে Angle মাইরা জিগাইলাে, ভাইছা’ব এলায় কন দেহি আমাগাে ঢাকার ডট ডট ডট্ বেগম কোন হানে যাইবাে?”
এইডায় যেইরকম ইথিওথি কারবার করতাছে আর মহব্বতের গান গাইতাছে তাতে আন্দাজ করণ যায় যে, দোজখের মাইদ্দে বেগমের সিট অক্করে রিজার্ভ হইয়া আছে।
ছকু মিয়া আমার জবাব হেননের পর একটা বাইশ হাজার টাকা দামের হাসি দিলাে, ভাইসাব লাহােরের নূরজাহান-ছবিহা আর ঢাকার বেগম যখন দোজখে যাইবাে তখন দোজখই তাে বেহেশত হইবাে- আর বেহেশত তাে পরহেজগার মানুষে ভইর্যা যাইবাে- কেমন কিনা? তা হইলে আল্লায় দিলে আমিও দোজখে যামু। নূরজাহানছাবিহা-শাহনাজ ছাড়া আমি থাকতে পারুম না। ছক্কর কথা হুইন্যা আমি অক্করে থ’ । সেনাপতি ইয়াহিয়ার কথাবার্তার লগে অক্করে কাপে-কাপ’- কি সােন্দর মিল খাইছে।
আমাগাে মেহামত মিয়া গালার মাইদ্দে একটা খাকরানি মাইর্যা কইলাে, মনে লইতাছে মছুয়া ম্রাট ইয়াহিয়ার খুব খায়েশ হইছে হেতনে দোজখে যাইবাে। চেঙ্গিস খান-তৈমুর লঙ্গ, নাদির শাহ-হিটলার-মুসােলিনী-তােজের মতাে মালগুলা যখন মানুষের রক্তের শরবত খাইয়া দোজখে যাইয়্যা বইয়া আছে; তখন সেনাপতি ইয়াহিয়া খানও হাবিয়া দোজখে যাইবাে।
হ-অ-অ-অ আপনাগাে লগে গল্প করতাছি আর এইদিক্কার কাবার হুনছেন নি? ছালার মাইদ্দে থনে আটাত্তর বছর বয়সের বুড়া বিল্লি বাইরাইছে। আহ্হা, খুনী নুরুল আমীন সাবের কথা কইতাছি। মওলবী আইস্যা পড়ছে। আইজ ঢাকা, কাইল করাচী, পরশু লাহাের এই কারবার শুরু করছে। বেডায় করাচীতে বয়ান দিছে, ঠ্যাটা মালেকার রাজত্ব বঙ্গাল মুলুকে আনন্দের হিল্লোল চলতাছে- ঢাকা অক্করে Normal.’ ।
ই-ই-ই কি হইলাে? কি হইলাে? ঢাকা-তেজগাঁ, ডেমরা-কাজলা, পাগলানারায়ণগঞ্জ এইসব এলাকায় বিক্ষুগুলার বেশুমার কারবার শুরু হইয়া গেছে। করাচীর ডন, জঙ্গ প্রভৃতি খবরের কাগজওয়ালারা অখন চরকি বাজীর মাইদ্দে পড়ছে। নুরুল আমীন সা’বে যখন করাচীতে লেকচার দিতাছে- ‘ঢাকা অক্করে Normal,’ ঠিক এই টাইমে টেলিপ্রিন্টারের মাইদ্দে খালি খটাখট খটাখট আওয়াজ কইর‌্যা খবর আইতাছে, ঢাকায় হেই কারবার Begin হইয়া গেছে তিন হপ্তা ধইর্যা বিক্ষুরা আর দম লইতাছে – ইচ্ছামতাে বােমাবাজী চালাইতাছে।।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের রেললাইন গড়বড় হইয়া গেছে। খােদ ঢাকা টাউনে একটা দালাল ফ্যামিলি খতম- ঠ্যাটা মালেকার দোস্ত চিরকুমার খান ছবুর খানের বাড়িতে বােমা ফাটাইছে। University তে টাইম বােমা Burst করছে। তেজগাঁও-এ পাঁচ মছুয়া খতম্ হইছে। সিদ্ধিরগঞ্জের Electric Supply-এর মাইদ্দে একটা বিতিকিচ্ছি কারবার হইছে।
এঃ হেঃ! আবার পীলখানায় বিক্ষুরা আরামসে চাইরজন মছুয়ারে একটুক ঘইষ্যা দিছে। অবশ্যি অসুবিধা হয় নাইক্যা। এই ব্যাডাগুলা আজিমপুর গােরস্তানের লগে লাগা পীলখানায় খাটিয়ার মাইদ্দে হুইতাে; আর অখন একশ হাত দূরে খােদ গােরস্তানের মাইদ্দে হুইত্যা আছে। আগে ডাক দিলে ঘুম ভাঙ্গতাে। অহন আর হেই কারবার। নাইক্যা। হাজার ডাকলেও আওয়াজ দেয় না। এইসব খবর দেইখ্যা করাচীর ডন-জঙ্গ কাগজওয়ালারা এদ্দিনে বুঝতে পারছে বুড়া নুরুল আমীন কীর লাইগ্যা কইতাছে যে, ঢাকা অক্করে Normal.’ বিচ্ছুগুলার বােমাবাজী, মছুয়াগুলার মরণ, মিল-ফ্যাক্টরি ডাবিশ, রেললাইন গায়েব- এইগুলাই হইতাছে ঢাকা শহর Normal থাকনের নমুনা। ঢাকার মাইনষে কইতাছে, রাইতের বেলায় ফুটফাট আওয়াজ না হুনলে খুবই খারাপ লাগে। মনে হয় এই রকম তাে কথা আছিলাে না।
এইদিক্কার কারবার হুনছেন নি? সকাল-দুপুর-বিকাল-রাইত। রেডিও গায়েবী আওয়াজ খালি দলে দলে হারু মালগাে Elect হওনের খবর দিতাছে। সা’বে কইছে। কিসের ভাই, আহ্লাদের আর সীমা নাই। পালের গােদা সেনাপতি ইয়াহিয়া কলমের এক খোচায় ৭৮ জনের Election বাতিল করণের লগে লগে হারু মালপত্রের মাইদ্দে কি দৌড়াদৌড়ি। ক্যানভসিং-এর দরকার নাই, ভােটারগাে তােষামুদীর প্রয়ােজন নাই।। গেরামে গেরামে ঘােরণের কষ্ট নাই। খালি একটু মাল-পানি ঠ্যাটা মলেক্যারে দিয়া ছিলিপটা খুনী নুরুল আমীনরে দেখাইলেই কেল্লা ফতেহ। কি হইলাে? আপনেই তাে ঢাকা টাউনের হারু মাল? কই ছিলিপ কই? এ্যাঃ এ্যাঃ! সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, কিশােরগঞ্জ এই যে পাইছি! টাঙ্গাইলে খালি আছে একটা। আপনার টুপী, দাড়ি সবই আছে যখন তখন আপনারে টাঙ্গাইল থনে Elect হওনের ব্যবস্থা কইর‌্যা দিলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার বীরগাঁও গেরমের গােলাম কবীর-এর পােলা জামাতে ইসলামীর অধ্যাপক গােলাম আজম কী সুন্দর টাঙ্গাইল আসন থাইক্যা Elect হইলেন।
এলায় ক্যামন বুঝতাছেন? ঠ্যাটা মালেইক্যার তেলেসমাতি-মার্কা গণতন্ত্রের মামাডা? এইডারেই কয়- ‘ঘরের মাইদ্দে ঘর, চিত্তর হইয়া পড়। নিউইয়র্ক টাইমস কাগজের মাইদ্দে ইয়াহিয়া-ঠেটার এই ভােগ Elecion রে অক্করে তুলাধূনা কইর‌্যা ফেলাইছে। কিন্তুক মালেকার কাথা হইতাছে, আমাগাে মেলেটারি গণতন্ত্রে কোনােই ভেজাল নাইক্যা। আব্বাজান ইয়াহিয়া যেইরকম কইছে, আমরা হেই রকম কাম করতাছি।
আরে অই ছইরুদ্দির বাপ গাড়ি হুইত করছে। কি হইলাে? ভুট্টো আবার তার বােতলের দোস্ত ইয়াহিয়া খানের নেক নজরে পড়ছে। মছুয়া সম্রাট গাড়ার মাইদ্দে আটকা পইড়া, তু কইর‌্যা ডাকনের লগে লগে বেড়ায় খুশিতে গুলগুল্লা হইয়া ইসলামাবাদে যাইয়া হাজির হইছে। শরাবের গেলাসে গেলাসে ঠোকাঠুকি কইর‌্যা সেনাপতি ইয়াহিয়ার পয়লা অর্ডার ‘আয় মেরে লাল তুম্ কায়রাে-প্যারিস-জেনিভামে যাও। ডাইল গলাে না। ভুট্টো সা’বে হগ্গল জায়গা থনে ধাওয়া খাইয়া আস্তে কইর‌্যা ফেরত আইলাে। এইদিকে ‘হাে গিয়া ভাই-এর কারবার হয়ে গেছে। ছদর ইয়াহিয়া এলায় নিজেই ময়দানে নামছে। বেড়ায় বর্ডার থনে খবরের পর খবর পাইয়া লাহােরে আইস্যা আস্তানা গাড়ছে।
অখন বঙ্গাল মুলুকের কেইস চাঙ্গে উঠছে। মাতব্বরী মাইরা পাকিস্তানের বর্ডারে সােলজার নামাইয়াই মওলবী সা’ব বুদ্ধ বনছে। এলায় করি কি? এলায় করি কি? হামার ইডা কি চিরকিৎ হলাে রে? হামি ক্যা যুদ্ধের ভয় দেখাছুনুরে? উঃ হুঃ ইডা কি গ্যাড়াকলের মাইদ্দে পড়নু রে?’
সেনাপতি ইয়াহিয়া খান আসল কাম শুরু হওনের আগে অখন নিজের গতরের কাপড় বাসন্তী Colour কইর‌্যা পাকিস্তানের বর্ডারে ঘুইরা বেড়াইতাছে। মছুয়া সােলজারগাে Morale Strong করণের লাইগ্যা বেড়ায় একটা আখেরী চান্সিং করতাছে। আর এইদিকে লারকানার লাড়কা ভুট্টোরে পিকিং রওনা করছে। লগে লেঃ জেনারেল গুল হাছন, এয়ার পাের্সের রহিম খান, রিয়ার এডমিরাল রইস্যা আর মস্কো থাইক্যা ধাওয়া খাওইন্যা ফরিন সেক্রেটারি সুলতাইনারে পাডাইছে। কেইস কি? পিকিং, এয়ারপাের্টে লাখ লাখ লােকের Reception নাইক্যা। মাত্র দুই হাজার স্কুলের পােলাপান খাড়াইয়া আছে।
হ-অ-অ-অ। এইদিকে বঙ্গাল মুলুকে ফাটাফাটির কারবার শুরু হইয়া গেছে। এইবার কিশােরগঞ্জের পালা। হােসেনপুর, কাটিয়াদী, ইটনা, অষ্টগ্রাম, করিমগঞ্জ, বাজিতপুর- এইসব এলাকা থনে মছুয়ারা অক্করে Clear হইয়া গেছে। আরে বাড়িরে বাড়ি। গাবুর বাড়ির চোটে মছুয়াগাে লগে রাজাকার বাহিনী অক্করে Massacre বাহিনী হইয়া গেছে। কিশােরগঞ্জে হাওর কারে কয় হানাদার সােলজাররা হাড়ে হাড়ে টের পাইতাছে। রাস্তাঘাট, রেল লাইন স-অব ছেরাবেরা।
মচুয়াগাে উপর হাবিয়া দোজখ নাইম্যা আইছে। আজরাইল ফেরেশতা আইজকাইল Short-hand-এ নাম-দাম লিখতে শুরু করছে। এইদিকে সাতক্ষীরা-সুন্দরবন, গােপালগঞ্জ-পউটাখালী, ঠাকুরগাঁ-কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ-জামালপুর, কুষ্টিয়াচাপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় বিক্ষুগুলা মছুয়াগাে গরু খোজা কইরা বেড়াইতাছে। বাংকার শূন্য, ট্রেঞ্চ ধলী। স-অব ভাগােয়াটের মাইদ্দে রইছে।
জেনারেল পিয়াজী ভাগােয়াট বন্ধ করণের লাইগ্যা মছুয়া অফিসারগাে পাসপাের্ট কেনচেল কইরা দিছে। কিন্তু নিজে বাঁচলে বাপের নাম। এর মাইদ্দে রাও ফরমান আলী আর একটা টিরিক্স কইর‌্যা বইছে। বেড়ায় রেডিও গায়েবী আওয়াজরে অর্ডার দিছে। মাঝে-সাজে ভােগাছ এলান দিবা; দুশমনরা তারাবীর নামাজের টাইমে মসজিদ Attack করতাছে। ব্যাস আমূতেই রেডিও গায়েবী আওয়াজ ঘেউ ঘেউ কইরা উঠছে। কিন্তুক ফরমান আলী সা’ব কইয়া দেই, বঙ্গাল মুলুকের মসজিদের কাছ দিয়া যাওনের টাইমে একটু হিসাব কইর‌্যা যাইয়েন। বিষ্টুগুলা কিন্তু মছুয়া মারণের আগে নামাজ পইড়া কাম করে। হেইগুলা আইজ-কাইল পাগলা হইয়া উঠছে। আর হেগাে নম্বর দিন দিনই বাইড়াই চলতাছে।
হের লাইগ্যাই কইছিলাম, খাইছে রে খাইছে আমাগাে বকশি বাজারের ছকু মিয়া একটা জব্বর কাথা কইছে।

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল