৭ আগস্ট ১৯৭১
বাঘইর। বাঘইর। নাম শুইন্যা ডরাইয়েন না। এতেই একটা আওয়াজ করলাম আর কি? বচ্ছর কয়েক আগেকার কথা। একদিন সকালে ঢাকার আলুর বাজারে খাসীর গােস্ত কিনতে গেছিলাম। আমার ওয়াইপ আবার এই আলুর বাজার আর মৌলবী বাজার ছাড়া আর কোনাে বাজারের গােস্ত Like করে না। বাজারে যাইতেই সিদ্দিক বাজারের মােড়ের দেয়ালডায় একটা বিজ্ঞাপন নজরে আইলাে- লাহােরের একটা উর্দু বায়স্কোপের বিজ্ঞাপন। সাবিহা-সন্তোষ অভিনীত ‘বাপ-কা-গুনাহ।’ বার দু’ পড়লাম- না ঠিকই ল্যাহা আছে বাপ-কা-গুনাহ। তহন চিন্তা করলাম ডাহিনা মুড়া দিয়া লেখইন্যা ব্যাডাগুলা বাপ-কা-গুনাহ’র মাইদ্দে যহন তাহজীব ও তমুদুনের মানে কিনা সংস্কৃতির গন্ধ পাইছে, তহন এর পরের ছবির নাম তাে মা-কা-বদমাইশি’ ছাড়া আর কিছুই হইতে পারে না। কেমন সুন্দর মিল রইছে বাপ-কা-গুনাহ’ আর ‘মা-কা-বদমাইশি’র মধ্যে। কিন্তুক পরে এই কারবারের মাজমাডা বুঝতে পারলাম। আসলে এইডা হইতাছে ‘আইয়ুব-কা-গুনাহ’ আর ইয়াহিয়া-কা-বদমাইশি।
এই ব্যাডায় বদমায়েশ না হইলে পঞ্চান্ন পৃষ্ঠা ধইরা ছাপার অক্ষরে মিছা কথা লিখতে পারে? আবার এই পঞ্চান্ন পৃষ্ঠার চিডির লগে সাতাত্তর পৃষ্ঠা ব্যাখ্যা দিছে মানে কিনা মাইনষে চিডি লেখনের পর যেতে পুনঃ কইয়া এক আধডা লাইন লেখে, হেই রকম সেনাপতি ইয়াহিয়া পুনঃ-র কারবার হইছে সাতাত্তর পৃষ্ঠা। এইডারেই কয় বারাে হাত কাঁকুড়ের তেরাে হাত বিচি।
খত্ মানে চিডি- মানে পত্র। কত রকমের চিডি-পত্র আছে জানেন? একত্রিশ রকমের। সবগুলার নাম কওন সম্ভব না। এর মাইদ্দে পিতার পত্র, মাতার চিডি, দোস্তের খত, বসের লেটার ছাড়াও আবেদনপত্র, নিয়ােগ পত্র, ছাড়পত্র, গােপন চিঠি, হুমকি চিঠি, খােলা চিঠি রইছে। এছাড়াও রইছে- প্রেমপত্র আর শ্বেতপত্র। কিন্তুক হগুগলের শেষে রইছে বিদ্রুপত্র। এই যে একত্রিশ রকমের খত, চিঠি আর পত্র রইছে এইগুলা স্থান, কাল, পাত্র বিশেষে, রং বদলায়। যেমন ধরেন পিতার পত্র।
‘স্নেহের ফকা, তুমি আজ-কাল পড়াশুনায় ফাঁকি দিতেছাে জানিতে পারিয়া খুবই মর্মাহত হইয়াছি। এই ভাবে বাবা-মাকে কষ্ট দেওয়া তােমার উচিত হইবে না। ডট ডট। যাহা ভালাে বুঝাে তাহা করিবা। এইবার অনেক কস্টে টাকা পাঠাইলাম। ইতি-আশীর্ষবাদক আব্বা।
এবার দোস্তের খত। প্রিয় মাহবুব, জববর কারবার করেছিস। রেলওয়ে স্ট্রাইকটা বানচালের তদবির করে জেলে যাওয়ার ব্যাপারে তাের বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না। তাতে তাের নেতৃত্বও থাকলাে আবার রেলওয়ে স্ট্রাইকটাও বাচাল হলাে। এক ঢিলে দুই পাখি। কিন্তু ভাই, তুই ইলেকশনটা না করলেও পারতিস্। যাগগে, দোস্ত আজ-কাল তাে খুবই চালাচ্ছিস না। খালি একটু পাহারা নিয়ে ঘুরতে হয় এই যা। ইতি- আজিজুর রহমান বিহারী। প্রযত্নে দৈনিক ব্ল্যাক মেইল।
আর বিছু পত্র। ঠাণ্ডা মিয়া দশ টাকা পাডাইলাম। ঠিক মতন খাওয়া-দাওয়া কইরা লন। যে কোনাে টাইমে কারবার হইতে পারে। আপনার নাম কিন্তুক লিস্টির মাইদ্দে উড়ছে।’
ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারের শ্বেতপত্র আবার অদ্ভুত আর অপূর্ব ব্যাপার। মাসের পর মাস আর বছরের পর বছর ধইর্যা ছাড়া ছাড়া ভাবে যেসব মিছা কথা কওয়া হইছে, আর নিজেগাে দোষ ঢাকনের লাইগ্যা যেসব মিছা কথা কওন লাগবাে হেইগুলা সােন্দর কইর্যা ছাপাইয়া দলিল তৈরী করণের নাম শ্বেতপত্র। ক্যামন বুঝতাছেন হেগাে কারবারসারবার?
ভােমা ভােমা মছুয়া মেলেটারি গাে খাড়া কইরা থুইয়া ইয়াহিয়া সা’বের অফিসাররা ইলেকশন করলাে। ইলেকশনের টাইমে কোথাও কোনাে গণ্ডগােল হইলাে না দেইখ্যা সেনাপতি ইয়াহিয়া তার মেলেটারি জোয়ানগাে শাবাশ কইলাে। ছদর ইয়াহিয়া বাংলাদেশের ১৬৯টা সিটের মাইদ্দে ১৬৭টা দখল করণের গতিকে আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবরে ভাবী প্রধানমন্ত্রী বইল্যা ডাক দিলাে আর তো মার্চ পার্লামেন্টের সেশন ডাকলাে। এই টাইমের মধ্যে ব্যাডায় হিন্দুস্তানের কারসাজী, হিন্দুর ভােট আর ছয় দফার দেশ ভাঙ্গনের ষড়যন্ত্র কিছুই দেখতে পাইলাে না। তখন সেনাপতি ইয়াহিয়া খালি বঙ্গবন্ধুরে- আরে তেল-রে-তেল। যদি শেখ সা’বরে পেরধান মন্ত্রীর টোপ ফালাইয়া । বড়শিতে গাথা যায়। মানে কিনা ছয় দফারে একটু বদলানাে যায়।
কিন্তু বহু রকমের চেষ্টা চরিত কইরাও যহন দেখলাে হাড্ডি। শেরে বাংলা আর সােহরাওয়ার্দী সাব যে চরকি-বাজীর মাইদ্দে পড়ছিল এইডা বড় শক্ত এইডা তার ধার কাছ দিয়াও নাইক্যা, তখন লারকানায় আল মােরতাজায় বইস্যা ইয়াহিয়া-হামিদ-ভুট্টো এক ঘরে রাইত কাটাইয়া ষড়যন্ত্র করলাে। ব্যস, কথা নাই, বার্তা নাই, পহেলা মার্চ ইয়াহিয়া সাব পার্লামেন্টের অধিবেশন অনির্দিষ্ট টাইমের জন্যি পিছিয়ে দিলাে। বাংলাদেশের মানুষ অক্করে থ’ মাইরা গেল। কেইসটা কি? শেখ সাহেবের আওয়াজে শুরু হলাে অসহযােগ আন্দোলন ৩রা মার্চ থাইক্যা ২৫শে মার্চ পর্যন্ত। বাংলাদেশে নতুন History হইলাে। বাঙালিরা দেখাইয়া দিলাে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কারে কয়।
১৩ই মার্চ সেনাপতি ইয়াহিয়া ঢাকায় আইলেন। আওয়ামী লীগ আর বাঙালিগাে তিনি কোনাে কসুরই দেখতে পাইলেন না। আইজ যারে রাষ্ট্রদোহী’ কইতাছেন তার লগে দিনের পর দিন ধইরা আলাপ করলেন। পরায় দিনই আলাপের শেষে শেখ সাবের ঢাকায় প্রেসিডেন্ট হাউসের গেট পর্যন্ত আউগাইয়া দিলেন। মওলবী সা’ব কোনােই গড়বড় কারবার দেখতে পাইলেন না। হেই সময়কার পাকিস্তান অবজার্ভার-মর্নিং নিউজ খুললেই প্রমাণ হইবাে। ইয়াহিয়া-ভুট্টোর একটা Statement-এও অবাঙালি হত্যার কথা নাইক্যা। হেরপর হেতনরা ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ঢাকার বুকে বইস্যা মুরগির রান খাইলেন। আর বাঙালি হত্যার ষড়যন্ত্র করলেন।
২৫শা’র রাত থাইক্যা আকা হামলা দিয়া দশ লাখ বাঙালি মার্ডার করনের পর অহন শ্বেত-পত্রে কইতাছে পহেলা মার্চ থাইক্যা ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অনেক অবাঙালি হত্যা করণের গতিকেই নাকি মেলেটারি নামাইছে। ক্যামন বুঝতাছেন? মিছা কথা কইতে কইতে যহন দেখছে যে, মহিষের মুখের মধ্যে যেই রকম ফেনা উঠে হেগাে মুখের গাইলস্যার মাইদ্দে হেই রকম ফেনা উঠছে তখন হেইগুলা অক্করে ঝকঝকে অক্ষরে ছাপাইয়া ফেলাইছে।
কিন্তু বিবিসির ইস্টার্ন সার্ভিসের মিঃ মার্ক টালী তার বেতার ভাষ্যে সেনাপতি ইয়াহিয়ারে আহা-রে হেকিম কবিরাজেরা যেমতে কইরা হামান দিস্তার মধ্যে অষুধ বানায়। হেমতে কইর্যা থেতলাইছে। হেতনে দুইডা মাত্র কথা কইছুইন- পয়লা ‘এই শ্বেতপত্রের মাইদ্দে বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানের মেলেটারিগাে বীভৎস হত্যাকাণ্ডের কোনােই কথা নাইক্যা- অথচ এইডাই হইতাছে মানব জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যা। আর ইয়াহিয়া সা’ব যখন ১৯৬৭ সাল থাইক্যাই জানতেনই যে শেখ মুজিবুর রহমান। ইন্ডিয়ার লগে ষড়যন্ত্র করতাছে, তখন হেরে ইলেকশনই বা করতে দিলাে কেন আর। পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী বইল্যা ডাক দিয়া মার্চ মাসে দিনের পর দিন ধইর্যা গুফতাগু মানে কিনা বাতচিতই বা করলাে কেন? আংরেজের বাচ্চায় ঠিক মছুয়াগাে রগ চিইন্যা ফেলাইছে। এইডাতাে শ্বেতপত্র না, এইডা হইতাছে ভােগাচ-পত্র- ফস কারবার।
হেইর লাইগ্যাই চিল্লাইছিলাম- বাঘইর! বাঘইর! সেনাপতি ইয়াহিয়ারে অহন বাঘইরে পাইছে।
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল