১৮ জুলাই ১৯৭১
আমাগাে ছকু মিয়া দিন দুই উপােস থাকনের পর হেইদিন এক ঝুড়ি আম লইয়া বেগম বাজারে বেচনের লাইগ্যা গেছিল। তাই বইল্যা ভাববেন না যে আমগুলা ছক্কু মিয়ার । আসলে আমগুলা হইতাছে কাপ্তান বাজারে কাউলার। কাউলা অনেক Think কইরা দেখলাে কাপ্তান বাজারে আমগুলা বেচনে যাইবাে ঠিকই। কিন্তু পহা? হেইডা পাওন খুবই মুস্কিল। কেননা ঠাটারী বাজার-কাপ্তান বাজারের দিকে আবার অশান্তি কমিটির মেম্বরের নম্বর খুবই বেশি। আর হেই মেম্বারগাে কেন জানি না Habit হইছে মাল কিন্যা পহা না দেওনের। তাই কাউল্যা ভাবলাে ছক্কতাে অহন উপাস যাইতাছে তাই হেরে দিয়া। আমগুলা বেইচ্যা আনা কয়েক পহা দিলেই ছক্কও কিছু পাইবাে আমার আমগুলাও বেচন যাইবাে।
ছক্কু মিয়া বেগম বাজারে আম লইয়া বইয়া আছে তাে আছেই। গ্রাহক পাতি নাইক্যা। হ্যাষে যহন ছক্কর শূল বেদনাটা একটুক কইর্যা চাড়া মারতাছে, তখন দেখে কি খুব লম্বা এক সাব আইস্যা হাজির। সাবে দর করনের কথা কইতেই ছক্কু কইলাে কি, ‘যদি পিডানী না দেন তয় একটা কথা কমু?” সাব কইলাে, হ্যা বলতে পারাে। ছক্ক কইলাে, যদি পকেটের মাইদ্দে এক টাকার লােট থাহে তয় দর করতে পারেন। লম্বু গায়েক খুব গরম, “কেন, এক টাকার নােট ছাড়া নেবে না নাকি?’ ছক্ক একটা বাইশ হাজার টাকা দামের হাসি দিয়া কানডা একটু চুলকাইয়া কইলাে, দ্যাহেন ছ্যার, আইজকাইল কেন জানি না স্টেট ব্যাংকের গবর্ণরের দস্তখতঅলা লােট লইতে খুবই ডর করে।
‘ক্যানাে পঞ্চাশ টাকা-দশ টাকার নােট নিতে ভয় কিসের? ‘আহ-হা ছ্যার, আপনে যদি একটু খেয়াল করেন তয় দেখবেন, এক টাকার ললাটের মাইদ্দে কোনাে ওয়াদা নাইক্যা। মানে কিনা আইন মতাে এক টাকার লােটের কেউ স্টেট ব্যাংকের কাছে ভাংচা চাইতে পারে না।- আহ্হা অহনও Clear হইলাে না। তয় কই হােনেন, ‘এক টাকা ছাড়া সমস্ত ললাটের মাইদ্দে লেহা আছে চাহিবা মাত্র স্টেট ব্যাংক সমমূল্যের টাকা দিতে বাধ্য। তারপর একটা দস্তখত। আর এক টাকার ললাটের মাইদ্দে এই সব কিছুই লেখা নাইক্য। কিন্তু ইয়াহিয়া সাবে যে লােটের মাইদ্দে হেই ওয়াদার কথা যত বড় কইর্যা লেখা আছে হেই লােট তত তাড়াতাড়ি মন্ত্র পইড়া কাগজ বানাইতাছে।
এলায় লম্বু সা’ব ঠাণ্ডা হইলাে। কইলাে, “ঠিক আছে, এক টাকার নােট দিয়েই দাম দেবাে। হের পর বহুত মােলামূলির পর ছক্ক পুরা চাঙ্গাড়ি আম বেইচ্যা ফ্যালাইলাে। ছকু, সাবের থলিয়ার মইদ্দে যহন আমগুলাে তুলতাছে তহন সা’বে আকা কয় কি? আরে কি হলাে? এতােক্ষণ তাে লক্ষ্যই করি নাই। তােমার আমগুলার সাইজ এতাে ছােট ক্যাননা?’ ছক্ক একটা তেরছি নজর মাইর্যা কইলাে, নাহ সা’ব কিযে কন! আমের সাইজ ঠিকই আছে। আপনে আবার দোতালার থনে দেখতাছেন কিনা, তাই সাইজগুলাে ছােড লাগতাছে। আপনার সাইজ আমাগাে মতাে হইলেই আমের সাইজটা ঠিক মতাে নজরে আইতা, বুঝছেন।’
আমাগাে ইয়াহিয়া সা’বে আম কিনইন্যা লম্বু সা’ব হইছে। অনেক দূর রাওয়ালপিণ্ডি বইয়্যা আছেন কিনা তাই বাংলাদেশে হানাদার বাহিনীর কায়-কারবার কিছুই দেখতে পাইতাছেন না- সবই তার কাছে Normal লাগতাছে।
কিন্তু যারাই নজদিগে গেছে। মানে কিনা বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা ট্যুর করছে, তাগাে কেউ ভিরি খাইছে, কেউ ডরাইছে, কেউ গাইলাছে, আবার কেউ খুব খরাপ খরাপ কথা হইছে। এই রকম একটা কারবারের মাইদ্দে World Bank-এর পুরা রিপোের্ট দুনিয়ার সমস্ত খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে। এই রিপাের্টের একটু হুনাইতাছি, বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে ইয়াহিয়ার সমস্ত সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে আর অবিলম্বে বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা দরকার। বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার কোনাে লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। যানবাহন চলাচল বিপর্যস্ত। জনসাধারণের মনে দেখা দিয়েছে আতংক ও আস্থার অভাব। আর সঙ্গে সঙ্গে চলছে পাল্টা প্রতিশােধ ও বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপ।
এই ধরনের রিপোের্ট হইলে তার কি রকম result হয় তা তাে একটা মক্তব-মাদ্রাসার পােলাও কইতে পারবাে। “ফক্কা”, বুঝছেন। Aid Pakistan consortium ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকাররে একটা আধূলা পহাও দিবাে না দিতে পারে না।
দেখছেননি কারবারটা? আপনাগাে লগে মাল-পানির আলাপ করতাছি আর এই দিকে হেগােজান খতরনাক হয়ে গ্যাছেগা। ছেরাবেরা আর ফাতা-ফাতা শব্দের অর্থ এতােদিন ঠিক মতাে বুঝি নাইক্যা। অহন মেহেরপুরের খবর হুইন্যা শব্দ দুইডার অর্থ খুবই ভালাে রকম বুঝতাছি। ইয়াহিয়া সাব একটা খুবই খারাপ কাম করছেন। ক্যাননা। এইসব সােলজারগাে অলিম্পিক গেমে না পাডাইয়া বাংলাদেশে পাইছে। আরে দৌড় রে দৌড়। খাল, বিল, গর্ত, খন্দক, জঙ্গল-খেত সব Don’t care কইর্যা ঝাইড়া দৌড়। হন্ধ্যা বেলায় মাঠের মাইদ্দে গরু যেমন খুঁডি উডানের লগে লগে বাড়ির দিকে দৌড় দেয় হেই রকম দৌড় দিয়া ইয়াহিয়া সা’বের সােলজাররা খালি চিল্লাইতাছে মামু আগে আইল। আর মুক্তি ফৌজের বাড়ির চোটে হেগাে সমস্ত বাংকার গুড়া আর ট্রেঞ্চগুলা লাশে ভইর্যা গ্যাছেগা। বাকী মালেরা মালপত্র ফালাইয়া এক দৌড়ে পনেরাে মাইল। চাইনিজ রাইফেল, আমেরিকান মর্টার আর ওয়াহর তৈরী বুলেট সব বিচুর লাহাল পােলাগলা লইয়্যা গ্যাছেগা।
আমি কই কি, এক কাম করলে হয় না? যেসব সােলজাররা মেহেরপুর থনে পিডানীর চোটে ভাগােয়াট হইছুইন, তারা গতরের মিলিটারি ড্রেস খুইল্যা Reception Centre-এ রিপাের্ট করলেই তাে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়। খুবই সুন্দর Reception পাওনের Chance আছে। আর পাকিস্তান অবজার্ভার, মর্নিং নিউজে ব্যানার হেড লাইনে খবর ছাপা হবে, দলে দলে রিফিউজিগাে’ দেশে প্রত্যাবর্তন। চাই কিপ্লেনে কইর্যা টেলিভিশনের ক্যামেরা ম্যান, এ.পি.পি.-র রিপাের্টার মায় রেডিওর জিলুর সাবে পর্যন্ত আইতে পারে। কিন্তু একটা কথা কইয়্যা দেই- বেশি হাউকাউ কইরেন না । মুক্তিবাহিনীর গেরিলাগাে কাছে আইজ-কাইল আমেরিকান মর্টার আর চাইনিজ মেসিনগানের নম্বর খুবই বাইড়া গ্যাছেগা। যে কোনাে টাইমে, যে কোনাে জায়গায় এমনকি ধানের ক্ষেত, পাটের ক্ষেত, আমের বাগান, পানের বােরাে, বাঁশের ঝাড়, মসজিদের পিছন থাইক্যা এই বিদুগুলা হাজির হইতে পারে। হেগাে অহন একটাই শ্লোগান ‘আরে আব ভাগাে, পিন্ডি যাও।- কাহে ভাই শও শও মখর বানাও- আরে আব ভাগাে, পিন্ডি যাও।
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল