৮ জুন ১৯৭১
ইসলামাবাদ থেকে লালবাতি জ্বালার খবর এসেছে। সেখানকার টাকাগুলাে সব কাগজ হয়ে গেছে। সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকার এবারে একাশি নম্বর ছেড়েছেন। গত আড়াই মাস ধরে অবস্থা স্বাভাবিক বলে চেঁচিয়ে মুখের গাইলস্যা দিয়ে ফেনা বের করার পর এখন একদম হঠাৎ করে একাশি নম্বর সামরিক বিধি জারি করেছে। এই সামরিক বিধির ভাষা পরিস্কার আর প্রাঞ্জল। আজ থেকে পাকিস্তান আর বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকায় কোথাও পাঁচশ’ ও একশ’ টাকার নোট চলবে না। এখন বুঝুন অবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? কথা নেই, বার্তা নেই ইসলামাবাদের সামরিক জান্তা কলমের এক খোঁচায় কিছু লােককে পথে বসিয়ে দিলেন। আর পথে বসাবেন নাই-ই বা কেন? নিজেরাই যে পথে বসে রয়েছেন। তাই একাশি নম্বর সামরিক বিধিতে বলা হয়েছে, যাদের কাছে পাঁচশ’ ও একশ’ টাকার নােট রয়েছে, সেসব নােট ৯ই জুনের মধ্যে ব্যাংকে জমা দিতে হবে। তাই বলে জমা দেয়ার সংগে সংগে ভাংচা পাবেন না। পাবেন একটা রসিদ। তাও আবার বাপ-দাদার নাম ঠিকানা লেখাতে হবে। সেই রসিদটা ট্র্যাকে গুজে বাসায় ফিরে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকবেন। কেননা সরকারের হাতে এখন মাল-পানি একটু Short হয়েছে। ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকার একটা কমিটি গঠন করেছেন। এই কমিটি তদন্ত করে দেখবেন যে এসব টাকার ট্যাক্স দেয়া হয়েছে কিনা- এসব টাকা ব্যাংক থেকে লুট করা হয়েছে কিনা? এরপর যখন ন’মন তেল পুড়িয়ে রাধা টুং টুং করে নাচবে অর্থাৎ কিনা সামরিক জান্তার কপাল ফিরবে, তখন ভাংচা দেওয়া হবে। অথচ একটু ভালাে করে লক্ষ্য করলেই দেখবেন পাঁচশ’ আর একশ’ টাকার নােটের উপর দস্তখত দিয়ে লেখা আছে ‘চাহিবামাত্র পাকিস্তান স্টেট ব্যাংক সমপরিমাণের মুদ্রা দিতে বাধ্য। এ ব্যাপারে যাতে কোনাে ক্যাচালের সৃষ্টি না হয় তার জন্য ৮১ নম্বরে চমক্কার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকার কোনাে কোর্টে এই ৮১ নম্বরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা যাবে না। কি চমক্কার আর কি অদ্ভুত নিরাপত্তার ব্যবস্থা।
যার এক কান কাটা সে রাস্তার একপাশ দিয়ে হাঁটে। আর যার দুই কানকাটা সে রাস্তার মাঝ দিয়ে যায়। সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকারের এখন সেই অবস্থা। লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে তিনি এখন দিব্বি কান কাটা রমজান হয়েছেন। তালকানা হয়ে একটার পর একটা সামরিক বিধি জারি করে চলেছেন। নিজের দেশের মুদ্রা নিজেই বেআইনী ঘােষণা করে বসেছেন। আবার নােটিশ দিয়ে দোকান খােলার ব্যবস্থা করেছেন। অর্থাৎ কিনা ব্যাংকগুলাে আজ থেকে তিনদিন পর্যন্ত সমস্ত কারবার বন্ধ রেখে প্রত্যেক দিন সকাল নটা থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত পাঁচশ’ আর একশ’ টাকার নােট জমা নিয়ে রসিদ দিবে। অবশ্য ব্যাংকগুলাের কারবার আগে থেকেই বন্ধ রয়েছে। সােজা ভাষায় বলতে গেলে আজ থেকে ব্যাংকগুলােকে তিন দিনের জন্যে খােলা রাখার নির্দেশ দেয়া হলাে। অবশ্য বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকায় ব্যাংক খােলা বা বন্ধের কোনাে বালাই-ই নেই। কেননা ব্যাংকের কোনাে কর্মচারীই নেই। হানাদার বাহিনীর স্যাঙাত্রা পয়সা লুটপাটের পর চেয়ার টেবিল পর্যন্ত নিয়ে গ্যাছে। ভাঙ্গা লােহার গেটের চেহারা দেখে বুঝতে হয় অতীতে কোনাে এক সময় এখানে একটা ব্যাংকের অস্তিত্ব ছিল।
ইসলামাবাদের সামরিক জান্তা ৭ই জুন রাতে যে প্রেস নােট জারি করেছে তাতে আসল কথাটা ফাস হয়ে গ্যাছে। মুক্তিফৌজওয়ালারা পাঁচশ’ আর একশ’ টাকার নােটে জয় বাংলা সিল দিয়ে মুক্ত এলাকায় চালু করেছে। | সেনাপতি ইয়াহিয়া এখন শুধু ইয়া ইয়া করে বেড়াচ্ছেন। তাঁর থলিতে আর মাত্র পঞ্চাশ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে। অথচ জুন মাসের শেষেই পাকিস্তানকে বেশি না মাত্র চার কোটি পাউন্ড অর্থাৎ প্রায় ৪৫ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ পরিশােধ করতে হবে। এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের কলকারখানাগুলাে চালু রাখার জন্য নিদেন পক্ষে দশ কোটি টাকার মাল আমদানী অপরিহার্য। এর সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশে হানাদার বাহিনীর জন্য দিনে দেড় কোটি টাকার খরচা। তাই বিশ্ব ব্যাংকের দক্ষিণপূর্ব এশীয় ডিরেক্টর মিঃ পিটার কারঘিল সম্প্রতি আলােচনার জন্য ইসলামাবাদ সফরে এলে সেনাপতি ইয়াহিয়া তাঁর হাত ধরে হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠেছেন। মিঃ কারঘিলের কাছে পরিস্কার করে বলেছেন, এই মুহূর্তে পাক মুদ্রা Devalue করতে কোনােই আপত্তি নেই। তবুও কিছু মাল-পানি ঝাড়াে। আর যে পারি না বাবা!
এদিকে পাকিস্তানী শিল্পপতিরা চিৎকার করতে শুরু করেছে। শ্রমিকরা ধর্মঘটের জন্য ঘন ঘন বৈঠক করছে। উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলাে শিকেয় উঠেছে। হাজার হাজার হানাদার সৈন্যের নিহতের সংবাদে পাঞ্জাবের ঘরে ঘরে কান্নার রােল পড়ে গেছে। মুক্তিফৌজের গাজুরিয়া মাইরের চোটে হানাদার বাহিনীর ত্রাহি মধুসূদন ডাক শুরু হয়ে গেছে। এখন আবার বাংলাদেশে মুক্তিফৌজ গেরিলারা হানাদার সৈন্যদের জ্যান্ত ধরে নিতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ থেকে অবাঙালি ব্যবসায়ীরা অবস্থা বেগতিক দেখে ‘ভাগাে হুয়া রুস্তম’ হচ্ছে। অর্থাৎ প্রত্যেক সপ্তাহে জাহাজে ভাগতে শুরু করেছে উপজাতীয় সৈন্যরা লুটের মাল বগলদাবা করে দেশে ফেরবার জন্যে উখুস করছে।
জেনারেল টিক্কা বেসামরিক কর্মচারীদের বেতনের শতকরা ৭৫ ভাগের বেশি দিতে পারছেন না। বিদেশে পাকিস্তান এ্যাম্বাসির স্টাফরা শতকরা মাত্র ৬০ ভাগ বেতন বৈদেশিক মুদ্রায় পাচ্ছেন। যে কোনাে মুহূর্তে সেটাও বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। বেসামরিক সাহায্যের নাম-গন্ধও পর্যন্ত নেই। সেনাপতি ইয়াহিয়ার চারপাশটা দ্রুত ঝাপসা আর অন্ধকার হয়ে আসছে। বাংলাদেশের ক্যাদো আর প্যাকের মধ্যে যে হাটু তিনি ডুবিয়েছেন, এখন আর তা উঠানাে সম্ভব হচ্ছে না। এ রকম একটা নট নড়ন নট চড়ন’ অবস্থায় সেনাপতি ইয়হিয়ার জঙ্গী সরকার নিজেদের মুদ্রা একশ’ রুপেয়া কা নােট সব কাগজু বন্ যাও। এর পরের ইনস্টলমেন্টে পঞ্চাশ আর দশ টাকার নােটের পালা। তারপর অক্করে বাগােয়াট। তাই বলেছিলাম ইসলামাবাদ থেকে এখন লাল বাতিজ্বালার খবর এসেছে। সেখানকার টাকাগুলাে সব কাগজ হয়ে গেছে।
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল