You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.22 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

২২ জুন ১৯৭১

ছক্কু মিয়া। আমাগাে বকশি বাজারের ছক্কু মিয়ারে চেনেন না? বেড়া একখান! অক্করে বাদশার জাত। কিন্তু অইজ কাইল অবস্থাটা একটু খারাপ হইছে। কামাই-পাতি নাই কিনা। হেইর লাইগ্যা মাইনষের থনে পরায়ই ধার কর্জ করে আর কি? কিন্তুক হের একটা আবার Habit আছে। যদি কাউর তনে একবার ধার লইবার পারে, তয় হেই লােকের। কান্ডা সারা। মানে কিনা ঘুরতে ঘুরতে পায়ের চাম ছিল্যা ফেলাইলেও ছক্কু মিয়ার থনে আর টাকা ফেরত পাইবাে না। তাই মহল্লার যেসব মাইনষের দেমাকে একটু বুদ্ধি আছে, তারা ছক্কু মিয়ার লগে দেহা হইলেই কয়, ‘আবে এই ছক্কু মিয়া, খুবই বিপদের মইধ্যে পড়ছি, কয়ডা টিহা ধার দিবা?’ অমনি ছক্কু মিয়া বাইশ হাজার টাকা দামের একটা হাসি দিয়া কইবাে, ‘এঃ হেঃ, কাইলও যদি কইত্যা? কিন্তুক আইজ তাে আমি নিজেই বাইর হইছি ধার করণের লাইগ্যা। এ হেনাে ছক্ক মিয়া একবার কালু মিয়ার হাতে ধরা পড়লাে। কালু মিয়ার থনে দশটা টাকা ধার করেছিল। কিন্তুক ছয় মাসের মধ্যেও হেই ধার আর Clear হইলাে না। কালু মিয়া বহু ঘােরাঘুরি কইর‌্যা ঠিক করলাে একবার কায়দা মতাে পাইলেই ছক্কু মিয়ারে তক্তা বানাইবাে।
হেইদিন ছিল জুম্মা। দোকানপাট সব বন্ধ। দুপুর বেলায় ছক্কু মিয়া যাইতাছিল খাজে দেওয়ানের দিকে। কিন্তু হের কপালডা খারাপ। বাের্ড অফিসের সামনে আকা কই থনে কালু মিয়া আইয়া হের ঘেডিটা ধইর্যা দে মাইর। মাইর-মুইর খাইয়া ছকু মিয়া বাড়ির দিকে গেল গা। হের পরের দিন মহল্লার মাইনষে কইলাে, আবে ওই ছক্কু মিয়া, কাইল বলে কালু তরে মেরামত করছে?”
ছােট্ট একটা উত্তর এল, হ-অ-অ।
‘কিরে এই ছক্ক, তাের বলে ঘেড়ি ধরছিল?
এবার উত্তর এল, ‘হ-অ-অ।
‘আবার বলে গালে থাপড়াইছে?”
‘হ-অ-অ, দুইডা থাপ্পর দিছিলাে।
‘তােরে বলে আবার লাথ মারছে?”
এবার ছক্কু মিয়া একটু উত্তেজিত হয়ে বললাে, “লাথ মারছে, লাথ মারলে কি অইবাে- আমারে তাে আর Idiot কইতে পারে নাইক্যা?’
পাকিস্তানের অবস্থা অহন এই ছকু মিয়ার অবস্থা। সমস্ত গণতান্ত্রিক বিশ্ব পাকিস্তানের কার্যকলাপে ধিক্কারে সােচ্চার হয়ে উঠেছে। গণতান্ত্রিক রায়কে ধূলিসাৎ করে লাখ লাখ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়ে একটা দানবীয় পশুশক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখবার যে হীন আর কুৎসিত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে প্রতিটি বিবেকসম্পন্ন মানুষই আজ তার সমালােচনায় মুখর হয়ে উঠেছে। নিউইয়র্ক টাইমস, লন্ডন টাইমস, সানডে টাইল্স, ডেইলি মিরর, ডেইলি মেল, আশাহি সিমবুন, আল-আখিবার, টাইম, নিউ টাইমস প্রভৃতি বিশ্বের প্রতিটি সংবাদপত্র ছাড়াও বিবিসি, ভােয়া, এবিসি থেকে শুরু করে রেডিও প্রাগ ও স্টকহােম রেডিও আর টেলিভিশন কেন্দ্রগুলাে ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারের মানবতা বিরােধী কার্যকলাপের তীব্র ভাষায় নিন্দা করে চলেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আইন পরিষদগুলাে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করে সেনাপতি ইয়াহিয়া সরকারের মারাত্মক সমালােচনা করে চলেছে। বুদাপেস্ট শান্তি সম্মেলন আর জেনেভার আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনে ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারের নিন্দা করা হয়েছে।
জাপান সরকার বলেছেন যে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিষ্কার রিপোের্ট না পাওয়া পর্যন্ত এবং রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা না হওয়া পর্যন্ত তাদের পক্ষে আর সাহায্য দেয়া সম্ভব হবে না। | সুইডিশ সরকার তাে এর মধ্যেই ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারকে সমস্ত রকমের সাহায্য বন্ধের কথা ঘােষণা করেছে। ফরাসি সরকার অবিলম্বে বাংলাদেশে একটা গণতন্ত্র সম্মত রাজনৈতিক সমাধানের দাবি জানিয়েছে। কানাডা সরকারও এক বিবৃতির মাধ্যমে নিজেদের মনােভাব স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছে। সােভিয়েট রাশিয়া অবিলম্বে বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে রাজনৈতিক ফয়সালার কথা বলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত ২৫শে মার্চ থেকেই পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দেয়া বন্ধ রেখেছে। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, সিনেটর গ্যালাগার প্রমুখ সেনাপতি ইয়াহিয়ার সমালােচনা মুখর হয়ে উঠায় আর বাংলাদেশের বিস্তারিত তথ্য পাওয়ার পর নিকসন সরকারও বেসামরিক সাহায্য দেয়া আপাততঃ বন্ধ করেছে।
করাচীর দৈনিক ডন পত্রিকায় প্রকাশিত একটা ফটো থেকে যখন একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশের নভেম্বর সাইক্লোনের দুর্গত মানুষদের সেবায় দ্রুত রিলিফ দ্রব্য পাঠানাের জন্যে যেসব যান্ত্রিক নৌকা দেয়া হয়েছিল, সেগুলাে এখন হানাদার সৈন্যরা নিজেদের কাজে লাগাচ্ছে, তখন মার্কিন জনসাধারণ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে। জল্লাদের কার্যকলাপে আজ সমস্ত সভ্য জগৎ স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে।
পাকিস্তান আর বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ায় মার্কিন সরকার দারুণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। নতুন ধার দেওয়া তাে দূরের কথা, আগের টাকার চিন্তাতেই যুক্তরাষ্ট্র এখন অস্থির হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের মিল আর কলকারখানাগুলাে চালু রাখবার জন্য আমেরিকা যে আট কোটি ডলারের Commodity Aid দিবে বলে আভাষ দিয়েছিল, তা এখন বন্ধ করে দিয়েছে। কেননা গত তিন মাস ধরে পাকিস্তানের মিলগুলাে বাংলাদেশের তৈরী মাল বিক্রি করতে
পারায় সেখানকার গুদামগুলাে ভর্তি হয়ে গেছে। শুধু তাই-ই না, এর মধ্যেই অনেকগুলাে মিল বন্ধ হয়ে গেছে। আর অন্য মিলগুলােতে মাত্র এক Shift-এ কাজ হচ্ছে। এমন একটা অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসলামাবাদকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে, অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আট কোটি ডলারের Commodity Aid দেয়া বন্ধ রাখা হলাে। কেননা বাংলাদেশের বাজার যখন পাকিস্তানীদের হস্তচ্যুত হয়েছে তখন পাকিস্তানের মিলগুলাে চালু রাখার জন্য সাহায্য দেয়া অর্থহীন।
এদিকে সেনাপতি ইয়াহিয়া সরকারের অবস্থা কুফা দেখে এইড পাকিস্তান কনসর্টিয়ামের বৈঠক অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ কিনা আপাতত মাল-পানি আর দেয়া হবে না।
কিন্তুক যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। তাই ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকার অহন দম খিচ্চা Fight করতাছে। হেতাইনের কেউ ঘেড়ি ধরছে, আবার কেউ থাপ্পর মারছে, তাহলে কি হইবাে। সেনাপতি ইয়াহিয়া অহন ছক্ক মিয়া অইছে। দাঁত বাইর কইর‌্যা কইতাছে, ‘আমারে তাে কেউ Idiot কয় নাইক্যা?

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল