You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.04 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

৪ ডিসেম্বর ১৯৭১

দম্ মাওলা, কাদের মাওলা!
ডরাইয়েন না, ডরাইয়েন না। এতেই একটা আওয়াজ করলাম, আর কি!
এতাে কইরা না কইছিলাম- চেতাইস্ না, চেতাই না- বঙ্গবন্ধুর বাঙালিগাে চেতাই না। বাংলাদেশের কেঁদো আর প্যাকের মাইদ্দে হাঁটু হান্দাইস্ না। নাহ্। আমার কাথা হুনলাে না। তহন কী চিরকী? ৭২ ঘণ্টার মাইদ্দে সব ঠাণ্ডা কইরা দিমু। কি হইলাে, ঠ্যাটা মালেক্যা-পিয়াজী-ইয়াহিয়া সা’ব? অহন হেই সব চোটপাট গেল কই? ৭২ ঘণ্টার জায়গায় ২১০ দিন পার হইছে- গেঞ্জাম্ তাে’ শ্যাষ হইল না। আইজ-কাইল তাে’ কারবার উল্টা কিছিমের দেছি। হানাদার মছুয়াগাে অবস্থা দিকা দিন তুরূহান্দ খরতনা হইয়া উঠতাছে। সাতক্ষীরা-খুলনা, যশাের-কুষ্টিয়া, রাজশাহী-চাপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর-দিনাজপুর, সিলেট-ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল-মধুপুর, কুমিল্লা-চিটাগাং, মাদারীপুরপালং আর ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ-হগল জায়গা থনে World-এর Best-পাইটিং ফোর্সরা খালি ঝাইড়া দৌড়াইতাছে। জেনারেল পিয়াজী অক্করে থঃ।
এইডা কি? এইডা কি?
মেজর শের মােহাম্মদ। তােমারে না সাতক্ষীরায় Duty দিছিলাম? তুমি ঢাকার Second capital-এ আইলা কেমূতে? তােমার মুখে এতাে বড় দাড়ি গজাইলাে কেমুতে? তােমার সােলজারগাে’ খবর কি? তােমার পরনে তপহ দেখতাছি কীর লাগইগ্যা?
ছ্যার কইতাছি, কইতাছি। পহেলা একটুক দম লইতে দেন। সাতক্ষীরা যাওনের আগে ব্রিগেডিয়ার ফকির মােহাম্মদ নে বােলা থা- পহেলা আপ, দু বাপ, উত্সকো বাদ দুনিয়া। সাতক্ষীরায় যাইয়া দেখি কি, পাকিস্তানী আর্মীর বহুত খতক অবস্থা।
ঈদের নামাজের পর থাইক্যাই বাঙালি বিক্ষুগুলা অক্করে পাগলা হইয়া উঠছে। হাজার হাজার বিছু তিন দিক থাইক্যা আইস্যা- আরে বাড়ি রে বাড়ি! সাতক্ষীরায় আমাগাে মর্টার, মেসিনগান, গ্রেনেড, বাংকার-ট্রেঞ্চ- কিছুই কুলাইলাে না। আমাগাে সােলজারগাে লাশ অক্করে পাহাড়। বেগতিক দেইখ্যা একটা মরা রাজাকারের লুঙ্গি পিনদ্যা- হেই কাম করলাম। দিলাম দৌড়। যে রাস্তা দিয়া ভাগছি- দেখি খালি মেজিক কারবার। হগ্গল জায়গায় বিক্ষুরা ওঁৎ পাইতা রইছে। এক ঝাপটু মাইর্যা হেরা কালীগঞ্জ থানা দখল কইর‌্যা লইলাে। হেরপর আরামসে নদী পার হইয়া বিক্ষুরা অহন খুলনা। টাউনের দিকে যাইতাছে।
মুক্তিবাহিনীর আরাে দুইটা দল যশাের থেকে ৭ মাইল দূরে চৌগাছায় আস্তানা গাড়ছে। হেই জায়গায় আমাগাে পাকিস্তানী সােলজাররা যেতে কইর‌্যা গরুর গােসের কাবাব খাইছিল- এইবার বিচ্ছুরা কয়েক ঘণ্টার মাইদ্দে আমাগাে হেইসব সােলজারগাে কাবাব বানাইল। গেরামের বাঙালিরা মহাখুশি। হেরা গামছা উড়াইয়া বিচ্চুগাে খােস্ আমদে জানাইতাছে।।
ছ্যার, সত্যি কথা কইতে কি, রাজাকারগাে কাছে অহন দুইটা মাত্র রাস্তা খােলা। রইছে। হয়, একটা রাইফেল আর ৩০ রাউণ্ড গুলি লইয়া Surreder করা- আর না হয়, মউত তেরা পুকার তা’। দুই কিছিমের কারবারই চলতাছে। পাকিস্তানী সােলজারগাে আঃ বাঃ ফ্রি। মানে কিনা আহার ও বাসস্থান ফ্রি হইয়া গেছে। হগ্গল সােলজারই আজরাইল ফেরেশতার খাতায় নাম লিখাইতাছে। এই রিপাের্ট পাইয়া লেঃ জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী কি রাগ? আকা ঘাড় তেড়া কইর‌্যা দেখে কি, সিলেট সেক্টরের লেঃ কর্ণেল জান মােহাম্মদ, মেহেরপুরের মেজর বসির খান, রংপুরের কর্ণেল অম্বর খান। আর মাদারীপুর-বরিশালের মেজর মাহবুব মােহাম্মদ মাথা নিচু কইর‌্যা খাড়াইয়া রইছে। হগুগল জায়গায় রিপাের্ট খুবই খতনা। পিতৃ-পিপ। পিপ-পিপ। জেনারেল পিয়াজী সাবে রেডিওগ্রামে মছুয়া সম্রাট প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে রিপাের্ট পাঠাইলাে। “আমগাে অহন কুফা টাইম শুরু হইছে। আরাে সােলজার পাঠান বঙ্গাল মুলুকে।”
ব্যাস্। খুনী ইয়াহিয়া খান হুইস্কির গ্লাস হাতে শিয়ালকোট থাইক্যা জদি ইসলামাবাদে ওয়াপস্ আইলাে। অ্যাডভাইসারগাে লগে গুতাগু করণের পর, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নয়া কিসিমের ট্রিকস্ করনের লাইগ্যা দোস্তগাে কাছে খবর পাঠাইলাে। ফরিন সেক্রেটারি সােলতাইন্যা নিউইয়র্ক-প্যারিস-বন থাইক্যা ধাওয়া খাইয়া ফেরত আইলাে আর বঙ্গাল মুলুকের গবর্ণর ঠ্যাটা মালেকা ঢাকার থনে পিন্ডি যাইয়া হাজির হইলাে। বুড্ডা বিল্লী নূরুল আমীন আগের থনেই পাকিস্তানে রইছে। ইসলামের যম, গােলাম আজম আর খুলনার খবরের কাগজের হকার এজেন্ট-মন্ত্রী মওলানা ইউসুইপ্যা ইসলামাবাদে যাইয়া “ইয়েচ ছ্যার” কইলাে। আর লারকানার পােংটা পােলা জুলফিকার আলী ভুট্টো মদের গিলাস হাতে “তু, মেরী মকি মােতি হ্যায়” গান গাইতে গাইতে চাকলালা বিমানবন্দরে উপস্থিত হইলাে। টেলিগ্রাম পাইয়া নতুন মামু, পুরানা চাচা, পরাণের দোস্ত- হগুগলে আইস্যা হাজির হইলাে।
এদিকে ঢাকার কারবার হুছেন নি? হেই দিন আঙ্কা কই থনে আমাগাে কালু মিয়া, যারে মহল্লার মাইনষে আদর কইর‌্যা কালু কইয়া ডাকে- হেই কালু আইস্যা হাজির। বেডায় চিৎকার করতাছিল। ভাইসাবরা, কারবার হুছেন নি? পিআইএ প্লেন সার্ভস নাইক্যা। দুই চাইর খান যে টেরেন চলছিল, হেইগুলার চাক্কা বন্ধ। বাস সার্ভিস তাে’ আগেই ইস্তফা। ঢাকা থাইক্যা বাইরাইনের হগ্গল রাস্তা বন্দু।
চিল্লানী থামাইয়া, কালু আমাগাে কাছে আগুগুইয়া আইলাে। আস্তে কইর‌্যা জিগাইলাে, “আচ্ছা, ভাইসাব, বিছু কারে কয়? হেরা দেখতে কেমন? হেগাে ‘ডেরেশ’ কি রকমের?
আঙ্কা আমােগা বকশি বাজারের ছক্কু মিয়া একটা বাইশ হাজার টাকা দামের হাসি দিয়া গলাটার মাইদ্দে জোর খাকরানি মাইরা কইলাে, “আমাগাে কাউলা, একটা আহম্মক। যুদ্ধের শুরু হওয়ার সাড়ে আট মাস বাদে হালায় জিগাইতেছে বিচ্চুগাে ডেরেশ কি রকমের? তয় হােন। এরা হইতাছে ‘দিকা মােহিনী, রাতকা বাঘিনী- পলক পলকে মছুয়া ঘষে। হেই দিন যারা বনানীতে প্রাক্তন গবর্ণর মােনেম খারে Marder কইর‌্যা হের লাস গায়ের কইর‌্যা ফালাইলাে- হেগাে বিচ্ছু কয়। এগাে কোনাে ডেরেশ নাই।
হ-অ-অ-অ। হেই দিক্কার কারবার হুছেন নি? লেংড়া, কানা, খোড়া, বেচা- যেই সব বুড়াবুড়া পাঞ্জাবি মছুয়া আর্মি থনে চাকরিতে রিটায়ার করণের পর ‘স্মাগলিং’আর ‘বিলেক মার্কেটের’ Business করতাছিল, জঙ্গী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান হগুগলরেই লড়াই করণের লাইগ্যা Call করছে। রিপাের্ট না করলে ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। এইগুলারেই কয় কামানের খােরাক। এই খবর শুইন্যা বিচ্চুগাে মুখ দিয়া অক্করে লালা পড়তে শুরু করছে। মছুয়া কোবায়ে কি আরাম ভাই, মছুয়া কোবায়ে কি আরাম!
যেই রকম খবর পাইতাছি, তাতে মন হয়, রােজার ঈদের পর থাইক্যাই বাঙালি গেরিলারা পাগল হয়ে উঠছে। হাতের কাছে দালাল, রাজাকার আর মছুয়া সােলজার পাইলেই বাড়ি- আরে বাড়ি রে বাড়ি! পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থা অক্করে ছেরাবেরা।
এই দিকে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্ট প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ারে Support দেওনের লাইগ্যা যে ট্রিক্স করছিল, হেইটা ভি গড়বড় হইয়া গেল। উথান্ট সাবে ঢাকায় জাতিসংঘের ৩৫ জন সাদা চামড়ার অফিসার পােস্টিং-এর পর হেগাে হাত দিয়া দিব্বি পাকিস্তানী আর্মিরে মালপানি আর রসদ জোগাইতেছিল। হেরাই অহন মুক্তিবাহিনীর মাইরের চোটে ঝাইড়া বাংকারে দৌড়াইতাছে। বাংকারে বইস্যা বিদেশী সাংবাদিকগাে কইছে যে “ঢাকার অবস্থা খুবই খারাপ। সমস্ত ফরেনাররা ভাগনের লাইগ্যা সুটকেস গুছাইতাছে। যেকোনাে Time-এ আসল কারবার হয়ে যেতে পারে। আসলে বাঙ্গালি গেরিলারা ডেইনজারা।।
এ্যাঃ এ্যাঃ। চাইরাে মুড়া পানি পাইয়া মুন্সীগঞ্জের বিচ্ছুরা একটা জব্বর কাম কইর‌্যা বইছে। তাগাে কথাবার্তার ধরণটাই আলাদা।
কই না তাে? আমাগাে মুন্সীগঞ্জে কোনাে টাইমেই মছুয়া আছিলাে না তাে? আমরা কোনােদিন পাকিস্তানী কোনাে সােলজারই দেখি নাইক্যা?
কয় কি? হাডিডর হিসাব পর্যন্ত নাই। সব লাশ গায়েব। আজরাইল ফেরেশতা পর্যন্ত মাথা খুজ্যাইতাছে। কেইসটা কি? জান কবজ করলাম ঠিকই। কিন্তু লাস নাইক্যা। অক্করে ভানুমতির খেইল।
এইদিকে সিলেট টাউন আন্দার, রংপুরে কোদালিয়া মাইর, মেহেরপুরে ঘেরাও, ঈশ্বরদি Airport ডাবিশ, কুষ্টিয়ায় মছুয়ারা মউত কা সামান লে চলে; কিশােরগঞ্জে Silent বাইস্কোপ, চাদপুর-বরিশাল-মাদারীপুরে দরিয়ার মাইদ্দে চুবানী, যশােরে গেন্জাম আর বগুড়ায়- ‘ইডা কেংকা কইর‌্যা হলাে রে’।
ঢাকা Airport-এর কন্ট্রোল টাওয়ার গুড়া, রানওয়েতে অনেকগুলা পুকুর, কংক্রিটের বাংকারে শ’য়ে শ’য়ে পাকিস্তানী সােলজারগাে লাশ। আজরাইল ফেরেস্তা Overtime কইরাও হিসাব মিলাইতে পারছে না। খালি Note করতাছে, শের মােহাম্মদ খানলাহাের এবং গয়রহ। এই গয়রহের মধ্যে কিন্তু শও তিনেক মছুয়া সােলজারের নাম রইছে।
এই দিকে একদল মুক্তিবাহিনী আবার মেহেরপুরে হাজির হইয়া আরে ধাওয়ানী রে ধাওয়ানী। একই সঙ্গে মর্টার আর মেশিনগানের গুলি।
কইছিলাম না, আমাগাে Time আইবাে- এক মাঘে শীত যাইবাে না। ভোেমা ভােমা সাইজের পাকিস্তানী সােলজাররা একদিনের যুদ্ধে গােটা কয়েক ট্যাংক ফালাইয়া চো দৌড়। খানিক দূর যাইতেই দেহে কি? আর একদল বিছু খালি ডাকতাছে, আ-টি-টি-টি । গেরামের গৃহস্থের বউরা যেমন কইরা মুরগিরে আধার খাওয়ানের লাইগ্যা ডাক দেয়। ঠিক হেমতে কইর‌্যা বাঙালি গােন্দা পােলাগুলা- কী সােন্দর ডাক দিতাছে ‘আ-টি-টি-টি।
হেরপর-বুঝতেই পারতাছেন। ঘেটাঘ্যাট, ঘেটাঘ্যাট, ঘেটাঘ্যাট, ঘেটাঘ্যাট। কয়েক শমছুয়া হালাক হইলাে। এই খবর না পাইয়া, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সেনাপতি ইয়াহিয়া খান অক্করে ঘং ঘং কইয়্যা কাইন্দা ভরাইছে। হালাকু খান-তৈমুর লঙ-নাদির শাহ-হিটলার-মুসােলিনী তােজো আর আব্বাজান আইয়ুব খানের নামে কসম খাইয়া সমানে খালি বিদেশী রাষ্ট্রগুলারে টেলিগ্রাম করতাছে। ‘Help, Help’।
কিন্তুক মওলবী সা’বে বহুত Late কইয়া ফেলাইছেন। অখন বাংলাদেশের লড়াইএর ময়দানে শুধু “খুন্কা বদলা খুনের কারবার চলতাছে। মুক্তিবাহিনীর বিক্ষুরা হইতাছে, “দিকা মােহিনী, রাক্কা বাঘিনী পলক পলকে মছুয়া ঘষে”।
হেইর লাইগ্যা শুরুতেই কইছিলাম, দম্ মাওলা-কাদের মাওলা’।

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল