৫ জুলাই ১৯৭১
আধা-খাড়া। এই একটা শব্দের উপরেই অহন মাইর-পিট চলতাছে। সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকারের বড় বড় গোঁফ আর ভূড়িওয়ালা জেনারেলদের যাঁরা বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকায় মুক্তিফৌজের আহ্বা আর গাবুর মাইরের চোটে ধাধা মাইরা গেছেন, তাঁরা আধা-খাড়া কাম করবাে না বইল্যা এহনও চিল্লাইতাছেন। হানাদার ফৌজের 9th Division-এর কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল শওকত রাজা বলেছেন যে, আমরা খামােখা এতাে মাল-পানি খরচ কইর্যা এতাে দূর থনে আহিনাইক্যা। আমরা একটা মিশন লইয়া আইছি। আর এই মিশনের কাম শ্যাষ না হওয়া পর্যন্ত আমাগাে Action চলবােই। আমরা তাে আর বার বার আইতে পারুম না? আধাখাড়া কাম কইর্যা পলিটিশিয়ানগাে হাতে এই মুলুল্টা দিয়া গেলে আবার গড়বড় শুরু হইবাে। তাই দুশমনগাে পুরা খতম করণের পরই আমরা আবার দ্যাশে ফিইরা যামু।
একটা ছােট্ট গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। একবার আমাগাে ঢাকার মাইদ্দে ছন্ধু মিয়া আর মেহামত মিয়া মিল্যা রেস খেলবার গেছিলাে। ময়দানে যাইয়া ছক্কুর মুখ দিয়া খালি খই ফুটতাছে। রাজা-উজির মাইরা চলছে। মানে কিনা ছক্ক রেস খেলবার আইলেই খালি বাজি জিত্যা ফ্যালায়। হেই লাইগ্যা বেশি আহে না। তা অইলে অন্য মাইনষে করবাে কি? হ্যাষে হেই দিন ছক্কু মিয়া হীরামনের উপর টিকিট কিনলাে। আর মােরহামত মিয়ারে কইলাে, বুঝছাে নি, হীরামন অক্করে পঙ্খিরাজ। যহন রেস শুরু অইবাে তহন। দেখবা অক্করে উড়াল দিয়া যাইতাছে। আর হীরামনের জকি পবন বাহাদুররে তাে তুমি চেনােই? আঃ হাঃ তুমি দেখি অক্করে কাউলা হইছাে? পবন বাহাদুরের মেডেলের ওজন তাে এক মনের মতে অইবাে। একবার করেছিল কি- এই পবন বাহাদুর দুলদুল লইয়া রেসে নামছে। পয়লা থনেই ফাস্ট যাইতাছে। খানিক দূর যাওনের পর আঙ্কা দুলদুল ঠ্যাং ভাইঙ্গা পইড়া গেল। হ্যাষে পবন বাহাদুর ঘােড়া ছাড়াই দৌড়াইয়া অক্করে পয়লা যাইয়া হাজির হইল। হের পর শুরু হইল মহা গ্যাঞ্জাম। তারপর বুঝছােনি। ছয় মাস ঢাকায় রেস খেলাই বন্ধ। মেরূহামত মিয়া বগ সিগরেটটার মাইদ্দে একটা কড়া টান দিয়া কইলাে, ‘হ-অ- বুঝছি। আইজ যহন তােমার লগে আইছি, তহন আমার কপালে না জানি কি আছে? যাউগ্গা, তােমার হীরামনে আইজ কার লগে Fight করবাে?
ছক্কু মিয়া একটা অবজ্ঞার হাসি দিয়া কইলাে, হুনতাছি কই থনে Diamond Queen বইল্যা একটা ঘােড়া আইছে। হেইডাই নাহি হীরামনের লগে টক্কর দিবাে। আরে কিসের লগে কি?
মিনিট কয়েকের মধ্যেই সাত নম্বর রেস শুরু হয়ে গেল। তুমুল চিকার। আর বিকট হৈ চৈ। এর মধ্যে দেখা গেল Diamond Queen বাকি সবগুলাে ঘােড়াকে বহু পিছনে ফেলে Victory Stand-এ পৌছে গেছে। আর বাকি ঘােড়াগুলাের মধ্যে কে সেকেন্ড হবে সেটা নিয়েই সাংঘাতিক Fight চলতাছে। হঠাৎ করে মেরূহামত মিয়া লক্ষ্য করে দেখলাে যে বাকি ঘােড়াগুলাের সবচেয়ে পেছনে মুখে ফেনা বের করে হীরামন হাঁপাতে হাঁপাতে আসছে। তাই মেরূহামত মিয়া আর মন্তব্য না করে পারলাে না।
‘আবে এই ছক্ক মিয়া, তােমার হীরামনরে লইয়া পবন বাহাদুর যে অক্করে লাস্টে আইতাছে? খেল শুরু হওনের আগে তাে খুবই চোটপাট করতাছিলা? এলায়? ছক্কু মিয়া তার সাদা দাঁতগুলাে বের করে বললাে, আবে ধূর আইজ আমাগাে পবন বাহাদুর হীরামনরে লইয়া নতুন কিসিমের খেল্ করতাছে। দেখছাে কেমন সুন্দর বাকি হগুগল ঘােড়াগুলারে খেদাইয়া আনতাছে? ব্যাডা একখান আর কি? সেনাপতি ইয়াহিয়া অহন পবন বাহাদুর হইছে। আর হের হানাদার বাহিনী অহন হীরামন হইছে। যে মুক্তিফৌজের লগে টক্কর লাগবাে, তাগাে তালাশ কইরাই পাইতাছে না। তাই দম্ খিচ্চ্যা হিয়াহিয়া সা’বে অহন হানাদার বাহিনী দিয়া গেরামের লােকগুলারে খালি ধাওয়াইয়া বেড়াইতাছে।
এদিকে ঢাকা থাইক্যা খুব জব্বর খবর আইছে। এসােসিয়েটেড প্রেস অব আমেরিকার প্রতিনিধি জানিয়াছেন যে, ২২শে জুন মঙ্গলবার যখন একদল বিদেশী সাংবাদিক ভাের রাতের দিকে Anti Aircraft Gun, ট্রেঞ্চ আর বাংকারে ঘেরা তেজগাঁ বিমান বন্দরে অবতরণ করছিলেন, তখন মুক্তি ফৌজ গেরিলাদের ডিনামাইট আর হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জের বিকট আওয়াজে সমস্ত শহরের পূর্ব দিকটা প্রকম্পিত হচ্ছিল। অথচ প্লেনের মধ্যেই নাকি হানাদার বাহিনীর একজন অফিসার জোর গলায় সাংবাদিকদের বুঝাচ্ছিলেন যে, বাংলাদেশে আইজ-কাইল সব কিছুই আমাগাে কন্ট্রোলের মধ্যে এসে পড়ছে। গেরিলা যুদ্ধের কথা যারা কয়, তারা ভােগা মারতাছে। ঢাকার মাটিতে পা দিলেই বুঝতে পারবেন।
হ-অ-অ ঢাকার মাড়িতে পা দিয়াই হেতাইনরা বুঝতে পারছে মাসে কয়দিন যাইতাছে। আর ইয়াহিয়া-টিক্কা সা’বের জোয়ানগাে দিন অহন ক্যামৃত কাটতাছে। রয়টারের সংবাদদাতা হাওয়ার্ড হুইটেন ঢাকায় পৌছেই এক রিপাের্টে জানিয়েছেন যে, এর মধ্যেই আট দফায় মুক্তিফৌজরা খােদ ঢাকা শহরে হাতবােমা আর গ্রেনেড চার্জ করেছে। জেনারেল টিক্কার অফিসাররা এর কোনাে হদিসই করতে পারছে না। এছাড়া মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলামীর লােকজন ছাড়াও যেসব বেসামরিক কর্মচারী ইয়াহিয়া সরকারের সাথে সহযােগিতা করেছে তারা মুক্তিফৌজের মৃত্যু পরােয়ানা পাচ্ছে। এসব মৃত্যু পরােয়ানা সরকারি খামে করে পাঠানাে হচ্ছে। এছাড়া ঢাকায় যে সামরিক হাসপাতাল রয়েছে, সেখানে প্রতিদিনই গড়ে ষাটজনের মতাে গুরুতররূপে আহত পাকফৌজ ভর্তি হচ্ছে। বাকি হাসপাতালের হিসেব পাওয়া যায়নি।
হাওয়ার্ড হুইটেন ঢাকা থেকে আরাে জানিয়েছেন যে, প্রায় ৮০ কিলােমিটার দূরে টাঙ্গাইল থেকে যেসব লােক ঢাকায় পালিয়ে এসেছেন, তাদের মতে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা টাঙ্গাইল দখলের পর লাহাের-পিন্ডি থেকে আমদানী করা সশস্ত্র পুলিশের হাতে টাঙ্গাইলের শাসনভার দিয়ে কুমিল্লা সেক্টরের দিকে চলে গিয়েছিল। কিন্তু কাদেরিয়া বাহিনীর গাবুর মাইরের চোটে টাঙ্গাইল থনে অহন হেরা অক্করে সাফ হইয়া গ্যাছে। টাঙ্গাইল এখন মুক্ত।
এদিকে ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল-এর একজন সংবাদদাতা বাংলাদেশের। পশ্চিমাঞ্চল সফর করে বলেছেন যে, ক্যান্টনমেন্ট আর শহরাঞ্চল ছাড়া পাকফৌজ বিশেষ দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য এসব ফৌজরা মাঝে-সাঝে গ্রামের মধ্যে এসে অত্যাচার চালিয়ে সন্ধ্যার আগেই আস্তানার দিকে দৌড়াচ্ছে। মুক্তিফৌজের আতৃকা মাইরের ভয়ে এরা সব সময়ই আল্লাহ্ বিল্লাহ্ করতাছে। আবার লন্ডন টাইম্স কাগজে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের অনেকগুলাে এলাকাই এখন মুক্তিফৌজের নিশানা দেখতে পেয়ে বেশ খানিকটা আশ্চর্য হয়েছেন। সংবাদদাতা তাঁর রিপাের্টে আরাে বলেছেন যে, মুক্তিফৌজ গেরিলারা তাকে পরিস্কার জানিয়েছে যে, বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত এ সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে আস্থা স্থাপন করে এ মুক্তি সংগ্রাম সফলতা লাভ করবেই করবে। লাখাে বাঙালির লাশের নিচে আজ পাকিস্তান নামে দেশটার দাফন হয়ে গ্যাছে।।
তাই কইছিলাম- আধা-খাচড়া। এই একটা মাত্র শব্দের উপরেই অহন হগ্গল মাইর-পিট চলতাছে। হানাদার বাহিনীও কইতাছে, আধা-খাড়া কাম কইরা যামু না। আবার মুক্তিফৌজও কইতাছে আধা-খাচড়ার মধ্যে আমরা নাইক্যা। মুক্তিফৌজ গেরিলারা পয়লা থনেই এই একটা মাত্র কথাই কইতাছে- আধা-খাড়া কামে আমরা বিশ্বাস করি না। কাম অক্করে পাক্কা। হানাদার বাহিনীর মউত অহন তাগাে Call করতাছে। আর আজরাইলে তাগাে উপর আছর করছে।
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল