অক্টোবর ১৯৭১
তেলেসমাতি কারবার। ঢাকার ছেক্রেটারিয়েটে অখন তেলেসমাতি কারবার শুরু হইছে। আমাগাে খুলনার খবরের কাগজের হকার-এজেন্ট মওলানা ইউসুপ্যা ঠ্যাটা-মালেক্যার নয়া মন্ত্রী হইয়া কি খুশি। পয়লা দিন ইডেন বিল্ডিং-এর চেয়ারের মাইদ্দে বইস্যা চিন্তা করতাছিল ‘হে খােদাবনতালা, বঙ্গাল মুলুকের অবস্থাটা যেন এইরকম ক্যাডাবেরাসই থাইক্যা যায়। ত হইলেই আমার মন্ত্রীত্ব কোনাে ব্যাডায়ও গড়বড় করতে পারবাে না। হেইর লাইগ্যাই আমার কাছে ইয়াহিয়া সা’বের গণতন্ত্র খুব ভালাে লাগে। কেমন সােন্দর ইলেকশনে গাবুর বাড়ি খাইয়াও মন্ত্রী হওন যায়। Election-এ জেইন্যা ব্যাডাগুলারে দুশমন কওয়া যায়। আকা মওলানার মুখ থাইক্যা গৎ কইর্যা এক থাবা লালা টেবিলের ফইলডার উপর পড়লাে। ব্যাডায় এইদিকে ওইদিকে ফুচি মাইরা যখন দেখলাে যে কেউই নাইক্যা, তখন আস্তে কইর্যা সেরােয়ানীর হাতা দিয়া জিনিষডারে মুইছা ফালাইলাে। আল্লায় সারাইছে, অহন মন্ত্রী হওনের গতিকে ঢাকার কোনাে খবরের কাগজ থাইক্যাই আর বিলের বকেয়া টাকার জন্যি তাগিদ দিতে পারবাে না। না হইলে এই খবরের কাগজের হকার-এজেন্ট থাকনের লাইগ্যা বছরের পর বছর ধইর্যা মর্নিং নিউজের বদরুদ্দিন, আজাদের খান সাহেব, পাকিস্তান অবজারভার-পূর্বদেশের মাহবুবুল হক আর দৈনিক পাকিস্তানের আহসান আহমদ আশফাক সাবরে কত মাল-পানি খাওয়াইলাম আর মাখনবাজী করলাম। এলাই ব্যাডারা করবাে কি? উল্ডা আমারেই মাল-পানি খাওয়াইতে হইবাে। অহন আমি ঠ্যাটা মালেকার মন্ত্রী হইছি। হাঃ হাঃ হাঃ।
ছক্ক অক্করে ফাল পাইড়া উডলাে। কী হইলাে, খালি যে ইউসুপ্যার কথা কইবার লাগছেন? রাজশাহী বিভাগের জামাতে ইসলামী নাজেম মওলানা আব্বাস আলীর কথা কইবেন না? আঃ হাঃ! একটু সবুর করাে। এ্যাড়ায় নতুন আমদানী কিনা তাই কইবার আগে একটু Time লইতাছি। হেইদিন ঠ্যাটা মেরহামত মিয়া একটা আধমন ওজনের হাঁচি মাইর্যা বইলাে। আমি অক্করে থ’ বইন্যা গেলাম। মেরূহামত মিয়া পরনের তপন দিয়া মুখ মুইছা কইলাে ‘হ’ এলায় কন। আমি আবার শুরু করলাম। পয়লা দিন মন্ত্রী হওনের পর মওলবী সা’বে মুখের থারটি টু মানে কিনা বত্রিশ পাটি দাঁত বাইর কইর্যা ছেক্রেটারিয়েটে আইলাে। দুপুরে বেলি গড়নের সময় ব্যাডার লাগালো ভুক। এইদিকে কেমতে জানি হেই সময় বিজলী নাইক্যা। তাই বেল বাজাইয়া একটা চাপরাশীরেও পাওয়া গেল না। এহন করে কী? উপর তলা থাইক্যা নাইম্যা নিজের ড্রাইভার খুঁজতে বাইর হইলাে। এইদিকে উর্দুওয়ালা ড্রাইভারের নাম চেহারা দুইডাই ভুইল্যা গেছে। হ্যাষে খুঁজতে খুঁজতে মন্ত্রীগাে গাড়ির আস্তাবল, থুরি গ্যারেজে যাইয়া হাজির হইলাে। মছুয়া ড্রাইভার হেইখানে বইস্যা রাজা উজীর মারতাছিল। তারা মার্কা আধা ছিকরেটটার মাইদ্দে একটা কড়া কিসিমের দম দিয়া নাক মুখে ধুমা ছাড়তে ছাড়তে ছ্যারের কাছে হাজির হইলাে। মওলানা ড্রাইভাররে কইলাে, হাম যাকে কামরামে বেইঠাতা হ্যায়। তােম মেরা পাস আকে বলেগা, ছ্যার লঞ্চকা টাইম হুয়া। ব্যাস ম্যায় খানা খানেকে লিয়ে আ যাউঙ্গে। আবৃ সম্ঝা। যেই রকম বুদ্ধি, হেইরকম কাম। এলায় কেমন বুঝতাছেন নয়া মন্ত্রী মওলানা আব্বাস আলীর কারবার সারবার?
এইদিককার কারবার হুনছেন নি? দুইজন মাইনষের তিন পার্টি। কী হইলাে ছক্কু মিয়া, মাথা খাউজাইলে কি হইবাে, এই ধাঁধারও জওয়াব দেওন লাগবাে কিন্তুক! আমাগাে ছক্ক Think করতে শুরু করলাে। আকা চিল্লাইয়া উঠলাে ‘পাইছি, পাইছিআমি জওয়াব পাইছি। ছ্যার লেখাপড়া না শিখলে কি হইবাে- ঠেকতে ঠেকতে শিইখ্যা ফেলাইছি। এলায় কমু?” লও লও, মিয়া আর গা মােচড়া-মুচড়ি কইর্যা কি হইবাে? কইয়া ফেলাও। ছক্কু মিয়া তার খয়েরি রংগের দাঁতগুলা বাইর কইর্যা পয়লা একটা হাসি দিয়া কইলাে কাউন্সিল মুছলিম লীগ হইতাছে দুইজনে তিন পার্টি। খুইল্যা কইতাছি। মাইনকা চরের আবুল কাসেম আর কুমিল্লার শফিকুল ইসলাম- এই দুইজন হারু মাল মিইল্যা হেগাে কাউন্সিল মুসলিম লীগ পার্টি। এর মাইদ্দে আবার তিনডা গ্রুপ রইছে। কাসেম্যার একটা গ্রুপ। শফিকুলের একটা। আর কাসেম্যা শফিকুল দুইজনে মিইল্যা আরাে একটা গ্রুপ- কেমন সােন্দর পার্টি হইয়া গেল গা। এরই কয় দুইজন মাইনষের তিনডা পার্টি বারাে হাত কাঁকুড়ের তেরাে হাত বীচি। আমি চিল্লাইয়া উঠলাম, ‘অক্করে কাপে কাপ। ছক্কু মিয়া অংক পরীক্ষায় পাশ কইর্যা ফেলাইছে। এর মাইদ্দে একটা কিন্তুক রইছে। দুইজনের পাট্টি কাউন্সিল মুসলিম লীগে আবার ফাটাফাটি কারবার শুরু হইছে। মাইনক্যার চরের ক্যাসেইম্যা তার পাট্টি মানে কিনা শফিকুলের লগে গুফতাগু কইরাই ঠ্যাটা মালেকার মন্ত্রী হইছে। ব্যাস, শফিকুল কি রাগ?
বেডায় একা একাই প্রস্তাব পাশ কইর্যা Protest করছে আর খালি হাতের গােস্ত কামড়াইয়া রাগে গগ করতাছে। Election-এর মাইদ্দে তাে দুইজনেই আওয়ামী লীগের হাতে কুফা পিডানী খাইছি। কাসেম্যা দুই জায়গা থনে হারছে বলে হের দাবী আগে হইলাে? একটা শূন্য আর দুইটা শূন্যর তাে একই দাম- নাকি হের মাইদ্দেও তফাৎ রইছে? মালেকারে যে ঠ্যাটা কয় এমতে কয় না। এইদিকে পয়লা দিন ছেক্রেটারিয়েটে গদিতে বইয়্যাই আমাগাে ছলু মিয়া মানে কিনা মােহাম্মদ সােলেমান ফোন কইর্যা শফিকুলরে কইলাে, ভাইসাব’ আমি আগেই জানতাম কাসেম্যা এই রকম কারবারই করবাে। হেইর লাইগ্যা তাে’ কেমন সােন্দর একজনের একটা পাট্টি কৃষক শ্রমিক পার্টি কইর্যা থুইছি। এই পাট্টির থাইক্যা প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি, পিওন, চাপরাসী যারেই মন্ত্রী করবাে, ওই ঘুইর্যা-ফিইর্যা এই বান্দা সােলায়মান। কেমন বুঝতাছেন? গােস্ত খাওনের পর মাইনষে যেমতে কইর্যা সাবান দিয়া হাত ধােয়, তেমতে কইর্যা সাবান দিয়া হাতের থনে মার্ডার করা বাঙালির রক্ত ধুইয়া কক্সবাজারের ফরিদ আহমদ সাব এলায় নতুন টিরিক্স করচে। হারু-পাট্টির নেতাগাে মাইদ্দে যে পাইট চলতাছে, হেই পাইটে হাইরা যাইয়া মওলবী সা’বে আবার চান্সিং করতে শুরু করছেন। কি সােন্দর একটা পাট্টি বানাইছে, ‘শান্তি ও কল্যাণ পরিষদ। উদ্দেশ্য হইতাছে অশান্তি ও অকল্যাণ। ফরিদ সাব কিন্তুক ছলু মিয়ার মতাে নিজেই এই পার্টির প্রেসিডেন্ট হইছইন। হপ্তার মাইদ্দে ছয়দিন হইতাছে বাঙালি মার্ডার, জমি দখল, বাড়ি লুট এই সব Diffecult কাম আর একদিন হইতছে বিবৃতি মানে কিনা Statement দেওন। এই বিবৃতির একটাই কাম- সেনাপতি ইয়াহিয়ারে মাখনবাজী। বেড়া একখান ।
হেইদিকে ইয়াহিয়া সা’বের পররাষ্ট্র ছেক্রেটারি ছুলতাইন্যা তুরস্কের পরিবার পরিকল্পনার এক প্রতিনিধিদলের লগে জন্ম নিয়ন্ত্রণের বদলে Politics আলাপ করছে। কি রকম অবস্থা দাঁড়াইছে বুঝতেই পারতাছেন। তুরস্কের জন্ম নিয়ন্ত্রণওয়ালাগাে ইয়াহিয়া সাবের ফরিন সেক্রেটারি ছুলতাইন্যা কইছে, ‘ইয়ে সব Internal Problem হ্যায়- সব ঠিক হাে যায়েগা। ক্যামন বুঝতাছেন? সােভিয়েট রাশিয়ার থনে ধাওয়া খাইয়া ফেরৎ আহনের পরথাইকাই এই ব্যায় এই রকম উল্ডাপান্ডা কথাবার্তা কইতাছে।
এইদিকে আর এক খবর হুনছেন নি? যশাের, খুলনা, কুষ্টিয়াতে ডিউটি করুইন্যা মছুয়াগুলার জন্যি গম, ডাল্ডা আর সয়াবিনের তেল লইয়া একটা আমেরিকান জাহাজ গেল জুম্মার দিন চালনা বন্দরে আইছিল। আইজ-কাইল ঢাকার থনে খাবার পাড়ানাে যাইতাছে না বইল্যাই জঙ্গী সরকার এই টিরিক্স করছিল। লগে লগে বিক্ষুগুলা জাহাজডারে হেই কারবার কইর্য দিলাে। ঢাকার গবর্ণর হাউসে এই খবর আহনের পর ঠ্যাটা মালেকা আর পিয়াজী সা’বে অনেক Think কইর্যা দেখলাে যে আমেরিকান জাহাজ হওনের গতিকে এই খবরডা চাপি করন খুবই মুস্কিল হইবাে। তাই ঢাকার খবরের কাগজের এডিটরগে লগে গুতাগু কইর্যা একটা ভােগা নিউজ তৈরী করলাে। কইতে হইব, এই আমেরিকান জাহাজের মাইদ্দে বাঙালিগাে লাইগ্যা খাবার আইতাছিল । তা’ হইলেই তাে পাবলিকরে ভােগা মারনের সুবিধা হইবাে। যেই রকম বুদ্ধি, হেই রকম কাম। ব্যাডায় তাে আবার ভাসুরের নাম মুখে আনতে পারে না। তাই কইয়া হেলাইছে, হিন্দুস্থানী এজেন্টরা পরায় একশ’ মাইল ভিতরে চালনা বন্দরে কারবার কইর্যা আবার বহাল তবিয়তে ফেরত চইল্যা গেছে। মালেক্যা-পিঁয়াজীর মাথায় কি বুদ্ধি! মাথা দুইডা ঝাঁকি দিলে অক্করে নারিকেলের মতাে ঘং ঘং কইর্যা আওয়াজ হয়।
এতাে কইরা না করলাম, মাতব্বরী মারাইছ না। ঢাকা টাউন Normal হইছে। বইল্যা ঠ্যাটা মালেক-পিয়াজী যে সব কথা কইতাছে- সেই সব ভােগাছ বার্তা হুনিস না । নাঃ আমার কথা হুনলাে না। আমাগাে মাওলানা ইছাহাক মন্ত্রী হইয়া কি খুশি! মােটর গাড়ি কইর্যা বেডাকাউঠা মাওলানা ঢাকা টাউন দেখতে বারাইছিল। মেডিকলের কাছে ঘ্যাটাঘ্যাট, ঘেটাঘ্যাট, ঘেটাঘ্যাট, ঘেটাঘ্যাট- কি হইলাে, কি হইলাে? বিচ্ছুগুলা কেইস খুবই খারাপ কইরা ফেলাইছে। মন্ত্রী মাওলানা ইছাহাকের গাড়ির মাইদ্দে বােমা মারছে। মাওলানা ইছাহাকের উপর ইচ্ছামতাে কারবার হইছে। গাড়ি শ্যাষ। বেডায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বেডের মাইদ্দে হুইত্যা অখন খালি দম খিচতাছে। আজরাইল ফেরেশতার দরবারে যাওনের লাইগ্যা মওলবী সা’ব সিংহাতিকভাবে টিরাই করতাছে। হেই যে কইছিলাম- ঠ্যাটামালেকার মন্ত্রীরা সব- একটু হিসাব কইর্যা চইলেন। বিচ্ছুগুলার লােট বই-এর মাইদ্দে আপনাগাে নাম-ঠিকানা, চেহারা মােবারকের লিস্টি দেখছি। এলায় বুজছেন কীর লাইগ্যা কইছিলাম। আমাগাে ছকু কি খুশি! আল্লায় সারাইছে। হেরে তাে ঢাকার থনে মন্ত্রী বানাইতেও পারতাে? ঠ্যাটা মালেকারে দিয়া কিছুই বিশ্বাস নাইক্যা। হেইদিন তাে Radioর মাইদ্দে Student গাে ডাক দিছে। ব্যাডায় ছাত্রগাে লাইগ্যা কী কান্দন! আপনারা হগুগলেই দৌড়াইয়া আইস্যা স্কুল-কলেজে Join কইর্যা ফলান। বিক্ষুগুলার গাবুর মাইরের গতিকেই গায়েবী আওয়াজ থাইক্যা আপনাগাে Call করতাছি। আপনারা না আইলে কিন্তু আমাগাে চাকরি not হইয়া যাইবাে।
হেইর লাইগ্যাই কইছিলাম। তেলেসমাতি কারবার। ঢাকার ছেক্রেটারিয়েটে অখন তেলেসমাতি কারবার শুরু হইছে।
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল