৭ জুন ১৯৭১
খাইছে রে খাইছে। ঢাকার গায়েবী আওয়াজ থাইক্যা আবার জব্বর খবর আইছে। সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকার এবার নতুন চাল চেলেছেন। তারা ঘােষণা করেছেন যেসব বাঙালি সৈন্য, ইপিআর জওয়ান আর পুলিশ হানাদার বাহিনীকে পথে বসিয়ে মুক্তিফৌজে যােগ দিয়েছে, তারা ফিরে এলে সহানুভূতির সংগে তাদের case consider করা হবে। এসব জওয়ানরা তাঁদের আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে কিংবা আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়াই ফিরে আসতে পারেন। বেশি মাত্র ৩৬ হাজার পুলিশ, ১২ হাজার ইপিআর আর ৬ হাজার বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি জওয়ান স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিফৌজে যােগ দিয়েছে। আর এর সঙ্গে হাজার হাজার ছাত্র, শ্রমিক আর যুবক পাকিস্তানের নরপশুদের। হত্যার জন্য গেরিলা ট্রেনিং নিচ্ছে। এর মধ্যেই বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ।
গেরিলার গাবুর মাইরের চোটে হানাদার সৈন্যরা দিশেহারা হয়ে উঠেছে। কথায় বলে ওস্তাদের মাইর বিয়ান রাইতে। এখন সেই মাইর কেবল শুরু হয়েছে। তাই ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকার এবার নতুন চাল চেলেছেন।
তারা ঢাকার গায়েবী আওয়াজ থেকে অবিরামভাবে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও পুলিশদের call করেছেন। সে কি আকুলি বিকুলি। এসব বাঙালি জওয়ানদের বিরহে জেনারেল টিক্কা পর্যন্ত ভেউ ভেউ করে কেঁদে হ্যায় ছইরদ্দি, হায় গয়জদ্দি করে বেড়াচ্ছেন। তিনি ঢাকার গায়েবী আওয়াজকে অর্ডার দিয়েছেন খুব মেলায়েম আর গদগদ স্বরে এদের আহ্বান জানাতে হবে। হেড কোয়ার্টারের নির্দেশ, যেভাবে হােক এসব জওয়ানদের মুক্তিফৌজের হাত থেকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। কেননা এদের হাতে গত আড়াই মাসে পাঁচ হাজারেরও বেশি হানাদার সৈন্য নিহত হয়েছে আর দশ হাজারের মতাে আহত হয়েছে। যুদ্ধ যে ভাবে চলছে তাতে আরাে কত সৈন্য যে পটল তুলবে তার ইয়ত্তা নেই। তাই সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকার এখন এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছেন। যদি কোনােমতে এসব বাঙ্গালি জওয়ানদের ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলে মুক্তিফৌজ দুর্বল হয়ে পড়বে। এছাড়া এরা যাতে জীবনে আর যুদ্ধ না করতে পারে তার ব্যবস্থা করা হবে। অর্থাৎ কিনা হেই কাম করা হবে।
মে মাসের গােড়ার দিকে হঠাৎ করে নারায়ণগঞ্জ এলাকার লােকেরা দেখতে পেলাে, প্রায় শ’দেড়েক লাশ নদীতে ভাসছে। লাশগুলাের হাত পা বাঁধা। খোঁজ করে দেখা গেল ঢাকার অদূরে কিছু ইপিআর জওয়ান রিপাের্ট করেছিল। এরপর ঘটনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত । ট্রাক বােঝাই করে এদের নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটিতে নিয়ে যাওয়া হলাে। রাতের ঘন। অন্ধকার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে এদের হাত-পা বেঁধে লাইন করে দাঁড় করানাে হলাে। নিশীথ রাতের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে এক ঝাঁক মেশিনগানের গুলি কড়কড় আওয়াজ করে। বেরিয়ে গ্যালাে। বাঙালি যুবকদের আর্তক্রন্দনে খােদার আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠলাে। নরঘাতকের দল লাশগুলাে নদীর পানিতে ফেলে দিলাে। শীতলক্ষ্যার পানি বাঙালি তরুণদের তাজা লহুতে লাল হয়ে উঠলাে। দিন কয়েক পর্যন্ত আশ পাশের লােকেরা নদীতে হাত পা বাঁধা লাশগুলাে দেখে ক্ষোভে দুঃখে উন্মাদ হয়ে উঠলাে।
আশ্চর্য এই বীভৎস হত্যাকাণ্ডের মাত্র এক মাসের মাথায় বাংলাদেশের সেই নরপিশাচের দল বাঙালি জওয়ানদের জন্য মায়াকান্না শুরু করে দিয়েছে। দুনিয়ার ইতিহাস পর্যালােচনা করে দেখা গেছে যে, নাদির শাহ, তৈমুর লঙ্গ, চেঙ্গিস খান ও হিটলারের মতাে হত্যাকারীর দল নিরস্ত্র মানুষ আর আত্মসমর্পনকারীদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। এদের কোনাে সময়েই সামান্যতম বিবেক কিংবা নৈতিকতাবােধ দেখা দেয়নি। তাই এদের বংশধর সেনাপতি ইয়াহিয়া আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হত্যার নেশায়। মেতে উঠেছে। কিন্তু মুক্তিফৌজের পাল্টা মারে এখন এই হানাদার বাহিনীর নাভিশ্বাস হওয়ায় নয়া মুখােশের আড়ালে তারা নিজেদের কীটদষ্ট বীভৎস জল্লাদের চেহারাটা লুকোবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু পাপ কোনােদিন চাপা থাকে না।
প্রথমে এই ফ্যাসিস্ট বাহিনী পরাজিত রাজনীতবিদদের দিয়ে একটা ধামাধরা সরকার গঠনের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এতে সামান্যতম উৎসাহ দেখালাে না। তাই নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে কিছু হেই জিনিষ খুঁজে বের করবার কাজে নেমেছিল। সেটাও বানচাল হয়ে গেছে। এদিকে বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকায় কোনােরকম প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু ওরা বিশ্বের ইতিহাসে বর্বরতম হত্যালীলা চালিয়েও বাঙালি জাতিকে পদানত করতে পারেনি। এর সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক বিশ্ব আজ ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকারকে জঘন্য ভাষায় ধিক্কার দিতে শুরু করেছে। সেখানে আজ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ায়, সেনাপতি ইয়াহিয়া সরকার একটার পর একটা নতুন চাল চালতে শুরু করেছে।
আন্তর্জাতিক ঠ্যালার চোটে মওলবী সাবরা দখলকৃত এলাকায় বিশটা Reception counter খুলে চাকু, ছােরা আর মেসিনগান নিয়ে বাঙালি শরণার্থীদের প্রতীক্ষায় রয়েছে। ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের কাজে যােগ দেয়ার জন্য প্রাণ জারে জার করে আবেদনের পর আবেদন চালিয়ে যাচ্ছেন। জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা হিলালী সিনেটর এডােয়ার্ড কেনেডির সংগে সাক্ষাতে ব্যর্থ হয়ে খত্ মানে কিনা চিঠি লিখেছেন। হিলালী সা’ব অক্করে হিলাল হয়ে গেছেন। তিনি লিখেছেন ভারতই যত নষ্টের মূল। ভারত আটকে না রাখলে এদ্দিনে বাঙালি শরণার্থীরা আহ্লাদে আটখানা হয়ে সব্বাই Reception counter-এর মাধ্যমে দখলকৃত এলাকায় ফিরে আসতাে। কি অপূর্ব। আর অদ্ভুত যুক্তি। যেনাে বিশ্বের কেউই জানে না যে কি অবস্থায় এসব শরণার্থী বাপদাদার ভিটে ছেড়েছে।
কিন্তু এদিকে যে হানাদার বাহিনীর হালুয়া একেবারে টাইট। ছলে বলে কৌশলে ও ডাহা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েও ভুড়িওয়ালা জেনারেলরা আর হালে পানি পাচ্ছেন না। অবস্থা। কুফা দেখে এখন খােদ মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ভাইসব, চইল্যা আসুন। কিস্সু কমু না। কেইসটা কী? মুক্তিফৌজের পাল্টা মাইরের একটু নমুনাতেই Nervous হয়ে গেছেন? কবে না স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিই আহ্বান জানিয়ে বসেন। আপনাদের পক্ষে অসম্ভব কিছুই নেই। তাই বলেছিলাম খাইছে রে খাইছে। ঢাকার গায়েবী আওয়াজ থাইক্যা আবার জ্বর খবর আইছে।
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল