You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.07 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

আইজ কেন জানি না বার বার কইর‌্যা মেরহামত মিয়ার কথা মনে পড়তাছে। বছর চব্বিশ আগেকার কথা। মেহামত মিয়া তহন কিন্তুক আইজগার মতন এতাে চালু হয় নাইক্যা। আমাগাে বকশি বাজারের ছক্কু মিয়ার পাল্লায় পইড়াই তাে’ এই মেহামত মিয়া সংসারের হগল তেলেসমাতি কারবার হিক্কা ফেলাইছে। চব্বিশ বছর আগে মেরহামত মিয়া যেদিন নরসিংদীর থনে পয়লা চক বাজারের আলহামরা হােডেলডার মাইদ্দে খাইতে আইলাে, হেইদিন ছকু হের পেরেমে পড়লাে, মানে কিনা দুইজনের মাইদ্দে দোস্তালী হইলাে। উর্দু রােডের ধূলা ভাইঙ্গা আলহামরায় আইস্যা ছক্কু মিয়া একটা সিঙ্গেল চা খাইতাছিল। এমন সময় একজন গেরামের পােলা নীল তফন পিইল্যা পাশের খালি টেবিলডার মাইদ্দে বইলাে। ব্যাডায় বয়রে ডাইক্যা জিগাইলাে, খাওনের কি আছে’, লগে লগে বিয়াল্লিশ বছরের বয়ডা হড় হড় কইর‌্যা খাওয়ার লিস্টি কইলাে, গেরামের ব্যাডায় একটু Think কইর‌্যা কইলাে “ঠিক আছে, ভাতের লগে কি কয় পটাটো ইসম্যাশ, অমলেট, কারী আর সালাত দাও।
টেবিলের মধ্যে খাবারগুলা সাজাইয়া দেওয়ার পর ছক্ক দ্যাহে কি? গেরামের পােলাড়া গামছা দিয়া গতরের ঘাম মুইছা টেবিলের ভাত তরকারীর দিকে তাকাইয়া নিজে নিজেই কথা কইতাছে। ছক্কু মিয়া কানডা একটু খাড়া কইর‌্যা হােনে কি? ব্যাডায় কইতাছে- বুঝছি, দুনিয়া নামের মাইদ্দেই চলতাছে। নামে বহুত কিছু আসে যায়। ব্যাডা তরকারী- তুমি ঢাকা টাউনে আইস্যা Short cut-এ কারী হইয়া গেছে। ও-ওবাবা আমাগাে পিয়াজ শহরে তােমার নতুন নাম হইছে স্যা-স্যা-স্যালাত- আল্লাহরে এইটা কি? আলু ভরতা- তােমার দেখতাছি ডবল প্রমােশন- তুমি এলায় পট্যাটো ইসম্যাশ হইছাে।
ছক্কু মিয়া একটা গুঠিয়া বিড়ি ধরাইয়া আস্তে কইর‌্যা আইস্যা এই টেবিলে বইলাে। মুখ দিয়া একগাদা ধূয়া বাইর কইর‌্যা কইলাে, মনে হইতাছে নতুন আমদানী। রংবাজীর দেখছেন কি? পাকিস্তান হওনে চাইরদিকে খালি ম্যাজিক কারবার চলতাছে। বুঝছেন, হেইদিন উয়ারীতে গেছিলাম। দেহি কি দশ নম্বর র্যাংকিন স্ত্রীষ্টের মাইদ্দে বহুত গ্যানজাম। শশালার হ্যাট মাথায় এক ল্যাড় ল্যাড়া বুড়া চিল্লাইতাছে, এইখানে কি কুস্টের মল্লিক ডাক্তার আছে?’ পান চিবাইতে চিবাইতে একজন লেংডা জেনটেলম্যান কইলাে না-এখানে মল্লিক ডাক্তার বলে কেউ থাকেন না। লগে লগে ল্যাড় ল্যড়া বুড়া কি রাগ? চিল্লাইয়া কইলাে, আমার নাম ব্রিটিশ, আমি মিনসের চৌদ্দ পুরুষকে চিনি। বেটার ছেলে কি আবার নাম বদলিয়েছে নাকি? আমার টাকা চাই-ই, চাই। আমি ওকে খুঁজে বের করবােই।
এইবার লেংডা জেনটেলম্যান-এ ফচ্ছৎ কইর‌্যা হাইস্যা কইলাে, তা হলে ঠিক ধরেছেন। উনাকে এখানে সবাই মালেক ডাক্তার বলে জানে।’ কথা নাই, বার্তা নাই, হেই ল্যাড় লেড়া বুড়ায় রাস্তার পাশে বইস্যা পড়লাে। চাইরদিকে বহু লােক জইম্যা গেল। এলায় ব্রিটিশ করলে কি এই দ্যাখেন বইল্যা হাঁ কইর‌্যা হগ্গলরে দেখাইলাে, তার মুখে। একটাও দাঁত লাইক্যা। পয়লা ভালাে বাংলায় ডাক্তার সাবের চৌদ্দ পুরুষ Upward আর downward ধােলাই কইর‌্যা যা কইলাে, হের থাইক্যা বুঝলাম কারবার খুবই খতনাক হইয়া গেছে। এই বুড়ার মুখে দুইটা মাত্র দাঁত আছিলাে একটা শক্ত, আরেকটা তিন বছর ধইর্যা ল্যাড় ল্যাড় করতাছিল।
বুড়ার কপাল খারাপ বইল্যা কুষ্টিয়ার থনে কইলকাত্তায় যাইয়া এই মল্লিক ডাক্তারের পাল্লায় পড়ছিল। ল্যাললেড়া দাঁতটাতে খুবই বিষ হওনের গতিকে এই ডাক্তাররে দেখাইলাে। ডাক্তার সা’বে কইলাে, এই দাঁত ফালাইতে হইবাে- বিশ টেকা লাগবাে।
ব্রিটিশ টেকা দিয়া দাঁত ফালাইবার জন্যি চেয়ারের মধ্যে বইলাে। যহন কারবার শ্যাষ হইলাে তহন বুড়ায় দ্যাহে কি মুখের মাইদ্দে ল্যাড় লেড়া দাঁতটাই রইয়া গেছে আর মল্লিক ডাক্তার শক্ত দাঁতটারেই উড়াইয়া ফালাইছে। তারপর এই ব্যাপারে একটা ফাটাফাটি কারবার হওনের আগেই পাকিস্তান হইয়া গেছেগা। আর পাখি উড়াল দিয়া কইলকাত্তা থাইক্যা নাম বদলাইয়া ঢাকার দশ নম্বর ব্যাংকিন স্ট্রীটে মেচের মাইদ্দে উঠছে। এইদিকে বুড়াও ছাড়ইন্যা পাত্র না। বহু খোজ-খবর কইর‌্যা এই পাশকা। ডাক্তারের খবর পাওনের আগেই বুড়ার লড়বড় করা দাঁতটা এমতেই পইড়া গেছে। বুড়ায় অক্করে পুরা ফোকলা হইয় গেছেগা। এলায় বুঝছেন? চাইরদিকে কেমন ম্যাজিক কারবার চলতাছে? অবশ্যি হেই ডাক্তার মালেইক্যা আর ডাক্তারি করে নাইক্যা।
হ-অ-অ এই দিক্কার কারবার হুনছেন নি? সা’বে কইছে কিসের ভাই, আহাদের আর সীমা নাই। ইয়াহিয়া খান সাবের চাচা মানে কিনা শ্যাম চাচা নাকি বলেছেন, বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার শাসন ব্যবস্থা বেসামরিক কর্তৃক্ষের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে, এই রকম একটা ভােগাচ কারবার না করতে পারলে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আগামী বৈঠকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জঙ্গী সরকাররে অক্করে তক্তা বানাইবাে। মুক্তি বাহিনীর বিষ্টুগুলা দখলীকৃত এলাকায় ইচ্ছামতাে কারবার চালাইলেও একটা পুরা Risk লইয়া রক্তমাখা বালিশটারে একটা ছাফ গিলাপের মাইদ্দে ঢুকাইয়া দুনিয়ার মাইনষেরে ভােগা মারণ লাগবাে। ময়মনসিংহের কাচারীর বটতলার থনে যেমতে আইয়ুব খান মােনাইম্যারে খুঁইজ্যা বাইর করছিলাে,হেই রকম ইয়াহিয়া সা’ব বহু হাউ কাউ কইর‌্যা ডাক্তার মল্লিকরে থুরি ডাক্তার মালেকারে আবিষ্কার কইর‌্যা ফাল পাড়তাছে। ‘মিল গিয়া, মিল গিয়া, উদা দালাল মিল গিয়া- ইয়ে চিজ চওবিশ সালকা আন্দার কই। ইলেকশনভি নেই কিয়া। ইয়ে হরিবল হক সে ভি আচ্ছা মাল হ্যায়।’
ক্যামন বুঝতাছেন হেগাে কারবার-সারবার? কিসে নাই চাম- রাধা কেষ্ট নাম। বিবিসির সংবাদদাতা মার্টিন বেল যখন বাংলাদেশের মুক্ত এলাকা সফর কইর‌্যা বিবিসি টেলিভিশনে পিকচার দেখাইতাছে যে মুক্তি বাহিনীর বিক্ষুগুলার গাবুর মাইরের চোটে ভােমা ভােমা মছুয়া সােলজারগুলা খালি আন্ধা গােন্ধা ভাগতাছে আর মুক্ত এলাকায় দিব্বি বাজার হাট চলতাছে, তখন একই দিনে আর একই টাইমে কলিম উদ্দিন সা’বে সরি ইয়াহিয়া সা’বে কি-ই-ই সােন্দর চতুর্থবার ঘােষণা করছুইন, জনা কয়েক ছাড়া আমি হগ্গল বাঙালিরেই মাফ কইরা দিছি। ব্যাডা একখান। রাজাকার তৈরী করণের লাইগ্যা, চোর-ডাকাত-ছাচ্চোড় হগুগলরে জেলখানা থাইক্যা ছাইড়া দিয়া ব্যাডা কইতাছে সব ছাইড়া দিছি, কিন্তু আসল গুলারে আটকাইয়া থুইয়া হেতেনে ভাবতাছে- তার এই ঘােষণায় দুনিয়ার মাইনষে ভাববাে যে বাংলাদেশের অবস্থা অক্করে কন্ট্রোলের মাইদ্দে আইস্যা গেছে আর কি? হাঃ অ্যাঃ অ্যাঃ কন্ট্রোলের মাইদ্দে আইতাছে ঠিকই। তবে এই কন্ট্রোলগুলার নাম হইতাছে ছক্কু অক্করে ফাল পাইড়া উঠলাে- আমি কমু? আমি কমু? এইগুলার নাম হইতাছে বিক্ষু-মুক্তি বাহিনীর বিচ্ছু ভাগছে, ভাগছে। এইগুলার গাবুর মাইরের চোটে টিক্কা সা’বে তার ধ্বচা মারা সােলজারগুলার বাংলাদেশের ক্যাদোর মাইদ্দে হান্দাইয়া দিয়া ভাগছে।
আর দখলীকৃত এলাকা সফরের কথা হুনলেই সেনাপতি ইয়াহিয়ার কাপড় অক্করে বাসন্তী Colour হইয়া যাইতাছে। পাঁচ মাসেও ব্যাডায় একবার…। তবুও ব্যাডায় ট্রিকসের পর ট্রিক্স করতাছে। আগার বদলে আগা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামাবাদের রাষ্ট্রদূত আগা হিলালীর বদলে এইবার মেজর জেনারেল নবাবজাদা আগা মােহাম্মদ রাজারে পাঠাইতাছেন। এই দিকে ব্যায় করছে কি? বাঙালি কূটনীতিবিদরা যাতে কইর‌্যা বাংলাদেশ সরকারের লগে আর যােগ দিতে না পারে, হের লাইগ্যা বাকি হগলের পাসপোের্ট আটকাইছে।
বিচ্ছুগুলার কারবার যতই বাড়ছে, ততই ইয়াহিয়া সা’বে পাগলা হইয়া উঠতাছে । হেই লাইগ্যা ইংলন্ডের মাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান কাগজ মন্তব্য করছে, ‘ইয়াহিয়া খানের একটাই মাত্র কৃতিত্ব পাকিস্তান নামে দেশটারে ধ্বংস করা। কিন্তু আমি কই কি? ব্যাডার আরেকটা Credit রইছে। হেইডা হইতাছে বহুত তেল-পানি খরচ কইর‌্যা পিআইএ বিমানে তিন হাজার মাইল ঘুইর্যা লাখ খানেক মুছয়া সােলজাররে অক্করে বিচ্ছুগুলার কোলে আইন্যা বইছে। তারপর আরে মাইর-রে-মাইর।

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল