৯ জুলাই ১৯৭১
আইজ কেন জানি না মােনেম খার কথা মনে পড়ছে। সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের ওস্তাদ আইয়ুব খান বাংলাদেশ থনে বহুত খুঁইজ্যা মালডারে বাইর করছিলাে। মােনেম খার যােগ্যতা- বটতলার উকিল আছিল আর জীবনে কোনােদিন পাবলিকের ভােটে জিততে পারে নাইক্যা। কিন্তু আইয়ুব খানের বেসিক ডেমােক্রেসিতে মােনেম খাঁ এক রাইতে বি ডি হইয়া গেল গা। তাই ফাস্ট চান্সেই ভদ্রলােক সেন্ট্রাল মিনিস্টার। হের পরের ঘটনা মােনেম খাঁ নিজেই Disclose করছিল।
ঢাকায় মুসলিম লীগের গুণ্ডা সম্মেলন- আরে না না না কর্মী সম্মেলন। আইয়ুব খান একটা মােটা চেয়ারে মখমলের কুশনের উপর বসে রয়েছেন। কিস্তি টুপী মাথায় মােনেম খাঁ বক্তৃতা করছেন, “ভাইসব আমার ছদর সাক্ষী। আমি তখন সেন্ট্রাল হেলথ মিনিস্টার। একদিন রাইতে আমার ছদর আমারে ডাইক্যা পাঠাইলাে। আমার বুকের মাইদ্দে তখন পেঁকির আওয়াজ শুরু অইছে। কাঁপতে কাঁপতে রাওয়ালপিণ্ডির প্রেসিডেন্ট হাউসে যাওনের লগে লগে ছদর আমারে কইলাে কি জানেন? মােনেম তুমি বঙ্গাল মুলুকের গবর্ণর হও।’ আমি কইলাম, মা-গাে-মা, আমি এইডা পারবাম না। ছদর কইলাে, ‘চব্বিশ ঘণ্টা টাইম দিলাম, তারপর কইও। দৌড়াইয়া অইয়া ময়মনসিংহ-এ জ্ঞানদার কাছে টেলিফোন বুক করলাম। জ্ঞানদা হইতাছেন আমার সিনিয়ার সব কিছু হুইন্যা জ্ঞানদা কইলাে কি জানেন?- ‘মমানেম তুমি মা কালীর নাম লইয়্যা ঝুইল্যা পড়াে। ভাইসব হেই যে ঝুললাম- আইজও ঝুললাম কাইলও ঝুললাম; ঝুলাই রইলাম।”
এর পরের টুক আর মােনেম খাঁ কইতে পারে নাই। কওনের মতাে অবস্থাও আছিল । পাবলিকের মাইরের চোটে মােনাইম্যা অক্করে বনানীর দোতালায় যাইয়্যা হুইত্যা থাকলাে। আর আইয়ুব খান? থাউক হেইডা আর কমুনা। হেতাইনে ইয়াহিয়া খানরে ছিক্রেট লেটার লেইখ্যা হাউ-মাউ কইর্যা কাইন্দা ফ্যালাইল।
এখন আমাগাে টিক্কা খানের অবস্থা মােনাইম্যার মতাে অইছে। মােনেম খাঁ তাে কড়ি কাডের মাইদ্দে ঝুলছিল। কিন্তু টিক্কা? বাংলাদেশের ক্যাদো আর প্যাকের মাইদ্দে আটকা পড়ছে। যতই বাইরাইবার চেষ্টা করতাছে, ততই আরাে গ্যাইড়া যাইতাছে। মমানেম খার টাইমে বাংলাদেশে দুই ডিভিশন সৈন্য আছিল, কিন্তু টিক্কা সা’বে পাঁচ ডিভিশন সৈন্য, ১৫ হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী সশস্ত্র পুলিশ আর রাজাকার বাহিনী হগ্গলরে লইয়া প্যাকের মাইদ্দে হান্দাইতাছে। কিন্তু চিল্লাইতে পারবাে না। চিল্লাইলেই যদি Leak out হইয়া যায় যে, মুক্তি বাহিনীর গাবুর মাইর চলতাছে! মনে লয় দুনিয়ার মাইনষে জানে না যে, ঢাকার আশেপাশেই অহন হেই কাম Begin হইছে। আর কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিং, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহীতে কেন জানি না টিক্কার সােলজাররা পেট্রোলে বাইরাইলে আর ফেরনের নাম লয় না। কেমন একটা কুফা অবস্থা। এইসব মাইরের কথা স্বীকার যাইবাে না। ছােট ভাই-এর ওয়াইফ যেমন ভাসুরের নাম লয় না, হেই রকম ইয়াহিয়া-টিক্কা-নিয়াজী-ওমরের দল মুক্তিবাহিনীর নাম লইতে পারবাে না। খালি চিল্লাইতে চিল্লাইতে কইবাে দুস্কৃতিকারী, রাস্ট্রের দুশমন আর বিদেশী চরেরা এগুলা করতাছে। তা হইলে তােমার সােলজাররা করে কি? ও-ও-ও হেরা তাে কোবানী খাইতাছে।
বাংলাদেশে অহন জব্বর Development Work চলতাছে। নতুন নতুন সব হাসপাতাল খােলা হচ্ছে। কিন্তু হেই হাসপাতালে সব খাকী পােষাক পিন্দুইন্যা পেসেন্ট হুইত্যা গােঙ্গাইতাছে। ডাক্তার-নার্স খুবই Shoit কিনা। মুসলমান ভাই-ভাই কওনের চোটে একবার ইরান থনে কিছু নার্স আইছিল। কিন্তু হেরা হেইগুলারে বিসমিল্লাহ কবুল কইয়্যা সব হাংগা কইর্যা ঘরের বিবি বানাইয়া ফ্যালাইছে। তাই এইবার ইরান থনে গোঁফওয়ালা মেইল নার্স পাইছে।
একটা ছােট ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। পাকিস্তান আমলের ঘটনা। ঢাকার জিন্না এভিন্যুতে আমার এক দোস্ত দাঁতের ডাক্তার আছিল। একদিন সন্ধ্যার সময় হেইখানে আড্ডা মারতে গেছিলাম। হের রােগীরা সব লাইন কইর্যা রইছে। এই সব রােগীর মাইন্দে একটা পাঠান রােগী দাঁতের ব্যথার চোটে গাল পাট্টা বাইন্ধ্যা অনেকক্ষণ ধইর্যা বইয়া আছে। আমি দোস্ত ডাক্তাররে কইলাম, এইডা খুবই অন্যায়, পাঠানডাও তাে তােমার Patient, ওরে একটু দেইখ্যা দাও। আমার কথা হুইন্যা ডাক্তার সাবের এ্যাসিটেন্ট থর থর কইর্যা কাঁপতে শুরু করলাে। আর আমার ডাক্তার বন্ধু পাঠানডার কাছে যাইয়্যা কি যেনাে কইতেই ব্যাডায় গেলােগা। আমি জিগাইলাম, “কি কইল্যা? ডাক্তার একটা হাসি দিয়া কইলাে, না ওরে লােক আনতে পাডাইলাম। এই জিন্না এভিন্যুতেই দারােয়ান আছে, হেইগুলার জনা দুই আন্তে কইলাম। না অইলে হের দাত উডানের সময় ধরবাে কেডা? হের পর বুঝতেই পারতাছেন। রাইত নয়ডার সময় সিনেমা দেখলাম। মাটিতে চিৎ করে শােয়ানাে অবস্থায় রােগীকে দু’জন পাঠান দারােয়ান চেপে ধরে আছে। রােগী তখন গোঁ-গোঁ আওয়াজ করছে। আর ডাক্তার সাড়াসী দিয়ে দাঁত তুলছে। কিন্তু তখনও বুঝতে পারি নাই যে, এই রকম সিনেমার সিরিয়াল শাে দ্যাহনের টাইম খুবই নজদিগ। টিক্কা সাবের সােলজার গাে হােতাইয়া বেঙ্গল রেজিমেন্ট ঠাইস্যা ধরছে আর গেরিলারা মনের সুখে ডাক্তারি করতাছে।
এই রকম এক সময়ে লেঃ জেনারেল নিয়াজীর উপর অর্ডার হইছে, রিফিউজি পাকড়াও করতে হবে। Reception Counter গুলা অনেক দিন ধইর্যা খালি যাইতাছে। নিয়াজীসা’বে তন্দুর রুটি-শিক কাবাব খাইয়া সিলেট যাইয়া হাজির। প্লেনে আহনের সময় জনাকয়েক আর্মী অফিসার আর টেলিভিশনের ক্যামেরা ম্যানরে লগে আনছে। দুনিয়ার মাইদ্দে সিনেমায় দেহান লাগবাে যে, টিক্কা-নিয়াজীর মহব্বতে বেচাইন হইয়্যা বাঙালি রিফিউজিরা সব ফেরৎ আইতাছে। Reception Counter-এর সামনে গােটা চারেক আর্মি জিপ দাড়িয়ে রয়েছে। বগলে ব্যাটন নিয়াজী সা’ব তার ঘেটু অফিসারগাে লগে বাচিত্ করতাছেন। এমন সময় জনা চল্লিশেক সােলজার কয়েকটা গ্রাম থেকে শ’ দেড়েক লােক ঘেরাও করে নিয়ে এল। একজন অফিসার চিৎকার করে বললাে, সব দেহাতী আদমি কো ইস তরফ লে যাও! অউর কদম বাড়াকে Reception Counter কি তরফ আনে বােলাে। জোয়ান লােগ দূর মে Position লেও। এর পর টেলিভিশনের মুভি ক্যামেরায় দিব্বি রিফিউজি ফেরনের ছবি তােলা হলাে আর লােকগুলাকে ডাণ্ডা মেরে খ্যাদানাে হলাে। অফিসার মার্চ করে নিয়াজীর সামনে এসে স্যালুট করে বললাে, ইস্ আম লােগকা অন্দর কুছ বিহারী ভি থে। উও লােগ থােতি পেন্হাথা। ইসলাম কে লিয়ে ও লােক হিন্দু বনে থে। ক্যামন বুঝতাছেন? পাবলিসিটি কারে কয়?
আমাগাে টিক্কা সব আর নিয়াজী সাবের মাইদ্দে আবার একটুক খেটমেটু রইছে। Eastern Command-এর দায়িত্বটা টিক্কার কাছ থনে নিয়াজীরে দ্যাওনের পর থাইক্যাই খেট্টমেটু আরাে বাড়ছে। তাই সিলেটের রিফিউজি ফেরনের কারবার করণের পর চিত্তের মাইদ্দে সুখ লইয়াই জেনারেল নিয়াজী ক্যান্টনমেন্টে ফেরত আইলেন। কিন্তু লগে লগে রিপাের্ট পাইলেন, ঢাকা থনে মাত্র ত্রিশ মাইল উত্তর পশ্চিমে দেওহাট্টাতে হানাদার বাহিনীর যে ক্যাম্প আছিলাে, হেইডারে গেরিলারা হামামদিস্তা কইর্যা ফ্যালাইছে। অহন আর্মী হেড কোয়ার্টারের কাছেই কারবার শুরু হইছে। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহে ক্যাতে জানি তিনটা থানা মুক্ত এলাকা হইছে।
আকা মাইর দুনিয়ার বাইর। রংপুর, দিনাজপুর কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, যশাের, কুস্টিয়াতে আবার গেরিলাগাে আঙ্কা মাইর শুরু হইছে। হেরা আরামসে হানাদার সৈন্যগাে খুঁইজ্যা বেড়াইতাছে। মােনেম খাঁ তাে কড়িকাডের মাইদ্দে ঝুলতাছিল, কিন্তু টিক্কা নিয়াজীর দল যতই ফাল পাড়াতছে, ততই বাংলাদেশের প্যাক আর ক্যাদোর মাইদ্দে গাইড়া যাইতাছে। আহা-রে কোন খাকার পােলার কোনখানে মউত? ইরাবতীতে জন্ম যার ইছামতীতে মউত ।।
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল