You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.12 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

১২ জুলাই ১৯৭১

রেকর্ড করছে। আমাগাে কক্সবাজারের মওলবী ফরিদ আহমদ সা’বে রেকর্ড করছে। ইলেকশনে আওয়ামী লীগের কাছে বাড়ি খাওনের পর মওলবী সা’বে একটু খামুশ হইয়াছিলেন। কিন্তু যেই মুহূর্তে দেখলেন যে, হেতাইনের আব্বাজান সেনাপতি ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশে সােলজার নামাইয়া বেশুমার মানুষ মারতে শুরু করছে, হেই মুহূর্তে ফরিদ সা’ব চাঙ্গা হইয়া বিছানার মাইদ্দে বইলেন। দিল্ডা তার খুশ হইয়া গেলগা । কেমন ব্যাডারা ভােটের সময় আমারে কাঁচকলা দেখাইছিলা। অহন ঠ্যালাডা বােঝ! তােমাগাে লাইগ্যা আমি কত বছর আগের থনে নূর রাখতাছি। আইজ-কাইল লুঙ্গি পরতাছি। রাস্তাঘাটে সময়ে-অসময়ে নামাজ পড়তাছি। তবু এইবার ইলেকশনের টাইমে আমি ভােগা খাইছি। অহন? সেনাপতি ইয়াহিয়ার মেলেটারি ডেমােক্রেসির জমানায় হারু পার্টির নেতা হিসাবে আমার মিনিস্টার হওনডা ঠ্যাকায় কেডা? তাই আমার শ্লোগানই হইতাছে দুনিয়ার হারু পার্টি এক হও।’
এ হেননা ফরিদ সা’ব আইজ-কাইল ফুচি মারতে শুরু করছে। আঃ হাঃ আপনাগাে লইয়্যা তাে মহাবিপদ! সব কথাই জানবার চান? একটুক ছিক্রেট রাখন যায় না। তয় কইতাছি হুনেন। বাংলাদেশে না থাইক্যা বাঙালি, আর বাংলা কথা না কইয়্যা বাঙালি। এইরকম একজন লেডী, মরহুম হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মাইয়্যা বেগম আখতার সােলায়মান। হেই বেগম ফকা-ফরিদ, দুদু-সবুর, খাজা-আজমের মতাে হারু পার্টির নেতাগাে পথে বহাইছে। ‘বেগম সাহেবা’- হেরে আবার বেগম না কইলে চেইত্যা যায়। সেনাপতি ইয়াহিয়া সা’বরে যাইয়্যা কইলাে, আপনে হারু পার্টির নেতাগাে লইয়্যা ফাল। পাড়তাছেন কেন? আমি আপনারে জিতাইন্যা পার্টির মাইদ্দে থাইক্যা মীর জাফর বাইর কইরা দিমু।’ এর-প-র বেগম সাহেবা ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টালে আস্তানা গাড়লাে। এসােসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তানের রিপোের্টারকে ডাইক্যা কইলাে, ‘ঢাকায় আহনের লগে লগে বাইশ জন এম.এন.এর Support পাইয়া গেছি। তয় দেশের Interest-এর জন্যি নাম কমু না। অবিশ্যি এর মাইদ্দে জনা কয়েক জেলে আছে।’
পয়লা আমাগাে হাজী সা’বে বেগমরে আসসালামু-আলায়কুম কইয়া হাজির হইলাে। হাজী সা’বরে চিনলেন না? আসল বাড়ি কইলকাত্তায় আর হাল সাং ঢাকা। বাড়িতে উর্দু ছাড়া কথা কইতে পারে না। পুরা নাম আলহাজ্ব জহিরুদ্দিন। বেগম সাহেবার লগে দেখা হওনের আগে হাজী সাবের লগে জেনারেল টিক্কার একটু কথাবার্তা হইছিল। হেই থাইক্যা হাজী সা’বে সাইজ্যাণ্ডইজ্যা বায়তুল মােকাররমে নামাজ পড়তে যাইতাে আর কেউ কওনের আগেই আস্সালামু অলায়কুম কইতাে।
একটা ছােট্ট গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। এক গরিব বিধবা। নিকট আত্মীয়স্বজন নাইক্যা। অনেক দিনের পুরনাে এক মামলার রায়ে আকা এক লাখ টাকার সম্পত্তির মালিকানা পাইলাে। কিন্তুক বিধবা হেই খবর জানে না। কোর্টের এই অর্ডার লইয়্যা একজন বটতলার ধ্বচা মারা মােক্তার বিধবার বাড়িত রওনা হইলাে। কিন্তুক মােক্তার সা’বরে কোর্ট থনে বার বার কইর‌্যা কইয়্যা দিছে, আঙ্কা এই জব্বর ভালা খবর হুনলে বিধবা খুশিতে হার্টফেল করতে পারে। তাই খুবই খাতির জমা কইর‌্যা আস্তে আস্তে খবরডা দিবা। মােক্তার গেরামে যাইয়্যা দেহে কি, হেই বুড়ি বিধবা ভাঙ্গাবাড়ির উডানডা লেপতাছে। মােক্তার সা’বরে দেইখ্যা বুড়ি মুখ হাত ধােওনের পানি দিলাে আর একটা বাড়ির মইদ্দে গুড়মুড়ি খাইতে দিলাে। মুড়ি খাইতে খাইতে মােক্তার সা’বে বুড়িরে কইলাে কি, ‘আরে এই সােনার মা, আচ্ছা ধরাে যদি তুমি আকা একশ’ টাকা পাও তা হইলে কি করবা?”
বুড়ি কইলাে, তয় বাড়ি মেরামত করমু।’
এরপর মােক্তার জিগাইলাে, যদি পাঁচশ’ টাকা পাও, তা অইলে কি করবা? বুড়ি ফোল্লা দাঁতের হাসি দিয়া কইলাে, তা হইলে দুইডা গাই কিনুম।’ এদিকে মােক্তারের কিন্তক প্রশ্নের শেষ হইতাছে না।
‘যদি এক হাজার টাকা পাও? বাড়ি মেরামত আর গাই কেননের পর যে পহা থাকবাে হেইডা দিয়া বন্ধকী ছুডামু। যদি দশ হাজার টাকা পাও? ‘তয় এক ধারুসে জমি কিনুম। যদি পঞ্চাশ হাজার পাও? নতুন দালান বানামু।
‘আর যদি এক লাখ টাকা পাও?” সােনার মা আর চিন্তা কইর‌্যা কুল পায় না। তাই ভট কইর‌্যা কইয়্যা ফালাইলাে, একলাখ পাইলে-একলাখ টাকা পাইলে, অর্ধেকটা আপনারে দিমু।’
যেই না কওয়া, মােক্তার অক্কারে মাটির বারান্দা থনে বেহুশ অইয়া উঠানের মাইদ্দে ঠাস্ কইরা পড়লাে। মাথায় অনেকক্ষণ ধইর্যা পানি ঢালনের পর মােক্তারের হুঁশ আওনের লগে লগে চিল্লাইয়া কইলাে, তুমি আমারে পঞ্চাশ হাজার দিলে আমি করবাম কি?
আমাগাে জহির উদ্দিন অহন ধ্বচা মারা মােক্তার হইছে। বেগম আখতার সােলেমানের কথাবার্তা হুইন্য পরায় সেন্সলেস হইয়াছিল। কয়েকদিন জহির সা’বের চোটপাট খুবই বাড়ছিল। মাইনষের ভােগা মারণের লাইগ্য হেতাইনে সােহরাওয়াদী-লীগ করনের খােয়াব দেখছিল। কিন্তুক বেগম সাহাবা আসুর দরিয়া বহাইয়া করাচী ফেরৎ যাওনের সময় যহন ছিক্রেট রিপাের্ট দিলাে যে, মাত্ৰক নয়জন পাওয়া গেছে- মানে কিনা ১৬৭ জন আওয়ামী লীগ মেম্বারের মাত্র নয়জন টোপ গিলছে আর বাকীরা মুক্ত এলাকায় গ্যাছেগা। তহন হাজী সা’বে বাড়ির কপাট লাগাইয়্যা weep করতাছে। বায়তুল মােকাররমে আর যায় নাইক্যা।
এদিকে ফরিদ সা’বে এক রেকর্ড করছেন। মাইনষের উপহারে হের বাড়ি ভইরা গ্যাছেগা। এ্যার মাইদ্দেই বেশি না, এগারােটা কাফনের কাপড় পাইছে। মানে কিনা লিস্টিতে আলহাজ্ব ফরিদ আহমদ সাবের নাম অক্করে প্রথম দশ জনের মাইদ্দে রইছে। আজরাইল ফেরেশতার লগে তাঁর মােলাকাতের টাইম খুবই নজদি। এ্যার মাইদ্দে আবার রেডিওতে খবর হইছে, ‘হেই জিনিস আপনাগাে আশেপাশেই আছে। এখন বলে আবার নতুন কিসিমের উপহার আইতাছে। কাফনের কাপড় Short পড়নের গতিকে ‘আগর বাত্তি, আতর, সাবান পাঠাইলাম। কারণ বােধ করি আর কওন লাগবাে না। তাই ফরিদ সা’বে আইজ-কাইল ফুচি পাড়তাছেন। দরজার মাইদ্দে যদি-ই কোনােরকম আওয়াজ হয়, তা হইলেই সা’বে জানালার ছ্যাদা দিয়া ফুচি মাইর্যা দেখতাছেন ‘আজরাইলে আইলাে কিনা?
খাইছে রে খাইছে! এইদিকে দুই হাজীর কথা কইতে যাইয়্যা সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের ফাইটিং ফোর্সের কথাই কওয়া হয় নাইক্যা। হেইদিকে বারান্দায় খাট পড়ছে। খালি একটা হাসপাতালের কথা কইতাছি। কিতা কন আমাগাে সিলট হাসপাতালে, কথা কন? হ-অ-অ-অ বুঝছি। বারান্দার কথা হুইন্যাই বুঝি টের পাইচুইন। সিলেট সদর। হসপিটালের মাইদ্দে বেড় হইতাছে দুইশ’ । কিন্তু অহন রােগীর সংখ্যা চারশ’ বিশ। স্টোর রুম, লাশ কাডার ঘর, সূতিকা ঘর, কলেরা ওয়ার্ড, টি.বি. ওয়ার্ড হগল জায়গায়ই মােডা-মােডা গোঁফওয়ালা রােগীরা খাকী পােষাক পিন্ধ্যা খালি চিল্লাইতাছে।।
হ্যালাে, টিক্কা-নিয়াজী এই ব্যাপারটাতে আমরা খুবই Sorry হইছি। গেরিলারা যহন ট্রেনিং লইতাছিল তহন গেরামের বাঙালি পােলাপানগুলা আন্ধারিয়া গুলি মারণের গতিকেই আপনাগাে জখমি বেশি হইছে। কিন্তুক অহন সেনাপতি ইয়াহিয়ার হেই চিন্তা গ্যাছেগা। হাজারে হাজারে বিচ্চুগাে ট্রেনিং Complete হইছে। পঙ্গপালের মতাে আরাে ট্রেনিং চলতাছে। তাই অহন Bull’s Eye, মানে কিনা হাত পইট। গুলি মারণের লগে লগে হেগাে আওয়াজ বন্ধ- দম নাই- খালি একটু শরীলডা খিচাইয়াই ঠাণ্ডা।
দ্যাহেন না, হেইদিন বিবির বাজারে ২০ জন হানাদার সােলজার সাফ, মেহেরপুরে ৭৭ জন খতম, কুমিল্লার মালখা বাজারে সাতজন গায়েব, ঢাকায় তিন জনের মউত । আবার লগে লগে সিলেট টাউনের মাত্র সাত মাইল পশ্চিমে ৭০ ফিট লম্বা ব্রিজটা বােম-ফাটা হয়ে গ্যাছেগা। আল্লাহ্র রাইত পােহানের টাইমে ব্রিজ ভাঙ্গনের যে আওয়াজ হইছিলাে তাতে হানাদার ফৌজের জোয়ানগাে সে কি কাঁপন! যেমন লাগে ম্যালেরিয়া জ্বরের ১০৪ ডিগ্রি। হেই জন্যই কইছিলাম, তেল, তিসি, তাল মাখনা- খায় জানানা হয় মরদানা। সেনাপতি ইয়াহিয়ার সােলজারগাে অহন কুয়াতে হালুয়া আর তাল মাখনা খাওনের টাইম হইছে।

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল