You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.26 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

২৬ জুন ১৯৭১

আরে হুনছেননি কারবারটা। হেরা বলে বাজেট ঘােষণা করবাে। মানে কিনা এম.এম. আহম্মক সা’বে একটা সাইক্লোস্টাইল করা কেতাব আনলে, সেনাপতি ইয়াহিয়া হুইত্যা হুইত্যা বল পয়েন্ট দিয়া হেইডা দস্তখত করবাে। ব্যাস তা অইলেই হেই কেতাবড়া বাজেট হইয়া গ্যাললাগা। এলায় বুঝছেন বাজেট কারে কয়? হেগাে তাে আর হেই কাম নাইক্যা। Assembly Session ডাকো বাজেট Place করাে- দফায় দফায় ভােট লও পাবলিকের পছন্দ না হইলে ট্যাক্স কমাও- প্রত্যেক কামের জন্য জবাব দাও- কত কিছু ঝামেলা। তাই হেতাইনারা এসব কারবার অক্করে Short cut কইর‌্যা ফালাইছে। হেগাে মেম্বরের দরকার নাইক্যা, মিনিস্টারের কারবার নাইক্যা, আর হেগাে কোনাে Assembly-ই নাইক্যা।
হেরা তাে রাজা বাদশার জাত কিনা। গ্রিক-শক-হুন-মােগল-পাঠান হগ্গলই হেগাে পূর্বপুরুষ। তাই ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারের বাজেট ঘােষণাও এক অদ্ভুত আর অপূর্ব। বাদশাহী ব্যাপার। হেগাে কাছে পাকিস্তান আর বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকার পেয়ারা সাংবাদিকগাে একটা লিস্ট আছে। হেই লিস্টি ধইর্যা হেগাে একজন অফিসার প্লেনের টিকিট কাডে আর হােটেলের সিট রিজার্ভ করে। তারপর বুঝতেই পারতাছেন- যে সব এডিটররা জীবনে এক লাইন লিখতে পারে না, আর যাদের পেটে বােমা মারলে বােমাটাই ভোতা হয়ে ফিরে আসে, তারা নতুন স্যুট পরে মুখে জর্দা পান দিয়ে আর মােটা চামড়ার বেল্টে হুঁড়ি আটকিয়ে এসে হাজির হন। তাদের একটাই মাত্র কাজ। সেটা হচ্ছে ঘণ্টাখানেক ধরে প্রতিবছর জঙ্গী সরকারের বাজেটটার রিডিং পড়া শুনতে হয়। এরপর ছ মানে কিনা প্রেসিডেন্ট ভবনে গার্ডেন পার্টি।
হুর-পরী আর শরাবন তহুরার মাইধ্যে হেই পার্টি দেইখ্যা এডিটর সাবরা মাঝে মাঝে মনে করেন এইডা কি বেহেশতে আইয়া পড়লাম নাহি? আর যদি হেই পার্টিতে। ছদ্র ইয়াহিয়ার মতাে তােক কোনাে এডিটরের কান্ধের উপর হাত থুইয়্যা কথা কয়, তা। হইলে তাে হেই এডিটর সা’বে অক্করে আহ্লাদে গুলগুল্লা হইয়া পড়লেন। আনন্দের চোটে তিন দিন তিন রাইতের জন্য হের চোখের থনে ঘুম ছুইট্টা গেল।
কি হইলাে, বিশ্বাস হইতাছে না? তয় কইতাছি হুনেন। ঢাকার মর্নিং নিউজ কাগজের এডিটর হইতাছেন এস.জি.এম. বদরুদ্দিন। খুবই ইসলামভক্ত মানুষ। বাড়ি ভারতের বিহার শরীফ। রঙিন পানি খাইতে খাইতে বেচারার নিচের ঠোটটা একটুক ঝুইল্যা পড়ছে। আগে খবরের কাগজে বিড়ি পাতা, তামুক, গুন্ডি, চুগা পাতা, জর্দা আর পানের বাজার দর পাড়াইতাে। একদিন ফজরের আজানের সময় টেলিগ্রাম পাইলাে, আইজ থনে হে এডিটর হইছে। এলায় বুঝতেই পারতাছেন কি সােন্দর Appointment.
আরেকজন হইতাছেন ব্ল্যাক মেইল কাগজের- আরে না, না, না, মেইল কাগজের এডিটর আজিজুর রহমান। কি কইলেন, এই কাগজের নামই হােনেননি? তয় তাে মরছেন। এই কাগজডার বিক্রি খুবই বেশি কিনা তাই রাস্তাঘাটে পাওনই যায় না। থাইকগা আপনাগাে আসল কতাডাই কই। মেইল কাগজডার কোনাে সার্কুলেশন ম্যানেজারই নাইক্যা। আর দেশের লােক ইংরেজি জানে না দেইখ্যা রহমান সাবে কাগজ বিক্রি বন্ধ রাখছে। খালি শ’দুয়েক কাগজ মাগনা দেওনের লাইগ্যা ছাপায় আর কি? কিন্তু গবর্ণমেন্টে হগ্গল বিজ্ঞাপনই এই মেইল কাগজেই ছাপা হয়। আজিজুর রহমান সাহেবের আদি বাসস্থান বিহারের ছাপড়ায়- হার সাং ঢাকার হােটেল গ্রিন। মানে কিনা ঢাকার হােটেলগুলাের যে কোনাে বার বয় হের ঠিকানা কইতে পারবাে। উনি আবার টিক্কা খানের Expert on Indian Affair. আইজ কাইল খারাপ হওয়া সত্ত্বেও রহমান সা’বে এই প্রােগ্রামডা করতেছে। দেশের জন্য ত্যাগ আর তিতিক্ষা কইর‌্যা বেচারার অহন যক্ষ্মা হইছে।
এরপর আহেন পূর্বদেশের এডিটর মাহবুবুল হক। এক সময় রেলওয়ের কেরানী আছিলেন। পরে চট্টগ্রামে মিল্লাত কাগজের এজেন্ট হয়েছিলেন। কিন্তু দুষ্টু লােকে যাই বলুক না কেন, আমার মনে হয় এজেন্সির হিসেবটাই কেমন জানি ভুল হওয়াতেই কিছু মাল-পানি তার পকেটে এসে গিয়েছিল। পাকিস্তানের প্রাক্তন ফরিন মিনিস্টার হরিবল হক চৌধুরী এলেনবেরির ড্রাম চুরির মামলা থেকে অব্যাহতি পাবার খবর পাওনের লগে লগে মাহবুবুল হকরে তার ‘ঘেটু’ বানাইয়া ফ্যালাইলেন। (ঘেটু শব্দের আসল অর্থ গ্রাম বাংলায় কিশাের বালক যুবতীর ছদ্মবেশে নৃত্যগীত পরিবেশন করলে তাকে ঘেটু বলে।) কিন্তু বড় বড় স্টিমারের উপর যেমন ছােট ছােট Life saving নৌকা থাকে কিংবা বড় বড় গহনা নৌকার পিছনে যেমন একটা ছােট ডিঙ্গি নৌকা থাকে তাকেও ‘ঘেটু’ বলে। | প্রাক্তন ফরিন মিনিস্টার হক চৌধুরী সাব এহেননা মাহবুবুল হককে এনে যুক্তফ্রন্টের নমিনেশনে ১৯৫৪ সালে ফেনীর থেকে Election-এ দাঁড় করালেন। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের নৌকামার্কা পাওনের পরও যখন বেড়ায় অক্করে ডাব্বা মারলেন, তখন চৌধুরী সাব খুশিতে ডগমগ হইয়া কিছুদিন বাদ হেরে পাকিস্তান অবজার্ভারে চাকরি দিলেন। হেরপর বুঝতেই পারছেন, মাহবুবুল হক পূর্বদেশের এডিটর হইলেন। অবশ্য এই বারের Election-এও ফেনীর থনে হেতাইনে আওয়ামী লীগের লগে Fight করণের খায়েশ হইছিল। কিন্তুক খাসীর পায়ার শুরুয়া আর গুদার কালিয়া খাইয়া বেচারা হক কোনাে কুলই করতে পারলেন না। Election-এ মাহবুবুল হক অক্করে ছেরাবেরা হয়ে গেলেন। তা অইলে কি হইবাে। হেতাইনের এডিটরশিপ ঠিকই থাকলাে। এলায় বুঝতেই পারতাছেন এডিটরের নমুনা হান কেমন?
চাইর নম্বরে আমাগাে হরলিকসের বােতল। দূর থনে দেখলে মনে হয় একখান হরলিকসের বােতল আইতাছে। কিন্তু আসলে তিনি ছহি আজাদের সম্পাদক শ্রীহট্ট নিবাসী ছৈয়দ ছাহাদত হােসেন। একটা বিশেষ কাম করণের লাইগ্যা ইনি আবার গভর্ণমেন্টের ছিক্রেট ফাণ্ড থাইক্যা মালপানি পান। তয় ইনি নিজেই ল্যাহেন। হেই ল্যাহার নমুনা দিতাছি- ‘সরকার যাহা করিয়াছেন তা ভালােই করিয়াছেন। তবে আরাে একটুকু করিলে বােধ হয় ভালাে হইলেও হইতে পারিত। তবু যাই হােক, সরকার যখন ইহা করিয়াছেন তখন ইহা অভিনন্দনযােগ্য।
এর পরেই আসে আমাগাে মওলানা সা’বের কথা। মানে কিনা জামাতে ইসলামীর কাগজ দৈনিক সংগ্রামের এডিটর মওলানা আখতার ফারুক। বাড়ি বরিশাল- তয় এই কথাডা কইতে তার খুবই শরম। ভাব-চক্কর অক্করে শিক-কাবাব। মনে হয় এই আধা ঘন্টা আগে পাটনার থনে তশরিফ আনছেন। হে বলে রবীন্দ্রনাথের নাম হােনে নাইক্য। খালি একডা কথা কইয়া থুই- একটু সাবধানে থাইকেন। আপনের নাম কিন্তুক লিস্টির মাইদ্দে উঠা পড়ছে। | যাক যা বলছিলাম। পাকিস্তানও একটা দেশ- তারও আবার একটা বাজেট। এইডা যেমন লাগে ল্যাঙ্গটের বুক পকেট আর কি। আয়ের বেলায় ঠন্ঠনা। আর ব্যয়- হেইডার তাে কোনাে হিসাবের দরকার নেই। কাঁচা পাট, পাটজাত দ্রব্য, চা, চামড়া, মাছএসবের রফতানী থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা শূন্য। জমির খাজনা, আয়কর, সেলস ট্যাক্স, আবগারি ট্যাক্সের আয়ের একই অবস্থা। বৈদেশিক ধারকর্জ ‘গােল্লা’ আর ব্যয় আলহামদুলিল্লাহ্। বাংলাদেশে পাঁচ ডিভিশন সৈন্য রাখার Operation cost, প্রশাসন ব্যবস্থার খরচা, পাকিস্তানের কলকারখানাগুলাের কাঁচামাল আমদানী, উন্নয়ন পরিকল্পনা, রাস্তাঘাট তৈরি, পেট্রোল, কেরােসিন ও Aviation Fuel আমদানী, বৈদেশিক দূতাবাসের খরচা, নতুন দুই ডিভিশন সৈন্য রিক্রুটমেন্টের খরচা, কাশ্মীর ও ভারত সীমান্ত ছাড়াও বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশের সৈন্য রাখার খরচা এবং খাদ্য আমদানীএসব কিছু মিলে অবস্থা অক্করে ল্যাজে-গােবরে হইয়্যা গ্যাছেগা। তাই রিলিফের টাকা, রেডক্রসের টাকা, বিদেশের দান খয়রাত, চাদা, চীন-সৌদি আরবের টাকা সব অহন। একটা মাত্র গাতাতে ঢুকতাছে। কিন্তু হেই পাতা ভরণ হেগাে কাম না। সেনাপতি ইয়াহিয়ার অহন ঘাম ছুটতাছে। হের মাইদ্দে আবার নিজেরাই নিজেগাে পাঁচশ’ আর একশ’ টাকার লােট বেআইনী কইর‌্যা হুইত্যা পড়ছে। করাচীতে অহন মাইনষে Marketing করণের সময় চাংগাড়িত কইর‌্যা কুলির মাথায় টাকা আনতাছে। অরে ম্যাজিক খেলা আর কি? এক টাকা লােটের দাম অহন পাঁচ সিকা আর একশ’ পাঁচশ’ টাকার ললাট ড্রেনের মইধ্যে গড়াগড়ি খাইতাছে।
হেইর লাইগ্যা কইছিলাম। আরে হুনছেননি হেগাে কারবারটা? হেরা নাকি সাংবাদিকগগা ডাইক্যা বাজেট ঘােষণা করবাে? পাগলে কি না কয় আর ছাগলে কি না খায়। পাকিস্তানও একটা দেশ, হেরও আবার বাজেট। সব হালায় ছক্কু মিয়ার কারবার আর কি?

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল