You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.22 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

২২ জুলাই ১৯৭১

এলায় সেনাপতি ইয়াহিয়ার পালা। টিক্কা সা’বে কইছে তিনটা কামের দুইডা কাম হে কইর‌্যা হেলাইছে। অহন খালি তিন নম্বর কামডা ইয়াহিয়া সা’বের লাইগ্যা রাখছে। যেই সব মাইনষের হাতে কোনাে অস্ত্রপাতি নাইক্যা আর যারা ছা-পােষা মানুষ, তাগাে বেশুমার মার্ডার আর দেশ থাইক্যা খ্যাদানাের কাম দুইডা টিক্কা সা’ব চাইর মাস ধইর্যা করতাছে। অহন বাকি রইছে মাত্র একটা কাম- হেইডা হইতাছে মুক্তিবাহিনীর বিচ্ছুগুলারে খতম করণ। তাহলেই কেল্লা ফতেহ্। খালি এই সামান্য কার্ড টিক্কা সা’বে একটা ছিক্রেট চিঠি লিইখ্যা, আয় মেরে জান, পেয়ারে দামান, নূরে চামান, আসমান কি চাঁদ, আঁখাে কি তারা পেয়ারে জেনারেল আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান খামখা-এপাকিস্তানরে করতে হইছে। আহহা আপনাগাে লইয়্যা মহামুস্কিল। সব ব্যাপারেই একটা মেছাল দিয়া না কইলে ঠিক মতন আন্তাজ করতে পারেন না।
তয় কই হােনেন। আমাগাে গেরামে মওলানা মােনতাসির রহমান রহমানী বইল্যা একজন মওলবী সা’ব আছিলাে। মুরিদানগাে বাড়ির থনে মুরগি, লাউ, কুমড়া, আণ্ডা-এই সব আননের জন্যি মওলবী সা’ব আবার ছাইকেলে কইর‌্যা ঘােরাফিরা করতাে। কি কইলেন, ছাইকেল-মওলবী? হ-অ তাও কইতে পারেন। হেই-ই মওলবী সা’ব একদিন তার সাগরেদ ছক্কু মিয়রে লইয়্যা এক মুরিদের কাচারী ঘরের মাইদ্দে হুইত্যা আছে। অনেক দিন ধইরা আধা-পেডা থাকনের পর ছক্ক এই ছাইকেল-মওলবীর সাগরেদ হইছে। মওলবী সা’ব তারে খাওন দেয় বটে, কিন্তু খুবইকাম করায়। রাইত তহন পরায় বারােটা। ছক্কু আবার একবার হুতলে আর উড়তে চায় না। ছক্কর চোখ দুইডা কেবল একটুক লাইগ্যা আইছে; অমতেই মওলবী সা’বে কইলাে, আরে এই ছক্কু মিয়া, যেমন লাগে বাইরে বারিষ আইলাে? ছকু চকির মাইদ্দে পাশ ফিইর্যা কইলাে, আরে না-না হুজুর, অখখনেই আমাগাে বিল্লিটা ঘরের মাইদ্দে হান্দাইছে। বিল্লির গতর হুগনা দেখছি।আবার দশ-পনেরাে মিনিট বাদ কেবল ছক্কর চোখের মাইদ্দে নিন আইছে, আর মওলবী সা’ব কইলাে, আরে এই ছক্কু মিয়া, কেরাসিনের বাত্তিডা নিবাইলা না?’ ছক্ক দেখলাে মহামুস্কিল- এই মওলবী সা’বে তাে ঘুমাইতে দিবাে না। তাই হুইত্যা থাইক্যা বুদ্ধি কইর‌্যা কইলাে, হুজুর চক্ষু বন্ধ কইরা হুইত্যা থাকেন- তয়বুঝবেন বাত্তি নিইব্যা গ্যাছে। আর দুনিয়া-আসমান তামাম আন্ধার।
হের পর ছক্কু মিয়া ঘুমাইয়া গ্যালাে গা। কিন্তু আঙ্কা মওলবী সাবের চিল্লাচিল্লিতে ছকুর ঘুম ভাইঙ্গা গ্যালাে। দ্যাহে কি, জোর বারিষ আইছে আর টিনের চালের মাইদ্দে ঝমিঝম্ কইর‌্যা পানির আওয়াজ হইতাছে। ছাইকেল-মওলবী চিল্লাইয়া কইলাে, ছক্ক মিয়া, আমার কিস্তি টুপিডা যে বাইরে উডানের মাইদ্দে রইছে- হেইডা তাে ভিইজ্যা গেল। এলায় ছকু দেখলাে মহামুসিবত। এইবার তাে উডন লাগবােই না হইলে তাড়াতাড়ি একটা বুদ্ধি বাইর করণ লাগবাে। ভট কইর‌্যা কইয়্যা হেলাইলাে, হুজুর, আইজ রাইতে আনে আমারে তিনডা কাম দিছিলেন, হের মাইদ্দে দুইডা আমি কইর‌্যা হেলাইছি। অহন এই তিন নম্বর কামডা আপনের লাইগ্যা রাখছি। ক্যামন বুঝছেন। টিক্কা সা’বে তিন নম্বর কাড়া সেনাপতি ইয়াহিয়ার লাইগ্যা রাখছে।
খুবই সােজা কাম। বাংলাদেশের ঝােপ-ঝাড়, ক্যাদো-পানি আর জঙ্গলের মাইদ্দে থনে এইসব মুক্তি বাহিনীর পােলাগুলারে খতম্ করতে হইবাে। এইডা তাে জঙ্গী সরকারের কাছে অক্করে পানি-পানি। তাগাে সােলজাররা তাে দুনিয়ার মাইদ্দে Best! একবার কচ্ছের রানে যাইয়্যা রান খােয়াইছিল, আর একবার হাজী পীর পাস দিয়া হাজার চল্লিশেক কম্যান্ডাে পাডাইছিল- ৩৫ হাজার লাপাত্তা আর খােদ হাজী পীর পাস হাতছাড়া। হের পর মাত্র সতেরাে দিনের একটা লড়াই করছিল। হেই সময় হেরা সব বীরের মতাে লাহাের থাইক্যা ভাগােয়া। ভাগ্যিস বেঙ্গল রেজিমেন্ট হেই সময় লাহােরে। আছিলাে, আর এয়ার ফোর্সের বাঙালি পাইলটগুলা Action করছিল।
হের পরেও রাওয়ালপিন্ডির হেই সময়কার আব্বাজান আইয়ুব খান আর তাঁর পােষ্যপুত্র ভুট্টো সা’ব অক্করে দৌড় দিয়া তাসখন্দে যাইয়্যা দম ফেলাইলাে। আর এইবার! বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেই সব পােলাগুলা মুক্তিবাহিনীতে গেরিলা হইছে আর বাঙালি পাইলটগুলাের Action নাইক্যা। হের মাইদ্দে আবার এতােদিন ধইর্যা না-না বাহানায় যেসব বাঙালি জোয়ানগাে মেলেটারিতে Refuse করছিলাে, তারা হাজারে হাজার অহন গেরিলা ট্রেনিং লইয়া ময়দানে নামছে। মুক্তি বাহিনীর এইসব পােলাগুলা আবার ক্যাদো পানির মাইদ্দে খেইলটা পছন্দ করে। বড়শির মাইদ্দে মাছ গাথনের পর যেমন অনেকক্ষণ ধইর্যা পানির মাইদ্দে ‘খেইল’ কইর‌্যা হ্যাচকা টানে তুলতে হয়। মুক্তি বাহিনীর বিক্ষুগুলা অহন মােছওয়ালা ব্যাডাগাে লইয়্যা হেই রকম একটা কারবার করতাছে। ভােমা ভােমা সােলজারগাে মারতে কি আরাম রে?
এই ধরেন সিলেট-কুমিল্লা। অক্করে One way traffic.কুর্মিটোলা-ময়নামতী ক্যান্টনমেন্ট থাইক্যা যে সব হানাদার সৈন্য একবার এই রাস্তা দিয়া যাইতাছে তারা আর ফেরৎ আহনের নাম লইতাছে না। হেই সব এলাকায় সােজা যাইয়্যা হুইত্যা পড়তাছে। কি আর কমু! জেনারেল নিয়াজী আবার এই সব সােলজারগাে Missing List-এ রাখছে। এই দিকে আজরাইল ফেরেশতা অক্করে তাজ্জব বইন্যা গ্যাছেগা। হিসাব কইর‌্যা দেহে কি? তার Under-এই অহন এক ডিভিশন হইয়্যা গ্যাছেগা। আরও দেড় ডিভিশন জয়েন করণের লাইগ্যা ব্যান্ডেজ বাইন্ধ্যা কাতরাইতেছে। হেই জন্যেই কইছিলাম সিলেট-কুমিল্লা অহন মরণ ফাঁদ অইছে। হেইখানে অহন প্লেন থাইক্যা হ্যান্ডবিল ফ্যালাইলে আর কাম অইবাে না।
গেল জুম্মায় দিনের বেলায় সিলেট টাউনের মাইদ্দে কারবার অইছে। আর হানাদার বাহিনীর একজন লেঃ কর্ণেল তার দলবল লইয়্যা হেইদ্দিনে ছাতক যাইতাছিল। ব্যস, গেরিলারা হেগাে ছাতু বানাইছে। সিলেটের বড়লেখা আর দিলখুস এলাকায় ক্যাম্তে জানি দিলখুস ব্যাপার হইছে। মানে কিনা হেগাে বাইশজন আইছিল। ভাইগােয়াট আর জমি একজনও হয় নাইক্যা। স-অ-ব ফতে আলী হইছে। চাপাইনওয়াবগঞ্জরাজশাহীর আমবাগানে অহন লুকাচুরি খেইল হইতাছে। যশােরে একদিনে পাঁচ জায়গায় হেরা ক্যাকা মাইর খাইছে। আইজ-কাইল রাইত-বিরাইতে হেগাে বাইরাইন পরায় বন্ধ। রংপুরের ভুরুঙ্গামারীতে হাম ইডা কি করছিনু রে! হামি ক্যা নানীর বাড়ী আচিনু? এইরকম আওয়াজ আইতাছে। কিশােরগঞ্জ আর মাদারীপুরেও অহন ফুটফাট শব্দ হইতাছে। আর ঢাকা টাউনে তাে এইটাই Normal ব্যাপার।
এই রকম একটা অবস্থায় টিক্কা সা’বে তিন নম্বর কান্ডা সেনাপতি ইয়াহিয়ারে করতে কইছে। এলায় বুঝছেন, ছাইকেল- মওলবী আর ছক্কু মিয়ার মেছালডা কি রকম।

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল