You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.25 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

২৫ জুলাই ১৯৭১

বার বার তিনবার। সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকার এর মধ্যেই ব্রিটেনরে তিন তিনবার হুশিয়ারী দেওন সত্ত্বেও কোনাে কাম হয় নাই দেইখ্যা ডর দেখাইছেন। ইয়াহিয়া সাবের একজন অফিসার কইছে, এই রকম কারবার যদি চলতে থাকে তয় আমরা তালাক লমু? মানে কিনা এতাে দিনের সংসার ভাইঙ্গ্যা কমনওয়েলথ থনে বারাইয়া আমু। আর এই যন্ত্রণা সহ্য হয় না। ব্রিটেনের মিনিস্টার আমাগাে যা ইচ্ছা তাই গালি দিছে, পার্লামেন্টের মেম্বররা ডেঞ্জারাস কথা কইয়া রিফিউজি ফেরৎ আহনের রাস্তা বন্ধ করছে আর খবরের কাগজের মাইদ্দে আমাগাে নাঙ্গা ফডাে ছাপাইছে। বারবার কইর‌্যা আংরেজগাে কইলাম আমাগাে লগে মহব্বত ঠিক রাখতে অইলে বিবিসিরে সামলাও, খবরের কাগজগুলারে কন্ট্রোল করাে আর পার্লামেন্টের মেম্বারগাে একটুক কথাবার্তা কম কইতে কও। নাহ্। হেরা বলে ডেমােক্রেসি করছে। আবার হের উপর মাল-পানি, মানে কিনা খােরপােষ দেওনও বন্ধ করছে। তয় তাে খেইল খতম, পয়সা হজম।
ইসলামাবাদের একজন মুখপাত্র বলেছেন যে, ব্রিটেনের দেখাদেখি কমনওয়েলথের অন্যান্য সদস্যরাও সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকারের কার্যকলাপের ব্যাপারে এমন সব কথাবার্তা বলেছেন যেইডা Internal ব্যাপারে নাক গলানাে ছাড়া আর কিছুই না। হগুগলের শ্যাষে কানাডা আর অস্ট্রেলিয়া হেগাে সেঁকীর মাইদ্দে ফালাইয়া পাড় দিয়া মাস কালাই-এর ডাইল বানাইছে। এরপর তালাক লওন ছাড়া পাকিস্তানের আর কোনাে রাস্তাই খােলা নাইক্যা। কবে না জানি ইডিয়ট’ কইয়্যা গাইল দ্যায়- হেগাে আবার একটু Prestige আছে কিনা?
এদিকে দম মওলা কাদের মওলা হয়ে গেছে। বিশ্ব ব্যাংক ও এইড ফর ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সিজ-এর পরামর্শদাতা এবং পাকিস্তান সরকারের প্রাক্তন উপদেষ্টা ও হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মিঃ রবার্ট ডর্ফম্যান বলেছেন, যেভাবে পাকিস্তানে কারবার চলছে তাতে করে আগস্ট মাসের শেষ নাগাদ সেখানকার সরকারের পেট্রোল আর খুচরা যন্ত্রপাতি পর্যন্ত কিনবার পয়সা থাকবে না। এলায়, বুঝছেন। ব্যাপারটা? বিদেশ থনে মাল-পানি না পাইলে ইয়াহিয়া সা’বের পজিশন কি অবস্থায় দাড়াইবাে? লালবাত্তি চিনছুইন- হেই লালবাত্তি জ্বালাইবাে।
সিনেটর এডােয়ার্ড কেনেডী বলেছেন, পূর্ব বাংলায় মানুষ হত্যার জন্য প্রকারান্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই দায়ী। নিরপেক্ষতার ভান করে আগের মতােই পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়ার অর্থই হচ্ছে হত্যার ইন্ধন যােগানাে। মার্কিনী অস্ত্রশস্ত্র পূর্ব বাংলার নিধনযজ্ঞে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের ঘটনা আর আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়। অবশ্যি আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে আখ্যায়িত করতে হলে এটাকে সমগ্র মানব জাতির আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলতে হয়। | এদিকে বিশ্ব ব্যাংকে এক চমৎকার ঘটনা ঘটে গেছে। ব্যাংকের একজন ডিরেকটর। পিটার কারঘিল পশ্চিম পাকিস্তান আর বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা সফর করণের পর। যে রিপাের্ট দিছেন তাতেই ইসলামাবাদের বারােটা বাজছে। Aid Pakistan Consortium সেনাপতি ইয়াহিয়ারে ধারকর্জ সমস্ত বন্ধ কইরা দিছে। আহা! ব্যাডায় কি কান্দন! অক্করে ঘং ঘং কইর‌্যা আওয়াজ হইলাে। অহন আবার কারঘিল সাবের হেই রিপাের্ট ছাপাইয়া বিশ্ব ব্যাংকের হগল ডিরেক্টরগাে মাইদ্দে বিলি করা হইতাছে। ইয়াহিয়া সরকারের কাঁউ-কাউয়ানির চোটে বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা কারঘিল সা’বের রিপাের্ট চাপি করণের অর্ডার দিছিলাে। কিন্তু যখনই ম্যাকনামারা সা’ব টের পাইলাে যে, ওয়াশিংটন পােস্ট কাগজে এই রিপাের্ট ছাপা হইবাে, তক্ষুনি রিপাের্টের কপি ডিরেকটরগাে বাড়ি বাড়ি দেওনের অর্ডার দিলাে।
ক্যামন বুঝতাছেন? হেই সব দ্যাশে খবরের কাগজের চোটটা কেমন? কারঘিল সা’ব রিপাের্টে লিখছে, ‘এ্যাটম বােমা ফেলনের পর হিরােশিমা আর নাগাসাকির শহরের যে অবস্থা হইছিলাে, পূর্ব বাংলায় এখন এই রকম একটা অবস্থা চলতাছে। টাউনগুলার মাইদ্দে শতকরা দশজন লােকও নাইক্যা। পশ্চিম পাকিস্তানী সােলজারগাে বেশুমার বাঙালি মার্ডারের গতিকেই এই অবস্থা হইছে। হেইখানে ট্রেন চলতাছে না। রাস্তাঘাট খাল হইয়্যা গ্যাছে, মিল-ফ্যাক্টরি একরকম বন্ধ আর রফতানীর অবস্থা কুফা। আবার এইদিকে শুরু হইছে ক্যাচকা মাইর। তাই নতুন ধার-কর্জ তাে দূরের কথা আগের পয়সাই পাওনের চান্স নাইক্যা। ব্যাস্- বিশ্ব ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, পশ্চিম জার্মানি, জাপান, কানাডা, ফ্রান্স তার ইটালির থনে বেসরকারি খাতে হগুগল রকমের মাল-পানি বন্ধ হইলাে। তবুও এম.এম. আহম্মকটা ফাল্ পাড়তাছে কুয়েত, বাহরায়েন, ইরান আমাগাে পয়সা দিবাে। ব্যাডার মাথায় এতাে বুদ্ধি যে, রাইতে তার ঘুম হইতাছে না।
কাম সারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি এ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব স্টেট মিঃ রজার ডেভিস বলেছেন যে, পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার অবস্থা খুবই শােচনীয়। আর ধারকর্জ শােধ দ্যাওনের ক্ষ্যামতা নাইক্যা। শ্রমিকদের খুঁইজ্যা পাওন যাইতাছে না বইল্যা পূর্ব বাংলায় মিল-ফ্যাক্টরী আর ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ।’ ডেভিস সা’বে এইটুকু বইল্যা ক্ষ্যান্ত হইলে সেনাপতি ইয়াহিয়া সা’বে কোনাে Mind করতাে না। কিন্তুক রজার ডেভিস সা’ব একটা ছিক্রেট কথা কইয়া ফেলাইছেন। তিনি বলেছেন, পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর মধ্যে হতাহতের সংখ্যা খুবই বাইড়া গ্যাছে। সাড়ে তিনমাস ফাটাফাটি হওনের পর এই পয়লা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবর্ণমেন্ট আন্দাজ করতে পারছেন যে, সতেরাে বছর ধইর্যা খাওয়াইয়্যা World-এর যে Best পাইটিং সােলজার হেরা তৈরী করছিল আর যাগাে চোপার কাছে পর্যন্ত যাওন যাইতাে না, হেইসব সােলজাররা বিক্ষুর লাহাল পােলাগুলার বাড়ির চোটে বাংলাদেশের ক্যাদোর মাইদ্দে হুইত্যা পড়তাছে। আমেরিকান। গবর্ণমেন্টের অফিসাররা এই রিপাের্ট পাইয়া অহন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতাছে।
কিন্তু বুঝতে বহুত লেট কইর‌্যা ফেলাইছেন। এর মাইদ্দেই গাং-এ ঢল নামছে। অহন তাে বাংলাদেশের মাইদ্দে আচম্বিত ব্যাপার ঘটছে। কুমিল্লা-নােয়াখালী-ফেনীর হেইদিকে গেরিলাগাে মাইরের চোটে হানাদার সােলজাররা আর কান্দনের টাইম পর্যন্ত পাইতাছে না। হােতনের লগে লগে শ্যাষ। কুমিল্লা-ফেনীর রাস্তা গায়েব। আইজ-কাইল ইয়াহিয়া সাবের সােলজাররা কাঁচা রাস্তা দিয়া যাতায়াত করনের Try করতাছে। কিন্তু মাইন, ডিনামাইট আর Hand Grenade-এর খালি আচম্বিত কারবার চলতাছে। বাঙালির মাইর দুনিয়ার বাইর।
এই দিকে মেহেরপুরে জব্বর খবর হইচে। এর মানে বুঝতে পারতাছেন? ধাওয়ানী। ধাওয়ানী কারে কয়- মেহেরপুরের ফাইট না দেখলে বুঝতে পারবেন না। আরে ধাওয়ানী রে, ধাওয়ানী। টিক্কা সা’বের সােলজাররা সব ফালাইয়া দৌড়। এক ধাওয়ানীতে মেহেরপুর Clear. অহন চুয়াডাঙ্গার ছয় মাইল দূরে তুফান ফাইট শুরু হইছে। এইখানে ননীদত্ত, জাগতি ব্রিজ আর রেলস্টেশন গুড়া। আলম ডাঙ্গা থানা আর চেনন যায় না। দর্শনা থনে হানাদার ফৌজ ভাগােয়াটা সুগার মিল অহন মুক্তি বাহিনীর Control-এ। ট্রেনিং Complete হওনের পর অহন হাজারে হাজার মুক্তি বাহিনী ময়দানে নামছে। আর দিনা দুইয়ের মাইদ্দেই চুয়াডাঙ্গার কাম ফতে হইবাে। হ-অ-অ, রংপুরের কথাতাে কই-ই নাই। সেটি এখন চ্যাঙ্গু-পাণ্টি খেলা হচ্ছেরে। ধরলা নদীর ধার খালি ক্যামা কোবানী। এতাে কইর‌্যা কছলাম, হা-করারা, নদীর ধার যাস্ নারে। উটি উষ্টা খাবু। তা হামার কথা কান গ্যালাে না! এখন দেখছু, কোবানী কা কয়? আর যে আও-শব্দ করবার পারিচ্ছ নারে।
হেই লাইগ্যাই কেতাবে লিখছে ‘পিপীলিকার পাখা উঠে মরিবার তরে।

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল