You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.18 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

১৮ জুন ১৯৭১

চেইত্যা গেছে। ইসলমাবাদের জঙ্গী সরকারের প্রচার যন্ত্রগুলাে অহন অক্করে চেইত্যা গ্যাছে। পশ্চিমা দেশগুলাের সংবাদপত্রে বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকার আসল খবরগুলাে রােজ ফলাও করে ছাপা হওয়াতেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। করাচী। বেতারকেন্দ্র এখন তিন ভাষায় উর্দু, বাংলা আর ইংরাজিতে গাল শুরু করেছে। Voice of America বলেছে, বাংলাদেশে পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনী মানবতা বিরােধী এক কল্পনাতীত অবস্থার সৃষ্টি করেছে। জেনারেল ইয়াহিয়া বাঙালি শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাবার যে আহ্বান জানিয়েছেন আর জেনারেল টিক্কা সবাইকে ক্ষমা করে দেবার যে ঘােষণা করেছেন তা’ চাতুরী ছাড়া আর কিছুই নয়। আসলে বাংলাদেশের পরিস্থিতির কোনাে উন্নতিই হয়নি। লন্ডনের ডেইলি মেল’ পত্রিকা বলেছে যে, এখন আমরা পরিস্কারভাবে বুঝতে পেরেছি কোন্ অবস্থায় ভীত সন্ত্রস্ত্র পঞ্চাশ লাখ বাঙালি দেশত্যাগ করেছে? ডেইলি মেল পাকিস্তান সরকারকে সন্ত্রাসবাদী সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা লিখেছেন যে, সম্প্রতি জেনারেল ইয়াহিয়া একটা বৃটিশ পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দলের কাছে স্বীকার করেছেন যে, বাংলাদেশে তার সৈন্য বাহিনী খুবই দ্রুত Action নিয়ে চলেছে। ডেলি মিররে’র মন্তব্য, বাংলাদেশের ঘটনাবলী শুধুমাত্র উপমহাদেশের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে তাই-ই নয়- এর ফলে বিশ্বশান্তি পর্যন্ত বিঘ্নিত হতে চলেছে।
এদিকে মাঞ্চেষ্টার গার্ডিয়ান পত্রিকা জাতিসংঘের কাছে আহ্বান জানিয়ে এই মুহূর্তে রাজনৈতিক কর্মপন্থা গ্রহণ করে বাংলাদেশের সংকটের নিরসনের কথা বলেছেন। শুধু তাই-ই নয়- গার্ডিয়ান পত্রিকা ১৪ই জুনের এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে জেনারেল ইয়াহিয়াকে বাংলাদেশে নিধনযজ্ঞ বন্ধ করে রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। গার্ডিয়ান পত্রিকা অবিলম্বে বাংলাদেশে শরণার্থীদের ফিরে যাবার পরিস্থিতি সৃষ্টির কথা বলেছেন। গডিয়ানের মতে পাকিস্তানের বর্তমান সংকট কোরিয়া, ভিয়েতনাম, প্যালেষ্টাইন আর বায়াফ্রার চেয়েও ভয়ঙ্কর ও ভয়াবহ।
এরপর আবার বিবিসি এ মর্মে তথ্য প্রকাশ করেছেন যে, দিন দশেক বিরতির পর আবার লাখ লাখ শরণার্থী বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করতে শুরু করেছে। আর যায়। কোথায়? সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকারের প্রচারযন্ত্রগুলাে একেবারে রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেছে। অবিরাম ভাবে প্রলাপ বকে চলেছে। এই প্রলাপের ফাঁকে যেটুকু কথা পাওয়া যাচ্ছে তাতে বােঝা যায় যে, করাচী বেতার থেকে শুরু করে জঙ্গী সরকারের সমস্ত প্রচারযন্ত্রগুলাে অহন অক্করে ঘাউয়া হয়ে উঠেছে। কেননা এখন এদের একটা মাত্রই দায়িত্ব যে, দুনিয়াকে বােঝানাে বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকা থেকে আর কেউই সীমান্ত পার হচ্ছে না। বরং হাজার হাজার শরণার্থী এখন বগল বাজাতে বাজাতে ফিরে আসছে।
কিন্তু মেহেরপুরে এক হাজার শরণার্থী ফিরে আসবার খবরে টিক্কা-সরকার একেবারে আহ্লাদে আটখান হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন তার বক্তৃতা আর রেডিও গায়েবী আওয়াজের propaganda-র চোটে সব ফিরে আসতে শুরু করেছে। ভালাে করে Enquiry-র পর যখন দেখা গেল, যারা ফিরে এসেছে তারা তন্দুর রুটি আর শিক কাবাব খায়, তারা ডাহিনা মুড়া দিয়া ল্যাহে আর গােসলের কারবার করে না; তখন টিক্কা সাব অক্করে চিৎ হইয়া পড়ছেন। অহন উপায়?
সংগে সংগে Order হলাে, বর্ডার সিল করে Bunker বানিয়ে শরণার্থী যাওয়া বন্ধ করাে। আর গ্রামের মধ্যে থেকে বাঙালি ধরে এনে Reception counter ভরে ফেলাে। দিন কয়েক কারবার ঠিকই চললাে। কিন্তু তার পরেই শুরু হলাে মুক্তিফৌজের ক্যাচকা মাইর। মাইর রে মাইর- মাইরের চোটে মছুয়াগাে লাশ ফালাইয়া সব ভাগােয়াট। কিন্তুক ভাগােয়াট মছুয়ারা গ্রামের মধ্যে নিরস্ত্র মানুষের উপর অত্যাচার চালালাে। ফলে আবার লাখ লাখ বাঙালি শরণার্থী সীমান্ত পাড়ি দিতে শুরু করলাে। বেচারা B.B.C. এই শরণার্থীদের সীমান্ত পাড়ি দেবার খবরটা শুধু ফাঁস করে দিয়েছে। আর ব্রিটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকার টেলিভিশনে এসব ছবি দেখাতে শুরু করেছে। তাই জঙ্গী সরকার এখন গরম ঝাড়তে শুরু করেছেন। পশ্চিমা দেশগুলাের সংবাদপত্রের উপর ইয়াহিয়া সরকারের প্রচারযন্ত্রগুলাের বেধড়ক চোটপাট শুরু হয়েছে। হলুদ রং-এর চশমা পরে এরা সমস্ত দুনিয়াটাকেই এখন হলদে দেখতে শুরু করেছে। কিন্তু গােলাম হােসেন, উপায় নেই গােলাম হােসেন। World Bank-এর একটা টিম সম্প্রতি চিটাগাং-এ গিয়ে দেখতে পেয়েছেন যে, হানাদার বাহিনী বেয়নেটের আগায় চিটাগাং পাের্টে কিছু অধ্যাপক আর শিক্ষিত লােককে কাজ করতে বাধ্য করেছে। বিশ্ব ব্যাংক টিম আরাে দেখেছে যে, প্রায় শ’খানেক অবাঙালি শ্রমিক একটা কাপড়ের কল চালু করবার জন্য কি প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাই না চালিয়ে যাচ্ছে! ইপিআইডিসির একটা শিল্প প্রকল্পের সমস্ত শ্রমিকদের সংগে জাপানি কারিগরেরাও ভেগে গেছেন। সেখানে কিছু তেলাপােকা আর ইঁদুর ছাড়া আর কিছুই নেই।
বিশ্ব ব্যাংকের তদন্তকারী টিম একটা ট্যানারিতে যেয়ে হতবাক হয়ে দেখলেন কাঁচা চামড়া পাহাড় হয়ে পড়ে রয়েছে আর তার দুর্গন্ধে আশে পাশে এগুনাে যাচ্ছে না। মার্চ মাসের পর কোনাে আদম সন্তানই এ ট্যানারিতে পা বাড়ায়নি। তাই বিশ্ব ব্যাংক টিমের সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের মাঝ দিয়ে যাবার সময় জনশূন্য নগরী ও ধ্বংসস্তুপগুলাে দেখে অবাক বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে পড়লেন। তাঁরা বুঝলেন যে, ইসলামাবাদের আলােচনা আর সরেজমিনে তদন্তের মধ্যে আসমান-জমিনের ফারাক্। এসব ঘটনার আন্দাজ করেই এদিকে জাপান সরকার ঘােষণা করেছেন সব কিছুর পরিস্কার রিপাের্ট না পাওয়া পর্যন্ত তাদের পক্ষে ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারকে সাহায্য দেয়া সম্ভব হবে না। খােদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও জঙ্গী সরকারকে সাহায্য দেয়ার ব্যাপারে তুমুল বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়েছে। তাই বলেছিলাম চেইত্যা গেছেন। হানাদার বাহিনীর আসল কাণ্ড-কারখানার কথা ফাঁস কইরা দেয়ায় সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকারের প্রচারযন্ত্রগুলাে পশ্চিমা সংবাদপত্রের উপর অক্করে চেইত্যা গেছেন।

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল