You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.28 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

২৮ জুন ১৯৭১

অক্করে সাফ। ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারের স্টেট ব্যাংকের খাজাঞ্চীখানা অক্করে সা হইয়্যা গেছে। বাংলাদেশের লড়াইয়ের চোটে হানাদার সৈন্যদের খরচা যােগাইতেই এই কারবারটা হইছে। বেশি না- দিনে দেড় কোটি টাকা কইর‌্যা খরচ হইতাছে। তিন মাসের লড়াই চালাতে যেয়েই সেনাপতি ইয়াহিয়ার সরকারের অবস্থা একেবারে কেরাসিন হয়ে গেছে। তাই এবারের বাজেটে এক চমৎকার ব্যবস্থা হয়েছে। যেসব অফিসারের বেতন পাঁচশ’ টাকার উপর তাদের পাঁচশ’ পর্যন্ত পাঁচ টাকা-দশ টাকা-এক টাকার নােটে আর বাকি বেতন ডিফেন্স সেভিংস সার্টিফিকেটে দেওয়া হচ্ছে। এলায়। হেগাে কারবারটা কি হইতাছে বুঝতেই পারছেন। বাংলাদেশের যুদ্ধের জন্যই ওদের এ অবস্থা হয়েছে। সেনাপতি ইয়াহিয়া এহন তার অফিসারগাে মাইনার টাকার থনে যুদ্ধের খরচা যােগাইতেছেন। আর অফিসারগাে দশ বছর মেয়াদী ডিফেন্স সেভিংস সার্টিফিকেট দিতাছেন।
‘আহলাদের সখের ময়রাণী আর কি?’ দশ বছর বাদ ইয়াহিয়া সা’বে বাঁইচা থাকলে- আর যদি হের গদি টিকা থাকে। আর যদি হের হাতে মাল-পানি হয়, তা হইলে এইসব অফিসারেরা দেড়গুণ টাকা পাইবাে। এলায় বুঝছেন, তিনমাস লাড়াই চালাইতেই যাগাে কাপড় বাসন্তী রং হইছে, তাঁরা হেগাে অফিসারগাে কি একটা গেঞ্জামের মধ্যে ফেলাইছে। জিনিষপত্রের দাম যা হয়েছে তাতে পাঁচশ’ টাকায় তাে একজনেরই পক্ষে মাস চালানাে বিপদ। অহন বেডারা পােলাপানরে খাওয়াইবাে কি? আর মাঝে-সাঝে একটুক পানি-টানি খাইতাে হেইডার বা কি হইবাে?
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে পাকিস্তানী টাকার অবস্থা খুবই কাহিল হয়ে পড়েছে। যেখানে এক ডলারের সরকারি দাম হচ্ছে চার টাকা ছিয়াত্তর পয়সা, সেখানে এখন একুশ টাকা দিয়েও একটা মার্কিন ডলার কিনতে পাওয়া যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক ইস্যুরেন্স কোম্পানিগুলাে এর মধ্যেই পাকিস্তানে পাঠানাে জিনিষপত্রের বীমা করতে অস্বীকার করেছে। আর বিদেশী কোম্পানিগুলাে একশ’ পার্সেন্ট মার্জিন না হলে কারবার করছে না । অবশ্য হেগাে Export-Import-এর কারবার গেল তিন মাস ধইরাই বন্ধ রইছে। বাঙালিরা Export বন্ধ করছে। মানে কিনা পাট, চা, চামড়া, পাটজাত দ্রব্যের Export বন্ধ রইছে। আর ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকার Import বন্ধ করছে। পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের খাজাঞ্চীখানায় মাল-পানি নাই দেইখ্যা ইয়াহিয়া সা’বে ২৪শে এপ্রিলের যে ফরমান মােতাবেক ১২৪ রকমের মাল Import বন্ধ রেখেছিলেন, হেই order এখানাে চালু রইছে। আর না থাইক্যাই বা উপায় কি? অবস্থা খুবই খতরনাক।
সেনাপতি ইয়াহিয়ার ধারকর্জ শােধ দেওনের ক্ষমতা নাই দেইখ্যা Aid-Pakistan consortium-এর দেশগুলাে এখন টাকা দেয়া বন্ধ রাখছে। হেইর লাইগ্য সেনাপতি ইয়াহিয়ার Advisor এম.এম. আহাম্মক খালি হাতে ফিইরা আইস্যাই খুব চোটপাট শুরু করছেন। মওলবী সা’ব তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, বিশ্বের ধার দেউন্যা দেশগুলাের অহন আমাগাে টাকা না দেওনের Policy হইতাছে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হাত দেওনের মতাে। এলায় বুঝছেন, আহম্মক সা’বের Point টা কেমন কড়া। টাকা ধার দিলেই আরাে মানুষ মারুইন্যা যন্ত্র কিনতে পারতাে। আর হেই সব যন্ত্র দিয়া বাংলাদেশে সােন্দর Fight টা চালাইতে পারতাে। অহন টাকা ধার না দেওনে সব গড়বড় হইয়া গ্যাছেগা।
তাই আহম্মক সা’বে তার বাজেট বক্তৃতায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলেছেন, কারাে উপর নির্ভরশীল না হয়ে আমরা নিজেরাই নিজের পায়ে দাঁড়াবাে।’ এই কথা না কইয়্যাই বেডায় অহন ডিফেন্স সেভিংস সার্টিফিকেটে অফিসারদের বেতন দেওনের ব্যবস্থা করেছেন। আর এদিকে রেডিওতে এই গরম বক্তৃতা শুনে জঙ্গী সরকারের সামরিক আর বেসামরিক অফিসারেরা সার্টের বােতাম খুলে সাদা পাকা চুলওয়ালা বুক থাপড়িয়ে মাতম করতে শুরু করেছেন।
কিন্তু ইসলামাবাদের বাজেটটা ভালাে মতাে লক্ষ্য করে অনেকেই দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ছয়শ’ কোটি টাকা বাজেটে ২৪০ কোটি টাকার সিভিল বাজেট। এর মধ্যে বেশি না মাত্র ৯৪ কোটি টাকা ঘাটতি। অবশ্য আসলে ঘাটতি সবটাই। কেননা সবটাইতাে ফাঁকি। কিন্তু আহম্মক সা’বে তার এই কেতাবেও ৯৪ কোটি টাকা ঘাটতি দেখিয়েছেন। তাহলে ২৪৬ কোটি টাকা সিভিল বাজেট। এটাতাে সমুদ্রে বারি বিন্দু সম। মানে কিনা নস্যির গুড়া।
অবস্থা যেভবে চলছে তাতে মনে হচ্ছে পয়লা এক-আধমাস ডিফেন্স সার্টিফিকেট আর নগদ টাকা মিলিয়ে মাইনে দিবাে। তারপর বুঝতেই পারতাছেন- হুদা সার্টিফিকেট দিবাে। কেননা এছাড়া তাে হেগাে লাইগ্যা আর কোনাে রাস্তা নাইক্যা। বর্ষার শুরুতেই যখন এই অবস্থা, তহন মুক্তিফৌজের পুরা ক্যাচকা মাইর শুরু হইলে- হায় আল্লাহ হেগাে
জানি কি হয়? ঢাকা টাউনে কয়েকবার গ্রেনেড চার্জ, ফেনী সেক্টরে মুক্তিফৌজের গাবুর মাইর আর কয়েক হাজার ব্রিজ-কালভার্ট উড়নেই যখন হেগাে হেঁচকি উঠছে, তহন পুরা কারবার শুরু হইলে হেগাে, কি অবস্থা হইবাে হেইডাই ভাবতাছি।
সেদিন একদল মুক্তিফৌজের সঙ্গে Action দেখতে গিয়েছিলাম। বিচ্ছুর লাহাল পােলাগুলাে আমারে কইলাে কি জানেন? কইলাে, দেখেন আমরা আইজ রাইতে নদীর। হেই পারে পূর্ব দিকে কারবার করমু, তাই এই দুইডা পােলারে পশ্চিম দিকে নদীর ধারে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পের দিকে গুলি মারণের লাইগ্যা পাডাইলাম। আমি বললাম, ‘আপনাগাে Action হইবাে পূর্ব দিকে আর এগাে পাঠাইলেন পশ্চিম দিকে, কেইসডা কি?’- আরে দূর আপনে দ্যাহেন না কারবার। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প থেকে গুলির জবাব শুরু হলাে। মুক্তিফৌজের নেতা বললেন, এই যে হেগাে দিয়া শুরু কইর‌্যা দিলাম, অহন এই গুলি হারা রাইতের মতাে চললাে। আশে পাশে কোনাে গেরাম না থাকলে কি হইবাে- ডরের চোটে অহন এগাে এই অবস্থা হইছে।’ এরপর মুক্তিফৌজের দলটা দিব্বি পূব দিকে যেয়ে বাকি রাইত ধইরা তাদের কারবার করলাে অর্থাৎ হানাদার বাহিনীর পালিয়ে যাওয়ার রাস্তাটার বারােটা বাজিয়ে এল।
এরকম একটা অবস্থায় এখন আবার ভাড়াটিয়া সৈন্যদের বেতন নিয়ে গড়বড় শুরু হয়েছে। আর রােজই হানাদার সৈন্যদের নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তাই এহেনাে একটা ছেরাবেরা অবস্থায় জঙ্গী সরকারের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আব্দুল হামিদ খান তার জোয়ানদের মনােবল ঠিক রাখবার জন্য অহন এই বুড়া বয়সে ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরতাছেন। আর সেনাপতি ইয়াহিয়া নিজের পিঠের চাম্ বাচাইবার জন্য একটার পর একটা ফমূলা ঝাড়তাছেন। | যদি কেননা একটা ফর্মুলায় কাম হয়। আইজ মগরেবের ওয়াক্তে এই রকম একটা ফমূলার মাইদ্দে বড়শিতে যেমন মাছ গাঁথে হেই রকম মাল গাঁথতে চাইতাছেন। কিন্তুক মওলবী সা’বে যে কারাবারডা করছেন, হের পর সব পাখি উড়াল দিয়া গ্যাছেগা। অহন বারবার আঙ্গুলে গুনতাছন কয়ডা পাওয়া গেছে। ১৬৭-এর মধ্যে পনেরাে- কি সােন্দর Result?
এইবারে ইয়াহিয়া সরকার কি করফাইন? নাকি য্যামন আইছুলাইন হমনে। যাইফাইন। হ-অ-অ আর হেইদিগে তাে আবার জেনারেল আব্দুল হামিদেরও একবার গদীতে বহনের খায়েশ হইছে। পাকিস্তান যহন শ্যাষই হইছে তহন হের একবার খায়েশটা মিটুক। History-তে নামড়া তাে ছাপা হইবাে।
হেইর লাইগ্যা কইছিলাম, অক্করে সাফ। জঙ্গী সরকারের স্টেট ব্যাংকের খাজাঞ্চীখানা অক্করে সাফ।

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল