You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.20 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

২০ জুন ১৯৭১

যব দিল হি টুট গিয়া, ম্যায় জ্বী কে কেয়া করু? যহন মনডাই ভাইঙ্গ্যা গেছে, তহন বাইচ্যা থাইক্যা আর লাভ কি?’ সেনাপতি ইয়াহিয়ার দিল্ডা অক্করে ফাতা ফাতা হইয়া গেছে। অনেক বুদ্ধি আর প্রচেষ্টার পর বাংলাদেশের নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ধামাচাপা দিয়ে ইয়াহিয়ার দূত এম.এম. আহম্মদ এইড পাকিস্তান কনসর্টিয়ামে কয়েকশ’ কোটি টাকা ধার করবার যে দরখাস্ত করেছিলেন তা অহন অক্করে চাংগে উঠছে। কনসর্টিয়ামের চেয়ারম্যান মিঃ পি.এম. কারঘিল একটা ছােট্ট চিঠিতে সেনাপতি ইয়াহিয়াকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত নতুনভাবে মাল-পানি। ঝাড়া সম্ভব নয়। অবশ্য স্বাভাবিক অবস্থা বলতে কি বুঝায়, হেইডাই ইয়াহিয়া সাবের দেমাগে আইতাছে না ইসলামাবাদের শাসকচক্রের মতে পাকিস্তানে বছরের পর বছর ধরে সামরিক শাসন চালু থাকাটাই তাে স্বাভাবিক অবস্থা? এর আগে তাে সামরিক শাসন চালু থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমা দেশগুলাে থেকে অবিরাম সাহায্য এসেছে? এমনকি মস্কোপিকিংও টাকা পয়সা দিতে কসুর করেনি। কিন্তুক এই বছর এইড্যা কি কারবার হইতাছে? বাংলাদেশের ব্যাপারটা তাে Internal Affair?
‘হায় হায় হামি ইডা কি করছিনু রে? হামি ক্যা নানীর বাড়ী আছি? হামি ক্যা এই বােকামী করিছিনু রে?’ গল্পটা তাহলে বলেই ফেলি। মহা ধুরন্ধর ছেলে। তার। দুষ্টামীতে শুধু বাড়ি নয়, সমস্ত পাড়াটা পর্যন্ত অস্থির। এহেন ছেলের খা করানাের ব্যাপারে বাপ-মা খুবই বিপদের মধ্যে পড়লেন। দু’তিনবার চেষ্টা করে বিফল হইবার পর ছেলের নানীর শরণাপন্ন হলেন। কাছেই নানীর বাড়ি। নানী খতনা করানাের সমস্ত ব্যবস্থা করে নাতিকে পিঠা খাওয়াবার লােভ দেখিয়ে নিয়ে এলেন। অনেক ধ্বস্তাধ্বস্তির পর কারবার হয়ে গেলে ছেলেটা চিৎকার করে বলতে লাগলাে, হায়, হায় হামি ইডা কি করছিনু রে? হামি ক্যা নানীর বাড়ীত অচছিনু রে? হামি ক্যা এই বােকামী করিছনু রে?” সেনাপতি ইয়াহিয়ার এখন সেই অবস্থা। বেচারা এখন চিৎকার করে বলছে, হামি ক্যা ইলেকশন দিছিনু রে? হামি ক্যা এক মাথা এক ভােট করছিনু রে? হামি ক্যা এই বােকামী করনু রে?”
সমস্ত গণতান্ত্রিক বিশ্ব এখন শুধু একটা কথাই বলছে যে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে সৈন্য প্রত্যাহার করাে। তাহলেই স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে। কিন্তু ওরা উডা বুঝবার পারে না, আমি যে ভােগা মারছিনু রে। হামি ভাবছিনু হামাগােরে দালালরাও তাে কিছু সিট পাবি? ফ-কা, ফরিদ-মাহমুদ-সবুর-আজম সবই যে Election-এ গুড়া হবি- ইডা ক্যাংকা করে হয়? হামার লােকজন যে সবাই হারু পার্টি হয়ে গেল? অহন উপায়! পাকিস্তানের পার্লামেন্টের ৩১৩ ডা সিটের মাইদ্দে শেখের বেড়াই যে ১৬৭ডা পাইছে। আর হেতাইনরা অহন আমারে বুদ্ধি দিতাছে হের কাছে ক্ষেমতাড়া দিয়া দেই আর কি? তয় তাে বাংলাদেশ ছাড়াও গােড়াল পাকিস্তানডাই তাে শেখের হাতে যাইবাে? তা হইলে আমরা কি বুড়া আঙ্গুল চুসবাইম?
এ হেন অবস্থাতে সেনাপতি ইয়াহিয়া একমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষেমতা হস্তান্তর ছাড়া বাংলাদেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে বুঝাবার জন্য সমস্ত রকমের। ফন্দি আটলেন। প্রথমে মুক্তিফৌজের ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর পুলিশদের ডেকে পাঠালেন। তারা এল বটে। কিন্তু তারা গেরিলার বেশে এসে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে কিছু হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়ে গেল। এরপর সেনাপতি ইয়াহিয়া হঠাৎ করে বললেন, মাফ করে দিলাম। আপনাদের সব মাফ করে দিলাম। বাঙালি ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-মজুর, ডাক্তার, এডভােকেট, আওয়ামী লীগ নেতা মায় মুক্তিফৌজ পর্যন্ত ফিরে এসে দেশ গঠনের কাজ করুন।
দিন কয়েকের মধ্যে দখলকৃত এলাকার শ’খানের ব্রিজ আর কালভার্ট উড়ে গেল। এবার সেনাপতি ইয়াহিয়া বাঙালি শরণার্থীদের জন্য বিশটা Reception counter খুলে পােলাও-কোর্মা পাকিয়ে বসে রইলেন। মুক্তিফৌজের গেরিলারা ৫৯ জন হানাদার সৈন্য জ্যান্ত ধরে নিয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত সেনাপতি মহাশয় বিশেষ করে হিন্দু রিফিউজিদের দাওয়াৎ করে বসলেন। সবাই কানের মধ্যে আঙ্গুল দিয়ে চুলকিয়ে ব্যাপারটা ভালাে করে বুঝতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার আগেই রিপাের্ট এলাে মুক্তিফৌজের ক্যাচকা মাইর আরাে জোরদার হয়েছে। ঢাকার আশপাশেই এখন বিক্ষুগুলা ঘুইরা বেড়াইতেছে। | Situation এখন Normal হওয়ার বদলে দিনকে দিন আরাে Abnormal হইতাছে। হানাদার বাহিনীর কয়েক হাজার ঘুমাইতেছে। মানে কিনা হেই ঘুম আর ভাংগবাে নাইক্যা।
আর হাজার দশেক জখমী হইছে। বাকিগুলা আল্লাহ্ আল্লাহ করতাছে। হেইদিন ঢাকায় এক ক্যাপ্টেন বারাে কপি ফটো তুইল্যা গুজরানওয়ালাতে আম্মাজানের কাছে পাঠাইছে- যদি আর ফিরতে না পারি।’কারবারটা এলায় ক্যামন বুঝতাছেন?
আল্লাহর মাইর, দুনিয়ার বাইর। বাংলাদেশ আক্রমণের মাত্র এক মাসের মাথায় ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারের ভগ্নদূত এম.এম. আহম্মদ এইড-পাকিস্তান কনসর্টিয়ামকে জানালাে যে, তাদের পক্ষে জুন মাসের মধ্যে পঁয়তাল্লিশ কোটি টাকার ধার পরিশােধ করা সম্ভব নয়। এখন হাত খুবই টান। কনসর্টিয়ামের সদস্যভুক্ত দেশগুলাের প্রতিনিধিদের ভ্রু কুঁচকে গেল। ব্যাপারটা কি? তাহলে তাে ডাল মে কুছ কালা মালুম হােতা হ্যায়। ৩০শে এপ্রিল প্যারিসে কনসর্টিয়ামের এক বৈঠক হলাে। বৈঠকে ঢাকাস্থ বৃটিশ হাইকমিশনার মিঃ সার্জেন্টকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রিপাের্ট চাওয়া। হলাে। মিঃ সার্জেন্ট ধীর স্থির ভাবে ২৫শে মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের ঘটনার হুবহু বর্ণনা দিয়ে বললেন, অবস্থা যা চলছে তাতে নতুন করে ধার দেয়া তাে দূরের কথা আগের টাকাই পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। শ্যাষ- মানে কিনা পাকিস্তান আর বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থা অক্করে শ্যাষ হইয়া গেছে। অহন হেইখানে Mango আর Gunny ব্যাগ হগ্গলই যাইবাে। সুদ তাে দূরের কথা আসলডাও আর পাওয়া যাইবাে না। এই রিপাের্টই কাম হইলাে। কনসর্টিয়ামের চেয়ারম্যান মিঃ পি.এম. কারঘিল ইসলামাবাদের আইস্যা হাজির হইলেন।
কারগিল সা’বে যাওনের সময় করাচীতে কইলেন, ‘এইডের কথা কইতে পারি না, তয় চাল ডাল দিতে পারি। এরপর ঘটনার দ্রুত পরিবর্তন ঘটলাে। বিশ্ব ব্যাংকের একটা প্রতিনিধি দল ইসলামাবাদ আর বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকা সফর করলেন। ফিরে যেয়েই রিপাের্ট দিলেন ‘Case’ খুবই খারাপ। ইয়াহিয়া সরকারকে কোনাে রকম সাহায্য দেয়া পশ্চিম দেশগুলাের উচিত হবে না। নিউইয়র্ক টাইমসের এই খবরে ইসলামাবাদে অহন Black out হইছে। মানে কিনা শােকের ছায়া পড়ে গেছে। এর আগেই সুইডেন সরকার জঙ্গী সরকারকে সমস্ত রকমের সাহায্য দান বন্ধ করার কথা ঘঘাষণা করেছেন। আর এইড পাকিস্তান কনসর্টিয়ামের বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়ে গেছে।
এদিকে ফরমােজার প্রেসিডেন্ট চিয়াংকাইশেক বলেছেন যে, সৌদী আরবের বাদশাহ ফয়সাল হচ্ছেন স্বাধীন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা।’ সেই সৌদী আরবের বাদশাহ ইয়াহিয়া সা’বের কাছে নস্যির গুড়ার মতাে তিন কোটি টাকা সাহায্য পাঠিয়ে সমর্থন দিয়েছেন। আর যায় কোথায়?রেডিও গায়েবী আওয়াজ থাইক্যা হেই কথাড়াই বার বার কইর‌্যা চিল্লাইত্যাছে। কিন্তুক খােদ ইয়াহিয়া সা’বে অহন বিছানার মইধ্যে হুইত্যা পড়ছেন। আর হুইত্য হুইতা কইত্যাছেন, হায়! হায়! হামি ইডা কি করছিনু রে? হামি ক্যা ইলেকশন দিছিনু রে? হামি ক্যা এই বােকামী করনু রে? হামি ক্যা নানীর বাড়ী আচুছিনু রে?’ য দিল হি টুট গিয়া ম্যায় জ্বীকে কেয়া করু?’ যহন মনডাই ভাইঙ্গ্যা গ্যাছে, তহন বাইচ্যা থাইক্যা আর লাভ কি?

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল