৬ জুলাই ১৯৭১
গুনাহ্। কবিরা গুনাহ্। সেনাপতি ইয়াহিয়া খান গুনাহ-এ কবিরা করছেন। বিশ্বাসঘাতকতা, নরহত্যা, নারী নির্যাতন, গণহত্যা, আর মিছা কথার মাস্টার জেনারেল হয়ে ভদ্রলােক এখন সাধু সাজবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পাপ কোনােদিন চাপা থাকে না। তাই বাংলাদেশের আসল তথ্য বিশ্ববাসীর কাছে প্রকাশ হবার পর মাস্টার সা’বে অহন খুবই গরম হইছেন। শেষ পর্যন্ত তার পরাণের দোস্ত পাকিস্তানের প্রাক্তন ফরিন মিনিস্টার হরিবল হক চৌধুরীরে পশ্চিমী দেশগুলােতে জনমত গঠন আর টিভি, রেডিও সংবাদপত্রগুলােকে ব্রিফ করবার জন্য পাঠিয়েছেন। হরিবল হক চৌধুরী নিজেই নিজের পরিচয়। সারাজীবন ধরে পলিটিক্স করছেন; কিন্তুক হগ্গল সময়েই Back-Doorমানে কিনা পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকবার রাজনীতি। মওলবী সা’বে আইজ পর্যন্ত পাবলিকের ভােটে মেম্বর হতে পারেননি। তাই পাবলিকের উপর তাঁর খুবই রাগ। কেউ কেউ কয়, এবার ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের বস্তি এলাকাগুলাে নিশ্চিহ্ন করবার বুদ্ধিটা নাকি এই চৌধুরী সা’বই দিয়েছিলেন। কেননা রাস্তা দিয়ে মার্সিডিস গাড়িতে যাওনের সময় ‘ গিধড়’ বস্তিগুলাে তার কাছে খুবই খারাপ লাগছিল।
সেনাপতি ইয়াহিয়া ক্ষেমতায় আসার পর যখন এক মাথা-এক ভােটের কথা ঘােষণা করেছিলেন, তখন পাকিস্তানের এই প্রাক্তন ফরিন মিনিস্টার ঘৃণায় মুখ বেঁকিয়ে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, রাজনীতির ব্যাপারে বুদ্ধি-টুদ্ধিগুলাে আমাদের কাছ থেকে নিলেই পারে। দেশের অশিক্ষিত আর অর্ধশিক্ষিত লােকগুলাে ভােটের কি দাম বুঝে? যত সব মাথা গরমের কাজ আর কি?”
এরপর থেকে চৌধুরী সাবে মাঝে মাঝেই সীলমােহর করা খামে লােক মারফৎ চিঠি পাঠিয়ে সেনাপতি ইয়াহিয়া সা’বকে Advice করতেন। তাঁর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে একগাদা খবরের কাগজ। ইংরেজি পাকিস্তান অবজার্ভার, বাংলা পূর্বদেশ আর উর্দু ওয়াতান পত্রিকা ছাড়াও উর্দু এবং বাংলা সিনেমা সাপ্তাহিক চিত্রালীর মালিক এই চৌধুরী সাবে। তাই মাঝে-সাঝে এসব কাগজে তার চেহারা মােবারকের মানচিত্র দিয়ে ফলাও করে বিবৃতি ছাপা হয়। আবার এ.পি.পি. এবং পি.পি.আই. এর মতাে সংবাদ সরবরাহ সংস্থাকে বিবৃতির কপি দিয়ে তা সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের কাগজগুলাের কছে পাঠাবার জন্যে- সে কি চোটপাট!
গত বছর নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপর দিয়ে সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় হয়ে যাবার পর যখন সমস্ত জননেতাদের দুর্গত এলাকা সফর সমাপ্ত হলাে, আর যখন গরু-ভেড়া আর মানুষের লাশ সরানাে শেষ হয়েছে; তখন একদিন চৌধুরী সা’ব তার একজন রিপাের্টার ও ফটোগ্রাফার নিয়ে নােয়াখালীর চর বাট্টায় যেয়ে হাজির হলেন। পাকিস্তানের এককালীন ফরিন মিনিস্টার গামবুট পরে কপূর দেয়া রুমাল নাকে চেপে ধরে রাস্তার পাশে আঙ্গুল চারেক কাদার মধ্যে দাঁড়ালেন। অমনি বার কয়েক ক্লিক ক্লিক আর Flash Bulb জ্বলে উঠলাে। ঢাকায় ফিরে এসে তিনি এক এফতার পার্টিতে তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণনা করলেন। অবশ্য ৭২ বছর বয়সেও তাঁর নামাজ-রােজার বালাই পর্যন্ত নেই। ইসলামের খুবই পায়েরবন্দ লােক কিনা! পরদিন সকালে তার কাগজগুলােতে বিরাট ফটো সহকারে খবর ছাপা হলাে, দুর্গত অঞ্চলে হামিদুল হক। অবশ্য অন্যান্য খবরের কাগজে এই সংবাদটার নাম নিশানা পর্যন্ত নেই।
এহেনাে চৌধুরী সা’ব আবার একটা Chance লইছেন। হেই দিন জেনারেল টিক্কার লগে আমাগাে প্রাক্তন ফরিন মিনিস্টার একটা হেলিকপ্টারে বরিশাল গিয়েছিলেন। পরদিন। পাকিস্তান অবজার্ভার, পূর্বদেশ আর ওয়াতান কাগজে চার কলাম করে দুটো ফটো ছাপা হলাে। উপরেরটা হচ্ছে General Tikka in Barisal. কিন্তু নিচের ফডােডা আমাগাে হরিবল হক চৌধুরীর। বরিশালে হ-রি-বল। কি রকম বেডা একখান। ঢাল নেই, তলােয়ার নেই নিধিরাম সর্দার।
কিন্তুক হের উপায় নাইক্যা। হের মাল-পানির পরিমান খুবই বেশি কিনা। নিজের আইন ব্যবসা, দুইডা বাংলা, দুইডা উর্দু আর একটা ইংরেজি কাগজ ছাড়াও প্যাকেজেস ইন্ডাস্ট্রিজ, সদর ঘাটের এসােসিয়েটেড প্রিন্টিং প্রেস আর একটা চা-বাগান রইছে। এছাড়া আবার জাপান থনে চিটাগাং রিফাইনারি আর চিটাগাং স্টিল মিলের জন্য কেমিক্যালস ইমপাের্ট লাইসেন্স রইছে। এদিকে আবার কেমতে জানি পাকিস্তান অবজার্ভারের জাপান সাপ্লিমেন্টের কিছু টাকা ফরেন ব্যাংকে রইছে।
চৌধুরী সাবের জামাই বিশিষ্ট সাংবাদিক এজাজ হােসেন ছিলেন পাকিস্তান। অবজার্ভারের ইউরােপীয় সংবাদদাতা। কিন্তু দুরারােগ্য ক্যানসার ব্যাধিতে ভদ্রলােকের মৃত্যু হলে, চৌধুরী সা’ব নিজের বিধবা মেয়েকেই অবজারভারের সংবাদদাতা হিসাবে নিয়ােগ করে বৈদেশিক মুদ্রায় বেতন দিতে শুরু করেছেন।
এ হেনাে চৌধুরী সা’ব অহন সেনাপতি ইয়াহিয়ার দূত হিসেবে বিদেশ সফরে বেরিয়েছেন। তাঁর কামড়াই হইতাছে ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারের সপক্ষে বিশ্বের জনমত সংগ্রহ করা ছাড়াও টিভি, বেতার ও সংবাদপত্রগুলােকে বাগে আনা। কেননা ব্রিটিশ ও মার্কিন সংবাদপত্রগুলাে জঙ্গী সরকারের ভাণ্ড অক্করে ফুটা করে দিয়েছেন।
নিউইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সংবাদদাতা মিঃ সিডনী সেনবার্গ ঢাকায় যেয়ে যে রিপাের্ট পাঠিয়েছেন,তাতে সেনাপতি ইয়াহিয়া অক্করে হুইত্যা পড়ছেন। উনি খুবই সিনা চিতাইয়া Foreign Correspondent গাে দাওয়াত করছিলেন। কিন্তুক সিডনী সাবের ডােজটা খুবই কড়া অইছে। হেইর লাইগ্যা হেরে মাত্র বারাে ঘণ্টার নােটিশে Get-out কইরা দিছেন। এদিকে আবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি পার্টির চারজন সদস্য রয়্যাল এয়ার ফোর্সের প্লেনে বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকা আর সীমান্তের ওপরের শরণার্থী ক্যাম্প Visit কইর্যা যেটুকু বয়ান করেছেন, তাতেই জঙ্গী সরকারের কাড়া সারা হইছে। ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন দলের মেম্বর মিঃ টবি জেসেল বলেছেন, “হেই দিকের কারবার যা দেখছি, তাতে কইর্যা রিফিউজিগাে দ্যাশে ফেরনের কথা কইতে পারি না। সঙ্গে সঙ্গে ইসলামাবাদ থেকে লন্ডনে Urgent মেসেজ গ্যাছে “Protest”।
লগে লগে লন্ডনের পাকিস্তানী হাইকমিশনার চিল্লাইয়া উঠছেন, ‘জেসেল সা’বে খুবই খারাপ কথা কইছেন। ইয়ে সব ঝুট হ্যায়।’ এদিকে ব্রিটেনের প্রাক্তন শ্রমমন্ত্রী মিঃ আর্থার বটলি বলেছেন, দেখেশুনে যা বুঝেছি, তাতে শেখ মুজিবুর রহমান আর আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কেউই বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। কিন্তুক সেনাপতি ইয়াহিয়া কবিরা গুনাহ করার পরেও বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান করবার জন্য শ্যাষ পর্যন্ত একটা বাই-ইলেকশনওয়ালা মিলিটারি ডেমােক্রেসির ফমূলা দিছেন। বেডাগাে ধারণা দুনিয়ার মাইদ্দে কেউই এর মজমাডা’ বুঝতে পারবাে না। এদিকে বাংলাদেশ সরকার কইছে সেনাপতি ইয়াহিয়া ক্যান আমাগাে ব্যাপারে ফুচি’ মারতাছে? মানে কিনা নাক গলাচ্ছেন। হেতাইনে কেডা? ১৯৭১ সনের ২৫শে মার্চ জুমেরাতে পাকিস্তান নামে। দ্যাশটার দাফন হয়ে গেছে। সবই কবিরা গুনাহর ফল।
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল