You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.25 | চরমপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

২৫ মে ১৯৭১
ঢাকা শহর ও নারায়ণগঞ্জ থেকে ভয়ানক দুঃসংবাদ এসে পৌছেছে। গত ১৭ই এবং ১৮ই মে তারিখে খােদ ঢাকা শহরের ছ’জায়গায় হ্যান্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে। এসব জায়গার মধ্যে রয়েছে প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েট, স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান, হাবিব ব্যাংক, মর্নিং নিউজ অফিস, রেডিও পকিস্তান আর নিউ মার্কেট। পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যদের। দখলকৃত ঢাকা নগরীতে মুক্তিফৌজদের এধরনের গেরিলা তৎপরতা সামরিক জান্তার কাছে নিঃসন্দেহে এক ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ বৈকি।
তবে যে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ সদম্ভে ঘােষণা করেছিলেন যে, ঢাকা নগরী সম্পূর্ণ করায়ত্ত আর জীবন যাত্রা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তাহলে মুক্তিফৌজদের এধরনের কাজকর্ম সম্ভব হচ্ছে কিভাবে? এছাড়া ঢাকা শহরে এর মধ্যেই নাকি মুক্তিফৌজের পক্ষ থেকে প্রচারপত্র পর্যন্ত বিলি করা হয়েছে। এই না বলে প্রশাসন ব্যবস্থা আবার চালু করা হয়েছে? তাহলে পাকিস্তানী জেনারেলদের নাকের ডগায় কীভাবে মুক্তিফৌজওয়ালারা প্রচারপত্র বিলি করতে পারে? আপনাদের ‘অশান্তি কমিটি’-মাফ করবেন, তথাকথিত ‘শান্তি কমিটির তথাকথিত নেতৃবৃন্দ করে কি? এদের ঘেটি ধরে active করতে পারেন না? জনসাধারণের উপর নাকি এদের দারুণ প্রভাব? এদের অংশুলি হেলনে নাকি বাংলাদেশ ওঠাবসা করছে!
না, না, না ও ব্যাপারে আপনারা কিস্সু চিন্তা করবেন না। আপনারা ভুল করে একটা সাধারণ নির্বাচন নিজেদের তত্ত্বাবধানে করিয়েছিলেন। আর সেই নির্বাচনে। আপনাদের পপ-ধরা নেতারা সব বাঙালিদের বিশ্বাস ঘাতকতার জন্যে হেরে গেছে। বাংলাদেশের ভােটাররা সব মহাপাজী-একেবারে পাজীর পা-ঝাড়া। নাহলে কক্সবাজারের ফরিদ আহমেদ, সিলেটের মাহমুদ আলী, চট্টগ্রামের ফ, কা, চৌধুরী, ঢাকার খাজা খয়েরউদ্দিন, মােহাম্মদপুরের গােলাম আজম আর পাকিস্তান অবজার্ভার হাউসের মাহবুবুল হকের মতাে নেতারা নির্বাচনে হেরে যায়? আর নির্বাচনে এরা হারলেই বা কি আসে যায়- এরা তাে এক একজন বিরাট দেশপ্রেমিক। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধররা এদের নাম চমৎকারভাবে মীরজাফরের সঙ্গে পড়ে মুখস্থ রাখবে- তাই না?
যা যা বলছিলাম। ব্রাদার মিঠা খান, সরি জেনারেল মিঠঠা খান- একেই তাে দু’মাসের যুদ্ধে তােমার প্রায় হাজার কয়েক সৈন্য মারা গেছে, তার উপরে আবার বাংলাদেশ দখলের যুদ্ধেরও সমাপ্তি ঘটাতে পারােনি। এবার খােদ শহরেই মুক্তিফৌজ ছােড়াদের গেরিলা action! তাহলে কি বুঝবাে তােমার সৈন্যরা মুক্তিফৌজ যােদ্ধাদের সামান্যতম ক্ষতি পর্যন্ত করতে পারেনি।
ওকি আঁতকে উঠো না! ঢাকার আর্মানীটোলা আর কুর্মিটোলার সামরিক ছাউনির কাছে আজমপুর গ্রামে গেরিলারা যে টহলদার হানাদার সৈন্যদের হত্যা করেছে, সেকথা কাউকে জানাবা না। কেমন কিনা, এবার খুশি হয়েছে তাে! মরুভূমির উটপাখির মতাে তুমি মুখটা বালুর মধ্যে লুকিয়ে ফেললা, কেউই তােমাকে দেখতে পাবে না।
ছিঃ ছিঃ ছিঃ। এতে লজ্জার কি আছে? খােদ ঢাকাতেই যখন গেরিলা action শুরু হয়েছে, তখন নারায়ণগঞ্জেও যে একটু বড় আকারে ওসব হবে তাতে সন্দেহ নেই। তাই নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর উপরে আভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থার টার্মিনালটার ক্ষতি একটু বড় রকমেরই হয়েছে। যাক লেঃ জেনারেল নিয়াজী এর মধ্যেই সামরিক হেলিকপ্টারে বাংলাদেশের কয়েকটা শহর সফর করে হানাদার সৈন্যদের মনােবল তৈরীর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি যে আবার কয়েকটা খারাপ সংবাদ নিয়ে এলেন! বর্ষার আগেই হানাদার সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে। কেননা মুক্তিফৌজের চোরাগােপ্তা মারের চোটে ওরা ছােট ছােট দলে টহল দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশের নদীর সাইজ দেখেই নাকি ওরা ভিরি খেয়ে পড়েছে।
মিঠঠা খান ভাইয়া। শুনলেও হাসি পায়। ঢাকার কাছে পালাতে তােমার নির্দেশেই তাে হানাদার সৈন্যরা সাঁতার কাটা আর ছােট নৌকা চালানাে শিখছে। আরে ও সাঁতার তাে মায়ের পেট থেকে পড়েই শিখতে হয়! বাংলাদেশের ছেলেগুলাে তাে পাঁচ বছর বয়স থেকেই সাঁতার শেখে। এ তাে আর পাঞ্জাবের এক হাঁটু পানিওয়ালা নদী নয়-এ যে বিরাট দরিয়া। শুনেছি তােমার হানাদার সৈন্যরা যখন চাঁদপুর থেকে বরিশাল যাচ্ছিল তখন তারা ভেবেছিল তারা বােধ হয় বঙ্গোপসাগরে এসে গেছে। ওদের একটু ভালাে। করে ভূগােল শিখিয়ে দিও- ওটা তাে মেঘনা নদী। আর শােননা, একটা কথা তােমাকে গােপনে বলে দি। বাংলাদেশের বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা আর মাদারীপুর ও গােপালগঞ্জ মহকুমায় এক ইঞ্চি রেল লাইন কোনাে সময়ই বসানাে সম্ভব হয়নি। ওখানে অনেক নদীর নাম পর্যন্ত নেই- গ্রামের নামেই নদীর নাম। এসব এলাকার হাটগুলাে পর্যন্ত নদীর উপরে বসে, বুঝেছ অবস্থাটা! এখানেই একটা নদী আছে- নাম তার আগুনমুখাে । নাম শুনেই বুঝেছাে বর্ষায় ওর কি চেহারা হবে?
না, না, তােমাকে ভয় দেখাবাে না। একবার যখন হানাদারের ভূমিকায় বাংলাদেশের কাদায় পা ডুবিয়েছে- তখন এ পা আর তােমাদের তুলতে হবে না। গাজুরিয়া মাইর চেনাে? সেই গাজুরিয়া মাইরের চোটে তােমাগাে হগলরেই কিন্তুক এই ক্যাদোর মাইধ্যে হুইত্যা থাকেন লাগবাে।

সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল