১৭ জুন ১৯৭১
আজ-আর একটা ছােট্ট গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। মেয়ের বিয়ে। তাই মেয়ের বাবা তার হবু জামাই-এর চরিত্র সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছিল। গ্রামের একজন মাতব্বর গােছের লােকের কাছে ছেলের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই মাতব্বর সাহেব বললেন, ‘পােলাখান অক্করে সােনার লাখাল, তয় একটা কথা আছে। ভদ্রলােক বললেন, ‘ছেলে যখন সােনর মতাে তখন আবার এর মধ্যে কিন্তু রয়েছে কেন?’
-না, না, না, আমি কইছিলাম কি পােলাডা তাে ভালােই, কিন্তু একটু পিঁয়াজ খায়।
“সে কি কথা আজকালকার ছেলেপেলে একটু পিঁয়াজ-টিয়াজ তাে খাবেই। ‘খালি পিয়াজ খাইলে তাে আপনারে কোনাে কিছুই কইতাম না।’ তার মানে?
না- এই আর কি? যখন একটু বেশি ঝাটা দিয়ে গােস খায় তহন একটুক পিয়াজ খাইতেই হয়, কি কন?’
‘আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে? আজকালকার ছেলেরা মাংস খাবে না সেটা কি করে সম্ভব?’..
মাতব্বর সাহেব মাথাটা খাউজাইয়া বললেন, না, কইছিলাম কি যখন একটুক পানিটানি খাওনের খায়েশ হয়, তহন এই ঝাগােস খায় আর কি?
মেয়ের বাবার চোখ জোড়া ততক্ষণে চশমা ভেদ করে প্রায় বেরিয়ে এসেছে। মাতব্বর দ্রলােক তখন মাটির দিকে তাকিয়ে ডান পায়ের বুড়াে আঙ্গুল দিয়ে মাটির মধ্যে আঁচড় কেটে বললেন, ‘পােলাটার আবার এই কামড়াতে একটুক Habit হইছে কিনা। কিন্তুক আপনে ডরাইবেন না। পােলাখান অক্করে সােনার লাখাল।
সেনাপতি ইয়াহিয়ার এখন এই পােলার অবস্থা। মানুষ মারার ব্যাপারে তার আবার Habit হইয়া গেছে। উনি অহন চাকু-ছােরা লইয়া বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকায় Reception counter খুইল্যা বইয়্যা আছেন। কি বললেন Reception counter? কিন্তু এর আগে তাে কখনও এ ধরনের জিনিস আর দেখিনি? না- এই আর কি? পঞ্চাশ লাখ বাঙালিকে দেশের থনে খেদাইবার পর আবার দাওয়াত করতাছেন।’ কেন আবার দাওয়াত কেন? মুরুব্বী গাে কাছ থনে প্যালা খাইছে। অবশ্য পহেলা কইছিলহেইগুলাে বাঙালি রিফিউজি না- হেইগুলাে কইলকাত্তার ফুটপাতের মানুষ। হের পরে কয়, না পঞ্চাশ লাখ না-হাজার চল্লিশেক হইবার পারে। এলায় যখন সমস্ত দুনিয়ার মাইনষে কইছে যে, পঞ্চাশ লাখ বাঙালিই হিন্দুস্তানে চইল্যা গেছে, তখন দম খিচ্চ্যা খালি দোয়া দরুদ পড়তাছে। তা বলছিলাম কি, এই বাঙালি লােকগুলােকে তাড়িয়ে দিলাে কেন?- তাড়াতে হয়নি এরা নিজেরাই ভাগছে।’
‘কেন- ভাগবার মতাে কি হয়েছিল?
না বেশি কিছু না। এগাে বাড়িঘর সব লুট কইরা জ্বালাইয়া দিছে। ‘এতেই লােকগুলা ভাইগ্যা গেল?
‘না, সাব এগাে বাজারের দোকানগুলাে সব মােসূলেম লীগ, জামাত আর বেহারীরা দখল করলাে?”
“মিলিটারির কাছে কইলে তাে বিচার করতাে?”
“কি কইলেন মেলিটারি করবাে বিচার? হ-অ-অ মেলিটারি সােন্দর বিচার কাইর্যা হেগে জোয়ান মাইয়্যাগুলারে লইয়া গ্যাছে।
‘তা ওদের ছেলেগুলা কি করলাে?’
‘হেই পােলাগুলারে গুলি কইরা মাইরা ফ্যালাইছে। বাকিগুলা মুক্তিফৌজ হইছে।
‘এতেই পঞ্চাশ লাখ লােক সীমান্তের ওপারে চলে গেল?’ বাকি লােক সব করলাে কি?”
হেরা সব টাউন বন্দর আর রাস্তার দুই পাশ থাইক্যা গেরামের মধ্যে পলাইছে।’
‘এদের সংখ্যা তাে আর বেশি হবে না?”
না- তেমন আর বেশি কি, কোটি দু’য়েক হইব আর কি?” ‘তাহলে এরা তাে খেয়ে-পরে বাঁচবে, তাই না?
তা তাে কইতে পারি না। তবে এইটুকু কইতে পরি যে, গেরামের মধ্যে চাল হইতাছে একশ’ টিয়া মন, নুন পাঁচ টিয়া সের আর কেরাসিন গায়েব হইছে।’
‘তাহলে টাকা দিলে তাে জিনিষ পাওয়া যায় কেমন কিনা?
‘টিহা, টিহা পাইবেন কই?’ পাঁচশ’ আর একশ’ টিহার লােট আর চলে না। এক টিক্কা লােটের দাম পাঁচ সিকা হইছে- অহন তাে জিনিস বদলাবদলি শুরু হইছে। আমাগাে ব্যাংকের কারবার আর নাইক্যা।
‘তা এসব কথা ডি.সি.এস.পি.র কাছে বললেই পারেন?’
ডিসি, এসপি? হেগােতাে মাইরা ফালাইছে, না হয় হেরাও ভাগছে- অহন দাগী আর ‘বি’-কেলাসীগাে ডি.সি. বানাইছে। হেরাই অহন আগের ডিসি, আর এসপি গাে ধরবার লাইগ্যা ঘুইরা বেড়াইত্যাছে। এলায় কেমন বুঝছেন, হেগাে কাম কারবার?
‘এসব কেমন করে সম্ভব?
‘হােনেন, কইতাছি। পাকিস্তানের মধ্যেই বাঙালিরা এত বেশি হইলাে কেন?– আর বেশি যখন হইছােসই তহন আবার শেখ সাহেব-এ ইলেকশনে হগুগল সিট লইলাে। কেন? খান কুড়ি সিট যদি ছাইড়া দিতাে?’
কি বললেন, গণতন্ত্রের আবার সিট ছেড়ে দেওয়ার কি আছে তাহলে গণতন্ত্র কিভাবে হলাে?
‘আরে আপনারে আর ক্যামতে বুজামু? পাহিস্তানে সবই সম্ভব। না হইলে দাগী আর ‘বি’ কেলাসিরা ডি.সি. হয়? আর ছােরা, চাকু, মেসিনগান সাজাইয়া Reception counter-এ হেগাে দাওয়াত করে?
তাই বলেছিলাম, সেনাপতি ইয়াহিয়া পােলাখান অক্করে সােনার লাখাল। কিন্তু একটু পেঁয়াজ খায় এলায় বুজছেন কারবারটা কি হইতাছে।’
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল