You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.02 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

২ আগস্ট ১৯৭১

খাইছে রে খাইছে। করাচীর সান্ধ্য দৈনিক লিডার কাগজে একটা জব্বর খবর ছাপা হয়েছে। এই খবরে বলা হয়েছে যে, ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকার আঞ্চলিক ভিত্তিতে গঠিত রাজনৈতিক দলগুলাে বেআইনী ঘােষণার ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখছেন। মুসলমান-মুসলমান ভাই-ভাই, চিল্কার করে যে দেশ গঠন করা হয়েছে, সেখানে সিন্ধি, বেলুচি, পাঠন- সবকিছু বাইড়াইয়া একাকার করা হবে। লিডার কাগজে বলা হয়েছে, এখন বেলুচিস্তানের ইউনাইটেড ফ্রন্ট ও খান আব্দুস সামাদ আচকজাই-এর পাখতুন খাওয়া আর সিন্দুর মাহাজ পার্টি ও জি.এম. সৈয়দের ইউনাটেড ফ্রন্টকে বেআইনী ঘােষণা করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কেননা এইসব পার্টি অবিরামভাবে খালি নিজেদের দাবি উত্থাপন করে নিজেদের এলাকায় জনপ্রিয়তা অর্জন করছে- এরা কোনাে সময়েই পিন্ডি-মার্কা ইসলাম আর পাকিস্তানের জন্য দরদ দেখায় না।
পশ্চিম পাকিস্তানের খবরের কাগজগুলার উপর পূর্ণ সেন্সরশিপ জারি করে আর সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক সভা-সমিতি বন্ধের অর্ডার দেয়ার পরও ইসলামাবাদের সাতজেনারেলের সামরিক জান্তা এখন সেখানকার সমস্ত বেয়াদব পার্টিগুলারে বেআইনী করণের ব্যবস্থা করছে। কিন্তু ভাইসব লিডার কাগজের রিপাের্টডা এইখানে শ্যাষ হইলে আমি এইডার কথা কইতামই না। ইস পরচামে আউর ভি লিখুখি। কেয়া লিখি? যদি ভিমরি না খান তয় কইতাছি। এবারের নির্বাচনে বাংলাদেশ, বেলুচিস্তান আর সীমান্ত প্রদেশ থাইক্যা একটাও সিট না পাওনের গতিকে সেনাপতি ইয়াহিয়া আইজ-কাইল জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টিরে আঞ্চলিক পার্টি হিসাবে মনে করছেন। তাই অন্যসব আঞ্চলিক পার্টিগুলা বেআইনী করনের লগে লগে এই পিপলস পার্টিরেও বেআইনী ঘােষণার চান্সিং রইছে। হেগাে কারবার-সারবার কেমন মনে হইতাছে? কইছিলাম না, হেগাে দিয়া কিছুই অবিশ্বাস নাইক্যা।
লিডার কাগজের এই রিপাের্টে আর একটুক মাজমাদার ব্যাপার রইছে। এই রিপাের্টডা হাচা না মিছা- এই সম্পর্কে গবর্ণমেন্ট থাইক্যা কোনােই আও শব্দ করা হয় নাইক্যা। কেইসটা কি? করাচীর এক্সপার্টরা মনে করতাছেন লিডার কাগজের এই রিপাের্টড আসলে ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারের Advissor রাই সাপ্লাই করছেন। হেরা দেখতে চায় এই রকম কারবার করলে হেগাে পাবিলকগাে মাইদ্দে কি রকম Reaction হয়। ভুট্টো সা’বের পিপলস পার্টি পাওয়ারে আহনের লাইগ্যা খুবই ঘ্যানরঘ্যানর করতাছে বইল্যা এইডার চোটপাটল্ডা একটু কমানাের দরকার। তিনডা মুসলিম লীগ, দুইডা জামাতে উলেমা, পি.ডি.পি. নেজামে ইসলাম আর জামাতে ইসলামী পার্টিরে ব্যান করা না করা সমান কথা। হেইগুলা তাে ভেড়া। আগের থাইক্যাই লেজ গুটাইয়া তু করণের লগে লগে পা চাটতে শুরু করছে।
কিন্তু এই দিক্কার কারবার হুনছেন নি? ঢাকা থেকে এসােসিয়েটেড প্রেস অব আমেরিকা এক সিংহাতিক রিপাের্ট পাঠিয়ছেন। কুমিল্লা শহর এখন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। মানে কিনা ঢাকার লগে কুমিল্লার যাতায়াত পরায় বন্ধ হওনের উপক্রম হইছে। কারণ বি-ইছু। মুক্তি বাহিনীর বিক্ষুগুলার কায়কারবার খুবই বাইড়া গেছে। আমেরিকান ডিনামাইট আর চীনা Hand-Grenade-এর বাড়ির চোটে এক মসে দুইবার কুমিল্লা আন্দার হইছে আর টাউনের থনে তিরিশ মাইল উজানের বড় ব্রিজডা অক্করে গায়েব। এর মাইদ্দে আবার বিগুলা কুমিল্লা টাউনের দেয়ালে পােস্টার লাগানাে ছাড়াও হ্যান্ডবিল বিলি করতাছে। ভাইসব গাবুর মাইর আর ছেরাবেরা কারবার শুরু হওনের টাইম আইছে। আপনারা গেরামে গেলে ভালাে হয়। সমস্ত কুমিল্লা শহরে এখন একটা ক্যাডাভ্যারাস অবস্থা। সন্ধ্যা হইলেই খালি গুলির শব্দ পাওয়া যাইতাছে।
এই রকম একটা কুফা অবস্থায় টিক্কা-নিয়াজীর সােলজাররা কুমিল্লা টাউনে মাইক। দিছে ‘আপ লােককো ডরনে কা কই বাত নেহি হ্যায়।’ কিন্তু হেরা নিজেরাই ডরাইয়া রাইত-বিরাইতে ক্যান্টনমেন্ট থাইক্যা বাইরান বন্ধ করছে। এইদিকে ময়নামতী থেকে অবিরাম ঢাকার ইস্টার্ন কম্যান্ড হেড কোয়ার্টারে মেসেজ যাচ্ছে ‘পাড়াও, পাড়াও আরাে সােলজার পাডাও। না হইলে কিন্তু সেনাপতি ইয়াহিয়া যখন মঙ্গলবারে কুমিল্লায় আইবাে, তহন তার লাইফ খতরনাক হইতে পারে।
এই দিকে ফেনীও আন্ধার হইয়া গেছেগা। মুক্তি বাহিনীর তুফান জাতির চোটে যখন হানাদার সৈন্যদের ত্রাহিমধুসূদন ডাক শুরু হয়েছে আর বাংলাদেশের ক্যাদো আর প্যাকের মাইদ্দে খেইলটা ‘জিওট’ বান্দতে শুরু করছে তখন চাইর মাস বাদে সেনাপতি ইয়াহিয়ার বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা সফর করণের চিরকিৎ হইছে। এই চাইর মাসে জেনারেল আব্দুল হামিদ খান দুইবার, বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শল এ. রহিম খান একবার, নৌবাহিনীর প্রধান ভাইস এডমিরাল হাছন সা’ব একবার আর সীমান্ত প্রদেশের গবর্ণর লেঃ জেনারেল আজর সা’ব একবার কইর‌্যা বিচ্চুগাে কারবার দেইখ্যা গেছেন। এছাড়া লেঃ জেনারেল পীরজাদা ও জেনারেল ওমরও গােপনে ‘যাদুএ-বঙ্গাল’ ট্যুর করছেন।
এরপর আমেরিকান সাপ্তাহিক পত্রিকা টাইমে যখন ভাণ্ডা ফুটা কইরা কইছে কম করে হলেও দখলদার সেন্যদের আহতের সংখ্যা দশ হাজারের উপর আর যেসব মীরজাফর-মার্কা লােক এদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে তাদের মধ্যে নিদেন পক্ষে পাঁচশ জনকে গেরিলারা হত্যা করেছে’ তহন ইয়াহিয়া সাবের টনক নড়ছে। হেতনে দুইদুইবার ট্যুর ‘কেনচেল’ করণের পর এখন বলীর পাড়ার মতাে কাঁপতে কাঁপতে Internal Affair দেখতে আইতাছেন। আল্লায় জানে কপালে না জানি কি আছে?
হ-অ-অ এই দিকে রাও ফরমান আলী একটা ফাস্ট কেলাশ অর্ডার দিছেন। বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকারে Normal প্রমাণ করনের লাইগ্যা, আগামী জুমেরাত থাইক্যা রাজশাহী, যশাের ও কুমিল্লা বাের্ডের S.S.C. পরীক্ষা হইবাে বইল্যা এলান করছেন। কিন্তুক বাড়ায় এই ঘােষণার মাইদ্দে একটুক ভুল কইর‌্যা ফেলাইছেন। কেননা রাও সাহেব কইছইন ডাহিনা মুড়া দিয়া লেখাইন্যা পােলাগুলার এমতেহান’ মানে কিনা পরীক্ষা কেবলমাত্র ঢাকার মােহাম্মদপুর সেন্টারে হইবাে। ক্যাননা, এরা আবার মফঃস্বল থাইক্যা কষ্ট কইর‌্যা ঢাকা আইবাে ক্যান? হেগাে পরীক্ষা রাজশাহী, যশাের, কুমিল্লা এলাকায় লইতে কি ঠ্যাং কাঁপে নাকি? ও-অ-অ বুঝছি, শিক-কাবাব খাওইন্যা এসব হেই জিনিষ আগেই মফঃস্বল থাইক্যা ঢাকায় ভাইগ্যা আইছে। তাই সেকেন্ডারি স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার জন্য এদের মফঃস্বলে পাড়ানাে খুবই Risky মনে হইতাছে। এতে লজ্জার কি আছে? একটু সােজাভাবে ঘােষণা করলেই হতাে। মুক্তি বাহিনীর গেরিলাদের কঁাচকা মাইরের গতিকেই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। ও-অ-অ ছােট ভাইয়ের ওয়াইফ যেমন ভাসুরের নাম মুখে লয় না, হেরা তেমনি মুক্তি বাহিনীর নাম মুখে আনতে পারবাে না। কি রকম একটা কুফা অবস্থা। তবে বিচ্ছুগুলার ভরভরা মাইরের ঠ্যালায় আইজ-কাইল হেগাে মুখে কথা ফুটতে শুরু করছে। হেরা অহন বাঃ বাঃ বাঃ করতে শুরু করছে। ডােজটা আর একটু বাড়লেই পুরা বাবা’ উচ্চারণ করবাে।
একটা ছােট্ট ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। বছর পনেরাে আগেকার কথা। আমাগাে | ঢাকার নাজিরা বাজারের এক রিকশাওয়ালা ফুলবাড়িয়া রেল ষ্টেশনে একটা প্যাসেঞ্জার পাইলাে। অক্করে ফুলবাবু। কানের বারান্দা থাইক্যা একটা বিড়ি বাইর কইরা জিগাইলাে, যাইবেন কই সা’ব?’ উত্তর এলাে, ‘বিশ্ববিদ্যালয়। আমাগাে রিকশাওয়ালা মাতাডা চুলকাইয়া কইলাে, ‘জমের থনে ঢাকায় আছি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কোন্হানে এইডা তাে চিনলাম না। প্যাসেঞ্জার একটু মুচকি হেসে বললাে, “চলাে তােমায় আমি দেখিয়ে দেবাে। মিনিট দশ বাদ মেডিকেলের কাছাকাছি আইতেই প্যাসেঞ্জার কইলাে, ‘আরে থামাে, থামাে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে গেছি। রিকশা থামাইয়া পহা বুইঝ্যা লইয়া আঙ্কা রিকশাওয়ালা Gentleman রে ডাইক্যা কইলাে, সাব একটা কথা কমু। লেখাপড়া হিকি নাইক্যা, কিন্তু ঢাকা টাউনের সব চিনি। আপনে যদি পয়লাই আংরেজীতে না কইয়া বাংলায় কইতেন University ত্ যামু তয় তাে পংখীরাজের মতাে কখন আপনারে এইখানে আইন্যা হাজির করতাম। যেখানে সেখানে ইংরাজিতে বিশ্ববিদ্যালয় কইবেন না। বাংলায় University কইবেন- বুঝছেন?
হের লাইগ্যাই কইছিলাম খাইছে রে খাইছে। করাচীর সান্ধ্যা দৈনিকে জব্বর খবর ছাপাইছে।

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল