২৯ জুলাই ১৯৭১
ম্যাজিক। বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় আইজ-কাইল ম্যাজিক কারবার চলতাছে। চাইর মাস ধইর্যা পাইট করণের পর হানাদার সােলজাররা তাগাে কম্যান্ডরগাে জিগাইছে, মুক্তিবাহিনীর বিক্ষুগুলা দেখতে কি রকম? এই বিচ্ছগুলায় কি রকমের কাপড় পেদে?- এই সব না জানলে কাগাে লগে পাইট করমু? আর দুশমনগাে খালি চোখে দেখতে পাই না কেন?’ লন্ডনের সানডে টাইম্স কাগজের রিপাের্টার মুরে সেইল খুলনা সফরের পর এই Report পাডাইছেন। হানাদার বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্ণেল শামসুজ্জামান বহুত খাতির জমা কইর্যা এই আংরেজ রিপাের্টারকে একজন ভােমা মােছওয়ালা ক্যাপ্টেনের লগে বেনাপােলের কাছে একটা রিফিউজি Reception Centreএ পাডাইছিল- তখন ক্যাপ্টেন সাবে এই জবরদস্ত প্রশ্নের কথা কইছেন। মােছুয়া ক্যাপ্টেন সেইল সা’বরে কইছেন, আমরা একটা জব্বর মুছিবতে পড়ছি। আমাগাে জোয়ানরা মুক্তি ফৌজের চেহারা-সুরত, ইউনিফরম কিছুই দেখে নাইক্যা। বচপনমে শুনা থা বঙ্গাল মুলুকমে যাদু হ্যায়। শায়েদ ইয়ে ভি এক কিসিমকা যাদু হ্যায়।’
আংরেজের বাচ্চায়, এই ক্যাপ্টেন সা’বরে খুটিয়ে খুটিয়ে জিগাইতে লাগলাে আর মাথার মাইদ্দে হেই জিনিষ ভর্তি মােছুয়া ক্যাপ্টেন ভুড় ভুড় কইর্যা সব কইয়্যা ফেলাইলাে, আমাগাে জোয়ানগাে কেউ কয় মুক্তিফৌজ লুঙ্গি পিনদা থাকে, আবার কেউ কয় আরে নেহি নেহি উও লােগ হাফপ্যান্ট পিন্দা হ্যায়। আবার কেউ কেউ কয় হেরা পাজামা পইরা আসে। কিন্তু আমাগাে মুছিবত হইতাছে মুক্তিফৌজ, কৃষক, শ্রমিক, দুষ্কৃতিকারী, ছাত্র-শিক্ষক, আওয়ামী লীগার হগুগলে চেহারাই আমাগাে কাছে একই রকম মালুম হইতাছে। কোনাে তফাৎ করতে পারতাছি না। কিন্তু রােজই রাইতে হেগাে কারবার চলতাছে। হেরা ব্রিজ, কালভার্ট, রেল লাইন, রাস্তা-ঘাট সব উড়াইয়া দিতাছে। আর আমাগাে জোয়ানরা Patrol-এ বারাইলেই গায়েব। ক্যাপ্টেন সাবের কথায় কেমন মনে হইতাছে-গ্যানজামডা কি পরিমাণ লাগছে।
হ-অ-অ-অ। আজরাইলে যারে আছর করে তারে বাঁচাইবাে কেডা? আহ্-হা, এইডাও খুইল্যা কওন লাগবাে? সবুর, সবুর- একটু সবুর। সবাই খুইল্যা কইতাছি। খুলনার হারু পার্টির লেতা আগায় খান, পাছায় খান, খান আব্দুস সবুর খানের কি চোটপাট? ব্যাডা একখান! হেতনে খালি ময়দানে খুলনার লেতা হইছেন।
ধড়াধ্বড় কইর্যা অনেকগুলা অশান্তি কমিডি বানাইছেন। লন্ডনের সানডে টাইমসএর রিপাের্টার মুরে সেইল এই ব্যাপারে একটুক এনকোয়ারী কইরাই আহম্মক বইন্যা গেছেন। হাঃ হাঃ জোড়া পাঁঠা বলি হইছে। ছবুর সা’বের দুই ঘেটু-খুলনা জেলা বাের্ডের ভাইস চেয়ারম্যান গােলাম সরােয়ার মােল্লা আর খুলনা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল হামিদ অক্করে শ্যাষ হইয়া গেলেন। অহন তারা আজরাইল ফেরেশতার দরবার কমিডির মেম্বার হইছেন। এই আংরেজ রিপাের্টার আরও লিখছেনহের লগে একত্রিশ বছর বয়সের আব্দুল ওয়াহাব মহলদারের মােলাকাত হইলাে। মনে লয় মহলদার টাইটেলডা নতুন নিছে। এই মহলদার সা’ব আবার হেই মাল। কিন্তু ব্যাডায় সাদা চামড়া দেইখ্যা কথা কওনের সময় সবকিছু গুলাইয়া ফেলাইলাে। একটা আঙ্গুল দিয়া গলার নিচের থনে ঘইষ্যা গতরের ময়লা তুলতে তুলতে কইলাে, ‘গ্যালাে দুই তিন হপ্তার মাইদ্দে দুষ্কৃতিকারীরা খুলনা জেলায় আমাগাে শ’ দুয়েকের বেশি মেম্বার মাইরা ফেলাইছে।
ক্যামন বুঝতাছেন? সেইল সা’ব হের রিপাের্টে আরাে কইছেন, সাতক্ষীরার থনে খুলনা ফেরত যাওনের টাইমে একটা পুল মেরামত করতে দেখলাম। গেরিলারা দিনা দশ আগে এই পুলডারে ডাবিশ করছে। ২৫ জন রাজাকারের একটি দল এই পুলডা পাহারা দিতাছিল। কিন্তুক রাইতের বেলায় বিক্ষুগুলা আহনের ভাজ না পাইয়া হগুগল কিছু ফেলাইয়া রাজাকারের দল আরে দৌড় রে দৌড়! তারপর বুঝতেই পারছেন, হেই। পুলের মাইদ্দে খাতির জমা কারবার হইলাে। টিক্কা-ইয়াহিয়ার দল রাজাকারের নামে বিগুলার কামানের খােরাক তৈরী করতাছে।
এই রকম একটা অবস্থা খুলনার ইনচার্জ লেফট্যোনট কর্ণেল শামসুজ্জামান রাজাকার আর অশান্তি কমিডির মেম্বারগাে খুশি করণের লাইগ্যা নীলামের কারবার শুরু করছেন। ব্যাড়ায় খুলনাতে দুই হাজার একর ধানী জমি নীলাম করছেন। Normal টাইমে এই ধানী জমির দাম ছয় লাখের মতাে। কিন্তু দেড় টাকা একর হিসেবে কর্ণেল সা’ব এই সব জমি নীলাম করছেন। যারা এই মউতের লটারির টিকিট কিনছেন, তাগাে মওত আওনের আগেই তুফান মুছিবত।
নাইক্যা। জমি চাষ করণের লাইগ্যা কোনােই লােক নাইক্যা। খুলনা জেলার তিরিশ লাখ লােকের আট লাখের কোনাে খবর পাওয়া যাইতাছে না। গ্রামগুলা ভুতুড়ে এলাকার মতাে মনে হইতাছে। এই খুলনার অর্ধেকের বেশি জমিতে এইবার হালচাষ হয় নাইক্যা। বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা লাপাত্তা। এই সমস্ত রিপাের্টই লন্ডনের সানডে টাইমস-এ ছাপাইছে।
হ-অ-অ-অ এই দিকে আবার গেরিলাগাে গাবুর মাইরের চোটে চোখে সরিষার ফুল দেইখ্যা রাও ফরমান আলী এক জব্বর কাম করছেন। কয়েকটা লােকরে আজরাইল ফেরেশতার লগে মােলাকাত করণের টিকিট দিতাছেন। এইটা বুঝলেন না?
ফরমান সা’বে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন, পার্লামেন্টের মেম্বার জনাব আব্দুল মান্নান আর পিপল কাগজের মালিক জনাব আবিদুর রহমান মামলার তারিখে হাজির হয় নাই বইল্যা চৌদ্দ বছরের জেল আর সম্পত্তি নীলামে তুলছেন। মামলার তারিখে হাজির হয় নাই বইল্যাই এই অবস্থা। তহন আসল মামলার বিচারে মনে লয় এগাে চৌদ্দ বছরের ফাঁসি দিবাে? কিসের নাই চাম রাধা কেষ্ট নাম। স্বপ্নের মাইদ্দেই যহন খাইতাছে, তখন হেগাে রসগােল্লা খাইতে দোষ কি?
কিন্তু আমি ভাবাতছি এই সব সম্পত্তি নীলামে কেননের লাইগ্যা যাগাে চিরকিৎ হইছে, তাগাে নাম যে আর একটা লিস্টির মাইদ্দে উইঠ্যা গেল। হেগাে যে আজরাইল ফেরেশতা খালি ধাওয়াইয়া বেড়াইবাে। হেইডার কি হইবাে?
এই দিকে সিলেটের কারবার হুনছেন নি? হেইখানে আইজ-কাইল খালি ঘেডাঘ্যাট, ঘেডাঘ্যাট চলতাছে। টিক্কা-নিয়াজীর দল পয়লা বাঙালি মারনের টাইমে সিলেটের চা বাগানগুলারে শেষ করছে। কিন্তু হের পর যহন রিপাের্ট আইছে যে, চা পাওয়া যায় না বইল্যা পশ্চিম পাকিস্তানে হগ্গল ব্যাডাগাে গতর ম্যাজ ম্যাজ করতাছে, তখন সিলেট থনে চা পাড়ানাের লাইগ্যা টিক্কা সা’বে অর্ডার দিছে। বহুত কোশেশ করণের পর সাড়ে তিনশ’ চা বাগানের মাইদ্দে মাত্রক পঁচিশজনরে যােগাড় কইর্যা একটা আখেরী চেষ্টা চলতাছে। কিন্তু মুক্তি বাহিনীর গেরিলাগাে মাইরের চোটে এই এলাকার হগ্গল রাস্তাঘাট অক্করে তুষা তুষা হইয়া গেছে গা। রাজঘাট চা-বাগানে তাে দিনের বেলায়ই এই কারবার হইছে। হেইখানকার পশ্চিম পাকিস্তানী সােলজাররা সব কিছু ফালাইয়া অক্করে ভাগােয়াট। তারপর রাইতের বেলায় এই সােলজাররা কামান লইয়া রাজঘাট চা বাগান Attack করলাে। হেরপর বুঝতেই পারছেন? হানাদার সােলজার গাে কামানের গােলায় জেমস ফিনলে কোম্পানির World-এর এই সবচেয়ে বড় চা-বাগানডা ছাই হইয়া গেল। আর একটুক ফারাকে জঙ্গলের মধ্যে বইস্যা বিচ্ছুগুলা মছুয়াগুলার তামাশা দেখলাে।
হের পর কেমতে জানি চা-বাগানের দুইজন সাহেব গায়েব হইয়া গ্যাছেগা। এই না দেইখ্যা বাকি ২৩জন অহন কার্টিং করণের লাইগ্যা অক্করে পাগলা হইয়া গেছে। হেগাে আর ক্রেন দিয়া বাইন্দ্যা রাখন যাইতাছে না। তাই Mango-gunny bag both gone. মানে কিনা আমছালা দুই-ই হারাইয়া সেনাপতি ইয়াহিয়া সিংহল থাইক্যা দুই লাখ পাউন্ড চা পশ্চিম পাকিস্তানে আমদানী কইর্যা ঠেকা কাম চালাইছেন। অহন হেইটাও পরায় শ্যাষ।
হেইর লাইগ্যা কইছিলাম-ম্যাজিক। বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় আইজকাইল ম্যাজিক কারবার চলতাছে। সেনাপতি ইয়াহিয়ার সােলজাররা খালি চিল্লাইয়া কইতাছে, বঙ্গাল মুলুকমে যাদু মে হ্যায়? ইসকো সাথ Fight কর ন আর মউতকো পুকার না তাে একই বাত হ্যায় ।
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল