১৯ জুন ১৯৭১
ঝিমাইতেছেন। আমাগাে জুলফিকার আলী ভুট্টো সা’ব আইজ কাইল ঝিমাইতেছেন। ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারের কাজকারবার দেইখ্যা ভুট্টো সা’ব পহেলা গৰ্গর করছেন। হের পর অভিমান করছিলাইন। হ্যাষে গােস্বা কইর্যা বইস্যা ছিলেন আর অহন ঝিমাইতেছেন। একটা ছােট গল্পের কথা মনে হয়ে গেল। বেশ কিছুদিন আগেকার কথা। ঢাকার মওলবী বাজারে এক ছ্যারায় মুরগি বিক্রি করতে এনেছে। মুরগিটার চুনা ব্যারাম হয়েছিল। তাই দুর্বল হয়ে পড়ায় একেবারে নেতিয়ে পড়ে ঝিমাচ্ছিল। এর মধ্যে একজন গ্রাহক এসে জিজ্ঞেস করলেন, এই ছ্যাড়া মুরগি বেচবি নাহি? তা কত লইবি?” ছেলেটা তড়িৎ উত্তর দিলাে, আপনার কাছে থােনে আর কত লইমু- সাতসিকা পহা দিয়েন কি? শেষ পর্যন্ত দরাদরির পর পাঁচ সিকায় রফা হলাে। কিন্তু মুরগি নেয়ার আগের মুহূর্তে গ্রাহক ভদ্রলােক লক্ষ্য করে দেখলেন মুরগিটা অবিরামভাবে ঝিমুচ্ছে। তাই জিজ্ঞেস করলেন, “আরে কি হইলাে? তাের মুরগি দেহি খালি ঝিমাইতেছে। ছেলেটা ফিক করে হেসে দিয়ে বললাে, “আরে কি কন সাব? মুরগি অক্করে ফাস্ট কেলাস। তয় বুঝছেন নি, কাইল এই মুরগিটা হারা রাইত ধইর্যা কাওয়ালী হুনছে। তাই রাইতে ঘুম না হওনেই মুরগিটা অহন একটুখানি ঝিমাইত্যাছে। জান মােহাম্মদ কাওয়ালের কাওয়ালী আপনেও যদি কাইল হারা রাইত ধইর্যা হুনতেন, তা হইলে অহন আপনেও। ঝিমাইতেন কিনা কন?’
ভুট্টো সা’ব এখন মুরগি হয়েছেন। গত আড়াইমাস ধরে তাঁর নেতা সেনাপতি ইয়াহিয়ার কাণ্ডকারখানা দেখে এখন তিনি ঝিমাইতে শুরু করেছেন। বেচারা এতদিন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছেন যে, বাঘে একবার রক্তের গন্ধ পেলে মানুষের খোঁজে পাহাড় থেকে ধান ক্ষেতে নেমে আসে। তখন সেই বাঘকে হত্যা করা ছাড়া আর কোনাে উপায় থাকে না। ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকার যখন একবার ব্যারাক থেকে বেরিয়ে এসে ক্ষেমতার স্বাদ পেয়েছে, তখন এদের হত্যা না করা পর্যন্ত যে এরা গদী ছাড়বে না- সে কথাটা ভুট্টো সা’ব এতদিন মর্মে মর্মে উপলব্দি করেছেন।
বেচারা ভুট্টো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কত প্ল্যানই না করলেন? একবার বুদ্ধি করলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টি আর পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ যখন বেশি সিট পাইছে তখন দু’ এলাকায় দুটো দল ক্ষমতায় আসলেই তাে ল্যাটা চুকে যায়। আর সেনাপতি ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী যখন পাকিস্তানে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল, তখন কেন্দ্রের ক্ষেমতাটা ওদের হাতে ছেড়ে দিলেই তাে হয়। কিন্তু যত নষ্টের। গােড়াই হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান। এ লােকটা খালি গণতন্ত্র, গণতন্ত্র বলে চেঁচিয়ে সমস্ত কেসডাই মার্ডার করে দিলাে। Election-এ যখন জিতেছিস তখন ক্ষেমতায় যাওয়াটাই তাে আসল কথা। তানা, উনি খালি নীতি-বাক্য আর জনসাধারণের কথাই বলে চললেন। কি রে বাবা, জনসাধারণের কাজ তাে Election-এর আগে- ভােট দেয়ার সময়। Election-এর পরে কোন ব্যাটা আহম্মক জনসাধরণের কথা চিন্তা করে?
এরপর ভুট্টো সাব মেলিটারি পাহারায় ঢাকায় এলেন। Hotel Intercontinentalএর চারপাশে ফুলের বাগানের মধ্যে পাকিস্তানী আর্মি জোয়ানরা মেসিনগান হাতে পজিশন নিলাে। হােটেলের গেটে এক দল মেলেটারি গার্ড বসালাে। Lift-এ দু’জন পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন দাঁড়িয়ে রইলেন। আর সাদা পােষাকে Foreign Trained অবাঙালি কমান্ডােরা Hotel Intercontinental-এর এগারাে তলায় গিস্ গিস্ করতে লাগলাে। এমনকি ভুট্টো সাবের থাকার বিরাট স্যুটটার মধ্যে পর্যন্ত জনা কয়েক পাঞ্জাবি Commando ডিউটিতে রইলাে। আর দু’জন পাকিস্তানী আর্মি ক্যাপ্টেন হগ্গল সময় ভূট্টো সাবের লগে ছায়ার মতাে ঘুরতে লাগলাে। এই নাহলে জননেতা? এতদিনে ধইর্যা হুনছিলাম Commando রা জঙ্গলে লড়াই করে। অহন ভুট্টো সাবের বদৌলতে পাকিস্তানী Commndo-রা দিব্বি ঢাকার Intercontinental-এ লড়াই করবার জন্য ঘাপটি মাইরা রইলা। ভুট্টো সাবের জনপ্রিয়তা দেখে বিদেশী সাংবাদিকদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। এ কি রে বাবা! মধ্যপ্রাচ্য কিংবা আফ্রিকাতেও তাে এ ধরনের দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়নি।
জেদ বড় ভয়ংকর জিনিষ। ভুট্টো সা’ব সেই জেদের বশবর্তী হয়ে সেনাপতি ইয়াহিয়ার বাঙালি হত্যার সমস্ত পরিকল্পনা আর দুরভিসন্ধিতে সায় দিলেন। ২৬শে মার্চ একটা মিলিটারি জিপে ভুট্টো জিন্দাবাদ’ করতে করতে একদল হানাদার সৈন্য ভুট্টোকে করাচীগামী একটা বিমানে তুলে দিলাে। ভূট্টোকে দিয়ে ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারের। যেটুকু কাজ দরকার ছিল, সে কাজ হয়ে গেছে।
সপ্তাহ দুয়েক পরে পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো রাগে গগর করে। এক বিবৃতি ঝেড়ে বললেন, আওয়ামী লীগ বেআইনী ঘােষণার পর আমার পার্টি হচ্ছে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক পার্টি। তাই অবিলম্বে এই পিপলস পার্টির হাতে ক্ষেমতা দিতে হবে। কিন্তু ওদিক থেকে তখন No Reply হচ্ছে। কেননা মাত্র ৪৮ ঘণ্টার লড়াই-এ বাংলাদেশ দখলের যে স্বপ্ন সেনাপতি ইয়াহিয়া দেখেছিলেন, তা ভেঙ্গে খান্ খান্ হয়ে গেছে। কয়েক হাজার হানাদার সৈন্য বাংলাদেশে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছে। আর বাকি। সৈন্যরা বাংলাদেশের ক্যাদো আর প্যাকের মধ্যে আটকা পড়ছে। এই অবস্থায় শুরু হয়েছে মুক্তিফৌজের মাইর।
মাস দুয়েক পরও যখন বাংলাদেশের কোনাে ফয়সালা হলাে না, তখন ভুট্টো সাব অভিমানের সুরে এক বিবৃতিতে বললেন, ‘শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেমতা হস্তান্তর করা হােক। আর এই অঞ্চলে পিপলস পার্টি যখন বেশি সংখ্যক আসন পেয়েছে, তখন এই পার্টির কাছেই ক্ষমতা দেয়া উচিত। কিন্তু কিসের কি? তখন সেনাপতি ইয়াহিয়া দেশের ধ্বসে পড়া অর্থনীতিকে বাঁচাবার জন্য বিশ্বের সমস্ত দেশের কাছে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে হাজির হয়েছেন। বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকা থেকে রফতানীর পরিমাণ একেবারে শূন্যের কোঠায় যেয়ে পৌঁছেছে। স্টেট ব্যাংকের তহবিল অক্করে সাফা।
এরপর শুরু হলাে পশ্চিমা দেশগুলাের পালা। বাংলাদেশের অবস্থা যদি স্বাভাবিক হয়, তাহলে পঞ্চাশ লাখ শরণার্থী দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করাে; আর একটা রাজনৈতিক সমাধানে আসাে। দু’দল সাংবাদিককে জঙ্গী সরকার দাওয়াত করে আনলেন। কিন্তু এরা কর্মক্ষেত্রে ফিরে গিয়ে যে রিপাের্ট দিলেন, তাতে সমস্ত সভ্য জগৎ স্তম্ভিত হয়ে গেল। এরপর আটজন পশ্চিম পাকিস্তানী সাংবাদিক বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকা ঘুরে এলেন। কিন্তু এর মধ্যে একজন এন্টনি ম্যাসকারেনাস আবার বউ পােলাপান লইয়া লন্ডনে ভেগে যেয়ে Sunday Times-এ এক Report দিয়ে ইসলামাবাদ সরকারকে অক্করে হােতাইয়া ফালাইছেন। অবার বিশ্ব ব্যাংক প্রতিনিধিদল সফর করতে এসে অবস্থা দেখে ভিড়ি খেয়ে পড়েছেন। আর জাতিসংঘের প্রতিনিধি প্রিন্স সদরুদ্দিন আগাখান তাে বলেই দিয়েছেন, শরণার্থীরা দেশে ফিরে গেলে এদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারি না। হগুগলের শেষে আইলেন বৃটিশ পার্লামেন্টারি দল।
ভুট্টো সা’ব এলায় গােস্সা হয়ে এক Statement ঝাড়লেন। এটা পাকিস্তানের পক্ষে খুবই অপমানজনক। আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে এভাবে বাইরের শক্তিকে নাক গলাতে দেয়া উচিত নয়। কিন্তু ইয়াহিয়ার যে উপায় নাইক্যা। যে গাই দুধ দ্যায় হের লাথিডাও তাে মিডা লাগে। অহন যে সাবের মাল-পানির দরকার হইছে, বুঝছেন। তাই আড়াই মাস ধরে কাওয়ালী হুইন্যা অর্থাৎ কিনা ইয়াহিয়া সা’বের কায়-কারবার দেখবার পর জুলফিকার আলী ভূট্টো অহন অঙ্কুরে ঝিমাইয়া পড়ছেন।
আর ঝিমাইতে ঝিমাইতে একটা বিবৃতি ঝাড়ছেন, বাজেট লইয়া ব্যস্ত থাহনের জন্যি ইয়াহিয়া সাবের ক্ষেমতা হস্তান্তরের কান্ডা একটু দেরী হইতাছে। না হইলে ওনার মনডা খুবই পরিস্কার। খালি কতকগুলা অফিসার, ব্যবসায়ী আর হারু পার্টির দল তেহাইনরে ভুল পথে চালাইতেছে। তাই বলেছিলাম, ভুট্টো সা’ব এলায় মুরগি বন্ গিয়া। হেই মুরগির আবার চুনা-বিমার হইছে। তাই সা’বে আইজ-কাইল সিন্ধুর লারকানায় বইস্যা শুধু ঝিমাইতছেন।
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল