You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.30 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

৩০ জুলাই ১৯৭১

আইজ একটা ছােট্ট ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। বছর দেড়েক আগেকার কথা, আমি উত্তর মুহী গেছিলাম। মানে কিনা উত্তর বঙ্গের একটা টাউনে বন্ধুর বাড়িত লাইওর খাবার গেছিলাম। ছােট্ট একটা টাউন। দিন দুই কই মাছের পােলাও আর মুরগির রােস্ট খাওনের পর এইখানকার বাজারটা দ্যাহনের লাইগ্যা মনের মাইদ্দে একটুক শখ হইলাে। তাই সকাল নয়টার দিকে ফতে আলী বাজারে যাইয়া হাজির হইলাম। সবকিছু কেননের । হ্যাষে খাসীর গােস্ত কিনতে গেলাম। কসাইর নাম ওইরুদ্দী। আমার দোস্তই কইয়্যা দিছিলাে এই ওইরুদ্দীর কাছ থনে গােস্ত কেননের লাইগ্যা। হিসাব মতাে গােস্ত লইয়া দাম দিতাছি- এমন সময় দেহি কি একটা ঝােলা কাঁধে দেওয়াইন্যা মানুষ মানে একজন ফকির দোকানের মাইদ্দে খাসীর কলিজাটা হাত দিয়া লাড়াচাড়া কইর‌্যা দেখতাছে। কসাই ওইরুদ্দী টাকা গুণতে গুণতে একটুক এ্যাংগেল কইর‌্যা দেখলাে। তার পরই অক্করে খ্যাকরানী দিয়া উঠলেন, ক্যারে হা-করা, কইলজ্যা আউলাছু ক্যা- লিবু?
কালা কালা দাঁত বাইর কইর‌্যা একটা গুয়ামুরি হাসি মাইরা ফকির কইলাে, ‘হ-অঅ দিবারই চাছুন, দামান্দ আচ্চে।
ওইরুদ্দী গলার আওয়াজ একটু নরম কইর‌্যা গাহেকরেই জিগাইলাে ‘খাসীর কইলজ্যা লিবু, তা কত দিবু?’ এইবার হেই ফকির কলিজাটারে আরেকবার লাড়া দিয়া কইলাে, আমি হচ্ছি গরিব মানুষ। তুমি তাে আমার কাছে আর লাভ করবা না! মিচচি এ্যানা কইলজ্যা- তা আনা চারি দিলে হয় না?”
ওইরুদ্দীর মেজাজ তহন ফরটি-নাইনে উড়ছে। তাই-ই চিল্লাইয়া উঠলাে, ‘লাদ খরে লাদ খা। চার আনা দিয়া খাসীর লাও পাবু নারে।
সেনাপতি ইয়াহিয়া অহন মুক্তি বাহিনীর বিক্ষুগুলার মাইরের চোটে কাদা কাদা হইয়া কসাই ওইরুদ্দী হইয়্যা গ্যাছে। হেতনে স্যার শাহ নেওয়াজ ভূট্টোর পোেলা জুলফিকার আলী ভুট্টোরে কইছে, চাইর আনা দিয়া খাসীর হেই জিনিসও পাবু নারে?’ এলায় বুঝছেন? করবারটা কি রকম গ্যানজাম হইয়্যা গ্যাছেগা।।
ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকার অংকের হিসাবে ভুল কইর‌্যা মেলেটারি বহাইয়্যা একটা ইলেকশন করছিল। ব্যস্, হেইটাই শাল হইলাে। শেখ মুজিব আর আওয়ামী লীগরে বহু টোপ দিয়া বাগে আনতে না পাইরা- যা থাকে ডুঙ্গির কপালে কইয়্যা পাঁচ ডিভিশন সােলজার লইয়্যা হুঁ হুঁ কইর‌্যা দৌড়াইয়া আইস্যা ইয়াহিয়া-টিক্কা-নিয়াজীর দল অক্করে বাংলাদেশের প্যাকের মাইদ্দে হান্দাইলাে। আমাগাে নিজেগাে বাড়ির মাইদ্দে কারবার কইরা বেশুমার মানুষ মার্ডার করণের পর এলায় বিচ্চুগাে হাতে গাবুর মাইর খাইয়্যা যহন চিল্লাইতাছে, এইটা বারােয়ারী ব্যাপার, এইটা বারােয়ারী ব্যাপার, আমেরিকা, চীন, জাতিসংঘ যে কেউ-ই আইতে পারে। এই রকম একটা কুফা অবস্থায় সময় নাই, অসময় নাই ফকির জুলফিকার আলী ভূট্টো চাইর আনা পহা দিয়া খাসীর। কলিজা কিনতে আইছে। মানে কিনা হেতনে ক্ষ্যামতা চায়। প্রাক্তন পাকিস্তানের পার্লামেন্টের ৩১৩টা আসনের মাইদ্দে ২৩২টা আসন না পাইয়াই ব্যাড়ায় সেনাপতি ইয়াহিয়ার মতাে লােকের কাছ থনে ক্ষমতা চাইতাছে। আহম্মক আর কারে কয়? বাঘ যহন মানুষের গন্ধ পাইয়্যা পাহাড় থনে ধান ক্ষেতে নাইম্যা আসে, তহন হেই বাঘরে মাইর্যা না ফেলাইলে গেরামের লােকে আর শান্তি পায় না। হেই রকম ইসলামাবাদের জঙ্গী সেনাপতিরা যহন বাদশাহী করণের লাইগ্যা একবার Chance পাইছে, তহন হেগাে শ্যাষ না করণ পর্যন্ত যে কারাে কোনাে আশাই নাইক্যা এইডা ভুট্টোরে কে বুঝাইবাে?
হেতনে ইরান থাইক্যা ঘুইর্যা অইস্যাই ঘন ঘন ইয়াহিয়ার লগে মােলাকাত করতাছে। আর মােলকাতের সময় হেই যে আগের মালগুলা যারা বড় সা’বের লগে। ঢাকায় আইছিল তারাও হাজির থাকতাছে। লেঃ জেনারেল পীরজাদা জাস্টিস্ এ.আর. কর্ণেলিয়াস আর এম.এম. আহম্মক ঠিক সেনাপতি ইয়াহিয়ার লগের চেয়ারগুলাতে বইস্যা হাসতাছে। ভুট্টো সা’ব আবার ট্রিক্স কইরা কইছে, বাংলাদেশে যহন লড়াই চলতাছে তখন বাংলাদেশ বাদে বাকী এলাকার মানে কিনা পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষ্যামতা দেয়া হােক। জাস্টিস কর্ণেলিয়াস সাব আস্তে কইর‌্যা কইলেন, তয় তাে বাংলাদেশ যে আলাদা এই কথাডা তাে মাইন্যা লইলাম, অহন ছদর সা’ব কি করবা হেইডা তারই এক্তিয়ার। বহুত দিন আগে দিনাজপুর টাউনে মুজাফফরপুরের একজন হেই জিনিষের। দেখা হইছিল। ব্যাডায় আমারে কয় কি? ‘হামলােগ পুরা India কো কব্জা কর লেঙ্গে। আমি কইলাম তয় তাে আবার অখণ্ড ভারত হইয়া যাইবাে।ক্যামন বুঝতাছেন? যাউকগা যা কইতাছিলাম। ছদর ইয়াহিয়া হাতের ব্যাটনডারে কাচের টেবিলডার উপর ঠুক ঠুক্ কইরা বাইড়াইয়া ভুট্টোরে কইলাে, জাস্টিস্ সা’বে আসল কথাডা কইছে। পাকিস্তানডারে এক রাখনের লাইগ্যাই তােমারে ক্ষ্যামতা দিতে পারতাছি না বইল্যা আমি খুবই কষ্ট পাইতাছি। খালি পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষ্যামতা দিলে বাংলাদেশের আজাদী মানতে হইবাে। আড়াই ঘণ্টা গুফতাগু করণের পর ভুট্টো সাব করাচীতে সাংবাদিকগাে কাছে কইছে, আমি অহন কিছু কমুনা। আরাে Talk করণ লাগবাে।’ ক্যামন বুঝতাছেন- অহন হেইদিক্কার পালা।
হ-অ-অ-অ। এই দিকে কুমিল্লার কসবার আড়ই বাড়িতে আঃ হাঃ রে অক্করে ছেরাবেরা কারবার হইয়া গেছেগা। কামানের খােরাক। মুক্তি বাহিনীর বিক্ষুগুলা কামানের খােরাক পাইছে। টিক্কা-নিয়াজীর চিরকিৎ হইছে বইল্যা আইজ-কাইল যে তিন টাকা রােজচুক্তিতে রাজাকার বাহিনী বানাইছে হেগাে চব্বিশটা একলগে কসবার আড়াই বাড়িতে যাইয়া কি চোটপাট। মনে লয় এইমাত্র সেনাপতি ইয়াহিয়ার লগে তাগাে ফোনে কথা হইছে। কিন্তু হেরা জানে না যে, মউত হেগাে লাইগ্যা ওঁৎ পাইত্যা বইস্যা আছে। এই original মালগুলা অক্করে বিচ্চুগাে কোলে যাইয়া বইলাে। হেরপর কারবার হইয়া গেল।
আর এই দিকে মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, সিলেট, চিটাগাং, ময়মনসিংহ, রংপুর, দিনাজপুর, সাতক্ষীরায় হানাদার সােলজাররা গেরিলা মাইরের চোটে আইজকাইল নেতাইয়া পড়তাছে। রাস্তাঘাটে রিক্সার টায়ার আঙ্কা ফাটলেই হেরা খামুখা অস্ত্রপাতি ফালাইয়া Hands up কইর‌্যা খাড়াইয়া পড়ে। মালয়েশিয়ার প্রাক্তন পেরধান। মন্ত্রী আর ইসলামিক সেক্রেটারিয়েটের সেক্রেটারি জেনারেল টেংকু আব্দুর রহমান ঢাকার থনে ভাইগ্যা পেনাং-এ সাংবাদিকগাে কাছে কইছে, বাংলাদেশের অবস্থা খুবই খতনরাক। গেরামের মাইদ্দে খেইল খুবই জিওট বাছে আর বারিষের এতােই চোট যে, ইসলামিক মিশনের মেম্বাররা আর ঢাকার থনে বাইরাইতেই পারে নাইক্যা। গেরিলাগাে Action আর সােলজারগাে Movement-এর জন্যি বাংলাদেশে ঘােরাফিরা খুবই রিস্কি হইয়্যা পড়ছে।
হের লাইগ্যাই কইছিলাম বাংলাদেশের অহন ফাটাফাটি কারবার চলতাছে। পাঁচ ডিভিশন সােলজার লইয়া ইয়হিয়া-টিক্কা-নিয়াজীর দল হুঁ হুঁ কইর‌্যা দৌড়াইয়া আইস্যা। অক্করে প্যাকের মাইদ্দে হান্দাইছে।
আর কসাই ওইরুদ্দী কইতাছে, ‘লা খারে, লাদ খা- চাইর আনা দিয়া খাশির লাও পাবু না রে।’

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল