১৫ অক্টোবর ১৯৭১
ঢাকা শহরে আবার পইট কারবার হইছে। খবর পাইয়া গবর্ণর ঠ্যাটা মালেকার কি কাঁপুনি? বেড়ার ফুলপ্যান্ট অক্করে ভিইজ্যা গ্যাছে। এই বিচ্ছুগুলা মানুষ না আর কিছু? এরা আইয়ুব খানের পেয়ারা প্রাক্তন গবর্ণর মােনায়েম খাঁ-রে মার্ডার করছুইন। বুধবার রাইতে মাত্র দুইজন বিক্ষু এই কারবার করছে। সাত বছরের গবর্ণর মােনাইম্যারে বিক্ষুগুলা খােদ ঢাকা টাউনে মেরামত কইরা ফেলাইছে। লগে লগে মছুয়ারা বেডারে মেডিকলে আনছিলাে। হারা রাইত ধইর্যা দম খিচতে খিচুতে বৃসসুদবার আল্লার রাইত পােহানের লগে লগে মােনাইম্যায় অক্করে ফ্যাল্ পাইড়া আজরাইল ফেরেশতার দরবারে যাইয়া ইয়েচ ছ্যার’ কইছুইন।
এতাে কইর্যা কইলাম, ‘তােমাগাে বধিবে যারা, বাংলাদেশে বাড়িছে তারা। তাই, হে বাঙালি মীরজাফর দালালগণ, আপনারা চিরকিৎ কমাইয়া ফালান-না হইলে হগলরেই মােনাইম্যার রাস্তা ধরণ লাগবাে। বিচ্চুগাে লােট বইয়ের মাইদ্দে সমস্ত নাম-ধাম উইঠ্যা গেছে। মেরহামত মিয়া পচকইর্যা এক গাদা গানের পিক ফালাইয়া কইলাে, ‘বিচ্চুগাে কারবার যেমন দেখতাছি, তাতে মনে হয় মেডিকলের বেড আর খালি যাইতে দিবাে না। কি সােন্দর দিনা দুই আগে রেডিয়াে গায়েবী আওয়াজ থনে খবর দিলাে ঠেটা মালেক্যার মিনিস্টার মাওলানা ইসাহাকরে বিচ্ছুরা বােমা মাইর্যা জখমী করছিলাে, হেই মাওলানা মেডিকল থনে মেরামত হইয়া ফেরত আইছে। লগে লগে ঘেটাঘ্যাটটট ঘেটাঘ্যাট ঘেটাঘ্যাটু ঘেটাঘ্যাটু। ব্যাস্ বিচ্চুগাে বড় কিসিমের কারবার হইলাে। মছুয়াগাে আস্তানা কুর্মিটোলার বগলে হইতাছে বনানী উপশহর- হেইখানে হানাদার নৌ-বাহিনীর Flag Officer Commanding রিয়ার এ্যাডমিরাল শরীফ সা’বের দফতর। হের লগে লাগা দোতলা বাড়িতে Action কইর্য বিচ্ছুরা মােনাইম্যার উপর আখেরী কারবার কইরা দিলাে। এখন মনে পড়তাছে। সাত বছর গবর্ণর থাকনের টাইমে এই মােনাইম্যার অর্ডারে নড়াইল, সিলেট, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, নারায়ণগঞ্জ, জয়পুরহাট, ঢাকা প্রভৃতি জায়গায় কত বাঙালি মার্ডার হইছে, তার কোনাে হিসাব নাইক্যা। ভাবছিলা, এমতেই দিন যাইবাে আর কি। কিন্তু বাঙালির মাইর দুনিয়ার বাইর। ১৯৬৯ সালের কথা। তুমি আর তােমার ওস্তাদ আইয়ুব খানরে ক্ষমতা থাইক্যা ঘেটি ধইরা নামানাে হইলাে। হেরপর তােমার চিরকিৎ হইলাে। তুমি ট্রিকস কইরা কুর্মিটোলার বগলে বনানীতে বাড়িবানাইলা । ভাবছিলা, এতেই তুমি রক্ষা পাইবা। কই, এলায় তাে তােমারে ইয়াহিয়া খানের মছুয়া সেঞ্জাররা বাঁচাইতে পারলাে না? গােটা চারি মেলেটারি চেকপােস্ট পার হইয়াই তাে বিচ্ছুগুলা অক্করে তােমার ড্রইং রুমে যাইয়া হাজির হইলাে। জীবনে বহুত কুকাম আর গেনজাম করছিলা। এলায় তার ফল পাইলা। ঘটনার এই খানে শেষ নয়। মুজিবনগরে খবর আইছে, বনানী গােরস্থান থাইক্যা নাকি তােমার লাশটাও গায়েব হইয়া গেছে।
আকা আমাগাে ঢাকার গবর্ণমেন্ট হাউসে ঠাস কইর্যা একটি আওয়াজ হইলাে। ডরাইয়েন না, ডরাইয়েন না। ব্রিগেডিয়ার বশীরের কাছ থাইক্যা টেলিফোনে মােনাইম্যার মার্ডার হওনের খবর পাইয়া ঠ্যাটা মালেকা চেয়ার থনে চিত্তর হইয়া পইড়া গেছিলেন। আর একটা চেয়ারে নূরুল আমীন সা’বে বইস্যা ছিলেন। তিনি মালেকারে সান্ত্বনা দিলেন। কইলেন, ‘ডাক্তার সা’ব আর কাইন্দা ফায়দা হইবাে না। নাচতে যহন নামছেন, তহন ঘােমটা দিয়া লাভ কি? এলায় সিনার মাইদ্দে হিম্মত আনেন। ঠ্যাটা মালেকা Riot Minister বরিশালের ব্যারিস্টার আখতার উদ্দীনের কাঁধে ভর দিয়া ফুলপ্যান্ট বদলাইবার জন্য ছােট ঘরে গেলােগা।
আঙ্কা একটা হৈ চে আওয়াজ শুইন্যা আমি অক্করে থ’। দেহী কি? আমাগাে খাজা দেওয়ান সেকেন্ড লেন থনে নাইড়া মাথা হইয়া ছক্কু মিয়া দৌড়াইয়া আইতেছে। আমি ছকুরে অক্করে জড়াইয়া ধরলাম। কইলাম, তুমি কয়দিন কই আছিলা? কী হইছিলাে? কই গেছিলা? ছকু একটু দম লইয়া কইলাে, ভাই সাব কইতাছি, কইতাছি- হগ্গল কথাই কইতাছি। হেইদিন আমাগাে মহল্লার মাইদ্দে খাজা খয়রুদ্দীন আর বংশালের শামসুল হুদা সা’বে আইছিল। হেশে শুনলাম আমারে বলে ঠ্যাটা মালেকা মিনিস্টার বানানাের লাইগ্যা খুঁজতাছে? লগে লগে ভাগােয়াট হইলাম। পহেলা মাথা নাইড়া করলাম, হেরপর U.G. মানে কিনা কম্যুনিস্ট পার্টির কমরেডগাে মতন আন্ডার গ্রাউন্ড এ গেলাম। আমি ছকুরে কইলাম, ‘অহন একটু চুপ করাে, অন্য টাইমে খাতির জমা শুনুম।
হ-অ-অ-অ এই দিক্কার কারবার হুনছেন নি? লারকানার লাড়কা ক্ষেমতা না পাওনের গতিকে, আরে গাইল রে গাইল। সেনাপতি ইয়াহিয়ার বেআইনী কারবারের এ্যাডভাইসর জাস্টিস কর্ণেলিয়াসের চৌদ্দ গুষ্টি তুইল্যা গাইল। এই কর্ণেলিয়াস সাব-এর লগে আগে ভুট্টোর কি খাতির! দুইজনে গিলাসে গিলাসে ঠোকাঠুকি কইর্যা সরাবন তহুরা খাইতাে। ২৫শে মার্চ দিবাগত রাইতে সেনাপতি ইয়াহিয়া খান যহন বেশুমার বাঙালি মার্ডারের অর্ডার দিলাে, তখন এই দুই বেডায় ‘ইয়েচ ছ্যার’ কইয়া কি খুশি। আর অহন? হেরা হেরাই ফাটাফাটি করছে। ভুট্টো সা’বে গাইল দেওনের টাইমে জাস্টিস কর্ণেলিয়াস সা’বরে দেশের দুশমন আর খ্রিস্টান কাফের কইয়া বইছে। বুড়া কর্ণেলিয়াস হাউমাউ কইর্যা কাইন্দা Resign দিছে। সেনাপতি ইয়াহিয়া এই ব্যাপারে অক্করে খামুশ রইছে। কোনাে দিকেই support দেয় নাই। | এই দিকে করাচি-লাহুর-পিন্ডিতে আইজ-কাইল মাত শুরু হইছে। হাজার হাজার অবাঙালি ব্যবসায়ী হেই যে, একশ’ আর পাঁচশ’ টাকার নােট গভর্ণমেন্টের কাছে জমা থুইছিলাে, তারা হেই টাকা একবারে ফেরত চাইছে। অবশ্য বঙ্গাল মুলুক থাইক্যা লুটপাট করুন্যা বহু মাল-পানি এর মাইদ্দে রইছে। কিন্তুক ইসলামাবাদের সামরিক জান্তা এলায় মাথায় হাত দিয়া বইছে। তহবিল শূন্য- মালপানি নাইক্যা। এক দফায় ১৪২ কোটি টাকা ফেরত দেয়া সম্ভব নয়। তাহলে উপায়? সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের ওয়াজির-এখাজানা এক জব্বর ফর্মূলা বাইর করছুইন। বেডা আবার কাদিয়ানী মুসলমান। তাই জামাতে ইসলাম পার্টির এক গুন্ডা এই মন্ত্রীরে চাকু মারছিল। বেডায় অল্পের জন্য বাঁইচ্যা গেছেন। এহেনাে এম.এম. আহম্মক সা’বে কইছুইন, যারা টাকা জমা দিয়েছেন তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। জমা দেয়ূন্যা টাকা হালাল-না হারাম। অবশ্য এজন্য একটা টিম বানানাে হয়েছে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে এগাে কাম শ্যাষ হইতে বেশি না, মাত্র বছর দুই সময় লাগবাে আর কী? ছক্ক অক্করে ফাল পাইড়া কইলাে, বুঝছি, বুঝছি,। আহম্মক সা’বে গা মুচড়া-মুড়ি কইরা টাইম লইতাছে। আসলে এই টেকাগুলা মছুয়ারা গেড়া মাইরা দিছে।
বঙ্গাল মুলুকের খবর হুছেন নি? লেঃ জেনারেল পিঁয়াজী সা’বে আইজ-কাইল বহুত ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। বেড়ায় সকাল-বিকাল খেপ মারতে শুরু করছে। হাওয়াই জাহাজে চিটাগাং-এ যাইয়া পিয়াজী সা’বে মছুয়া সােলজারগাে Morale এসট্রং করণের কোশেশ করছে। এই এলাকায় বিক্ষুরা প্রায়ই মছুয়াগাে বিরক্ত করতাছে। এছাড়া পাকিস্তান থাইক্যা আমদানী করা পুলিশের দল গেরামে যাইতে খুবই ডরাইতাছে। সন্ধ্যা হওনের আগেই জেনারেল পিয়াজী সা’বে ঢাকার সেকেন্ড ক্যাপিটালে ফেরত আইলেন। কিন্তু খবর বহুত খতনাক। কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট-এর একবারে নাকের ডগায়। বিচ্ছুরা আঙ্কা হামলায় এক প্লাটুন মছুয়া প্যারামিলিশিয়া অক্করে ছেরাবেরা কইরা ফ্যালাইছে। ক্যান্টনমেন্ট থাইক্যা কোনাে সাহায্য আসেনি। এইবার জেনারেল পিয়াজী মহাগরম হইয়া ময়নামতী ক্যান্টনমেন্ট সফর করলেন। এ্যাঃ এ্যাঃ! সেই রাতেই ঢাকার বনানীতে বিচ্চুগাে কারবার হইলাে। হেরা নৌবাহিনীর কমান্ডিং অফিসের বগলে বনানীতে প্রাক্তন গবর্ণর মােনায়েম খারে Clear করলাে। আইজ-কাইল নাকি প্রায়ই ঠেটা মালেকা, নুরুল আমীন আর মােনাইম্যার লগে সিক্রেট বাতচিত হইতাছিল। ঠেটা মালেকা নাকি প্রায়ই মােনাইম্যার কাছ থাইক্যা বুদ্ধি লইতাছিল। একটা Action-এ সব শেষ।
কী কইলেন? কী কইলেন? পাকিস্তান থাইক্যা নতুন আমদানী করা কিছু অফিসার ঢাকার কাকরাইলে সার্কিট হাউসে ক্যাম্প অফিস বানাইছে। হেগাে রাইতদিন মছুয়া। সােলজাররা পাহারা দিতাছে। কিন্তু তা হইলে কি হইবাে? একটুক হিসাব কইরা ঘুমাইয়েন। যেকোনাে টাইমে বিচ্চুগাে কারবার হইতে পারে। করাচী, লাহুর, পিণ্ডিতে যে বউ-পােলাপান থুইয়া আইছেন, হেগাে লগে আর মুলাকাত নাও হইতে পারে। হেইর লাইগ্যা কইছিলাম, ঢাকা টাউনে আবার পইট কারবার শুরু হইছে। ময়মনসিংহের মােনাইম্যা বিচ্ছুগুলার ঘষাঘষিতে সােজা আজরাইল ফেরেশতার কাছে যাইয়া ইয়েচ ছ্যার, কইছুইন।
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল