২৭ জুন ১৯৭১
আজ একটা ছােট্ট গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। আমি তখন ঢাকার পাতলা খানের গল্লির মইধ্যে থাকি। প্রায়ই রায় সাহেব বাজারের মুখে একটা রেস্টুরেন্টে আডডা মারতে যেতাম। কেন জানি না হঠাৎ খেয়াল হলাে এসব রেস্টুরেন্ট কিভাবে ব্যবসা করে তা জানতে হবে। সেদিন থেকেই রেস্টুরেন্টের বয়-বেয়ারা আর মালিকদের কাজকর্ম লক্ষ্য করতে শুরু করলাম।
রেস্টুরেন্টে চমৎকার ব্যবস্থা। গ্রাহকরা খাওয়া-দাওয়া করবার পর বেরিয়ে যাবার সময় দেখতে পান একটা টেবিলে ফ্যান চালিয়ে স্বয়ং মালিক ক্যাশ-বাক্সওয়ালা কাউন্টারটার পিছনে বসে রয়েছেন। গ্রাহকরা মুখে খিলাল চালাতে চালাতে ভদ্রলােকের সামনে হাজির হতেই তিনি ইলেকট্রিক কলিং বেলটা বাজিয়ে দেন। আর তখনই পিছন থেকে বয়ের গলার আওয়াজ ভেসে আসে আগেওয়ালা চার সাহাব-তিন আদমী গপসপ কিয়া, এক আদমী চা পিয়া, ছে পয়সা। পিছেওয়ালা দো’সাহাব খায়ে পিয়ে কুছ নেহি গেলাস তােড়া বারে আনে। বয়ের কথাবার্তা শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। বেটা বলে কি? চার জনের তিনজনেই বসেছিল আর একজন চা খেয়েছে?
ভালাে করে লক্ষ্য করে দেখলাম দেয়ালে লেখা রয়েছে এখানে ফল্স কাপ দেয়া হয় না। এ ব্যাপরটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু পরের দু’জন তাে কিছুই খায়নি? অ-অ-অ এলায় বুঝছি, হেরা বিসমিল্লাহ কইয়া টেবিলে বওনের লগে লগে গ্লাস ভাংগছে। পকেডে মাল-পানি বেশি নাইক্যা, তাই হুদা মুখেই ফেরত যাইতাছে। কিন্তুক গ্লাস ভাঙ্গনের বারাে আনা তাগাে দিতেই অইবাে।
সেনাপতি ইয়াহিয়া সা’বের Advisor এম.এম. আহম্মকের এই একই অবস্থা হয়েছে। বেচারা প্যারিস Aid Consortium-এর এগারােটা সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিগাে লগে বওনের সাথে সাথে গ্লাস ভাঙ্গছে। অর্থাৎ কিনা বাংলাদেশে হানাদার বাহিনীর কায়কারবার ফাস হইয়া গেছে। হেইর লাইগ্যা বাড়ায় খালি হাতে বাড়ির দিকে রওনা দিছে। কিন্তুক গ্লাস ভাঙ্গনের বারাে আনা।
এদ্দিনে বুঝলাম ল্যাঙ্গোটের বুক পকেট হইছে। সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের জঙ্গী সরকারের বাজেট হইছে। হেই বাজেটের কথা হুইন্যা আমাগাে বকশি বাজারের চকু মিয়া ফিক্ কইরা হাইসা দিছে। ছক্ক মিয়া এলায় কইতাছে, এম.এম. আহম্মকের লগে তাে আমার কোনােদিন দেখা হয় নাইক্যা? তবুও হেই ব্যাডায় আমার Plan পাইলাে কেতে? কি কইলেন? ছক্কু মিয়ার বাজেট করণের Plan জানেন না? তয় তাে আপনার জীবনই বৃথা। ছক্কু মিয়া হেইদিন চূনা বেমারী মুরগি বেইচ্যা পাঁচটা টাকা পাইছিল। টাকা লইয়াই মওলবী সা’বে বড় একটা ছালা লইয়া কেরামতের দোকানে যাইয়া হাজির অইলাে। হেইদিন তার চোটপাটই আলাদা। বত্রিশ টাকার মতাে চাইল-ডাইল কেননের পর ছক্ক কইলাে, আরে এই কেরামত মিয়া আগের যেমন লাগে কয়ডা টাকা পাইত্যা আমার কাছে?’ কেরামত মিয়া খুশিতে ডগমগ হইয়া কইলাে ‘হ-অ-অ চাওর গা টাকা পাইতাম। ছক্কু মিয়া সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে পাঁচ টাকার লােটটা বাইর কইরা কইলাে, ‘লও, লও, আগের হিসাবটা সাফ কইর্যা লও। আর আইজকার হিসাবে একটাকা জমা কইরা থােও।’ কেরামত মিয়া কিছু বােঝনের আগেই ছক্কু মিয়া অক্করে ভিড়ের মইধ্যে হারায়ে গেলাে গা।।
তাই ছক্কু মিয়া অহন এম.এম. আহম্মকের বাজেটের কথা রেডিওতে হুইন্যা অক্করে তাজ্জব বইন্যা গেছে। এম.এম. আহম্মক সা’বে কইছে, বাংলাদেশের গড়বড় কারবার শুরু হওনের পর রাজস্ব আদায় কমে গেছে, বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পেয়েছে, রফতানীর অবস্থা শােচনীয় আকার ধারণ করছে। তবুও ব্যাডায় আদায়পত্র নাই দ্যাহনের পরও ছয়শ’ কোটি টাকার বাজেট বানাইলাে কোন সাহসে? নাকি আমি যেমন পাঁচটা ট্যাহা দিয়া কেরামতের দোকান থনে বত্রিশ টাকার মাল কিনছিলাম- হেই রকম একটা কারবার করবাে?
ছক্কু মিয়া দৌড় দিয়া তেহারীর দোকান থনে মেরহামত মিয়ারে ধইরা আইন্যা কইলাে, বুঝছাে আমি যহনই কিছু করি, তখন তােমরা আমার পিছনে লাগাে। এলায় এম.এম. আহম্মক সা’বে বাজেটের মইধ্যে কি কারবারটা করছে দেখছাে?’ মেরহামত মিয়া হাতের বগা ডিকরেটটা ধরাইয়া কইলাে, ‘ধূর ব্যাডা কাইলা, এম.এম. আহম্মক যে সেভিংস সার্টিফিকেটে বেশি মাইনাওয়ালাগাে মাইনা দেওনের ব্যবস্থা করছে, হেইডা জানস নি?’
ছক্কু মিয়া লাফিয়ে উঠ বললাে, ‘হ-অ-অ-অ, তােমার মাথায় তাে আইজ কাইল খুবই বুদ্ধি খেলবার লাগছে? যেহানে গবর্ণমেন্ট নিজেই পাঁচশ’ আর একশ’ টাকার লােট লেওন বন্ধ করছে, হেয়নে পাবলিকে লইবাে সেভিংস সার্টিফিকেট? দেখলাম এরই মাইদ্দে ইয়াহিয়া সা’বে পাবলিকের থনে ধার করণের লাইগ্যা যে কাগজ বাজারে ছাড়ছিলেন, হেইগুলা কেউ-ই লয় নাইক্য?
ছক্কু মিয়ার কথাবার্তায় মেরুহামত মিয়া অক্করে Shut up হইয়া গেল। খালি কইলাে, ছক্কু মিয়া তুমি ল্যাহাপড়া না হিলে কি অইবাে, তােমার যেমন বুদ্ধি দেখতাছি, সেনাপতি ইয়াহিয়া তােমারে মিনিস্টার না বানাউক, এম.এম. আহম্মকের মতাে একটা Advisor বানাইয়া দেয়?
তয় তােমারে একখান মেছাল হুনাইয়া দেই। বুঝলা, শেরে বাঙলা ফজলুল হক সা’বে একবার প্রধানমন্ত্রী অইলে তার এক খুবই দোস্ত লােক পােলার একখান চাকরির লাইগ্যা আইলাে। হক সা’বে কইলাে, তুমি যহন আইছে, তহন চাকরিতে একখান দেওনই লাগবাে। তয় পােলাড়া ল্যাহাপড়া কতদূর হিকছে?
তার দোস্ত একটা হাসি দিয়া কইলাে, ল্যাহা-পড়া? না, পােলায় আমার ল্যাহাপড়ার মইধ্যে নাইক্যা।
হক সা’বে আবার জিগাইলাে, টেকনিক্যাল কোনাে কাম হিকছে তাে?’ এবারে জবাব অইলাে, তা অইলে এহানে চাকরির লাইগ্যা আনতাম না।
এলায় হক সা’বে একটা হাসি দিয়া কইলাে, “মিয়া খুব মছিবতে ফেলাইল্যা যাউকগা তুমি যহন আইছাে তহন তােমার পােলারে একখান চাকরি দিমুই।’- কি কইলেন আমার পােলাডার চাকরি হইবাে?’ হক সা’বে রসিকতা কইরা কইলাে, হ-অঅ, আর কিছু না পারি একটা মিনিস্টার তাে বানাইতে পারুম।
মেরহামত মিয়া এবারে লাফিয়ে উঠে বললাে, তয়তাে, ছক্কু মিয়া তােমারে পায়। কেডা। এইবার তােমার খুবই কড়া Chance দেখতাছি।’ ছক্কু মিয়া কইলাে, কি অইলাে, কি অইলাে Chance দেহেনের কি পাইল্যা?’ মেরহামত মিয়া হাইস্যা কইলাে, ‘হক সা’বে মইরা গেলে কি অইবাে? হের ব্যাডাতাে ফয়জুল হক- এইবার তাে জহিরুদ্দিন কো লগে মিনিস্টার হওনের Chance রইছে। আর হেই ফয়জুল হক তাে তােমারে ভালাে কইর্যা জানে। বাপে হেই কামডা পারে নাইক্যা, ব্যাড়ায় হেই কামড়া করবাে- দেখবা।’ কি মজা, কি মজা, আমাগাে ছক্কু মিয়া ফয়জুল হক আর জহিরুদ্দিনগাে লগে লগে মিনিস্টার অইবাে।’
কিন্তুক আমাগাে ছক্কু মিয়া মিনিস্টার হওনের কথা হুইন্যা অক্করে হাউ মাউ কইর্যা কাইন্দা ফালাইলাে। কইলাে, “দেখছি, দেখছি আমি হেই লিস্টি দেখছি, হেইডা তাে মউতের লিস্টি। হায়, হায়, মেহামত মিয়া এইডা কি কইল্যা? আমি মইরা গেলেও মিনিস্টার হমু নাইক্যা। হেই লিস্টিতে আমাগাে বকশি বাজারের আসাদুল্লাহর নামও উডছিলাে। হেউ বেডা মার্ডার হইছে। হের পরেই রইছে জহিরউদ্দিন, ফয়জুল হক, হরিবল হক, মাহমুদ আলী, ফ, কা, ফরিদ কত কি? আমারে মিনিস্টার বানাইলেই হেই লিস্টির মাইদ্দে নাম উডবাে। তা হইলেই তাে কারবার শ্যাষ। হায়, হায়, মেরহামত মিয়া, এইডা কি কইল্যা- এইডা কি কইল্যা। আমি মিনিস্টার হমু না।’
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল