১০ জুন ১৯৭১
করাচীতে শুরু হয়ে গেছে। মানে কিনা করাচীতে গ্যানজাম শুরু হয়ে গেছে। এখানকার লােকজন সব মাতম করতে করতে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। সবার মুখে এক কথা। “গিয়া, গিয়া, তাবা হাে গিয়া। পানশ’ আওর একশাে রুপেয়াকা নােট সব তাবাহ্ হাে গিয়া।” সকাল থেকেই করাচীর প্রত্যেকটা ব্যাংকের সামনে বিরাট লাইন। ধাক্কা-ধাক্কি, মারামারি আর চিল্লাচিল্লাতে করাচীর প্রতিটা মহল্লায় এক মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সবাই ব্যাংকের লকার থেকে সােনাদানা আর গয়নাগাটি উঠিয়ে নেয়ার জন্যে পাগল হয়ে। গেছে। করাচীতে আগে থেকেই খবর রটে গেছে যে, খুব শিগগিরই তাদের সাধের ইয়াহিয়া সরকার দেশের সমস্ত সােনাদানা বাজেয়াফত করবে। কেননা ইসলামবাদের জঙ্গী সরকারের হাত একেবারে শূন্য। বাংলাদেশে যুদ্ধ চালাতে যেয়ে সেনাপতি ইয়াহিয়া অক্কর চিত্তর অইয়া পড়ছেন। যখন যা বুদ্ধি মাথায় আসছে, তখন সেই নির্দেশ জারি করে চলেছেন। পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের সিন্ধুকগুলাে এখন একেবারে সাফা-সােনা নেই।
তাই আন্তর্জাতিক বাজারে পাকিস্তানী টাকা আর কেউই নিতে চাচ্ছে না। সবারই পরিস্কার কথা, সােনা দিয়ে ব্যবসা করাে। আর এর ফলে ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকার দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এবারে সােনা সংগ্রহের এক নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। এই পরিকল্পনার দুটো অংশ। একটা অংশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকায়। হানাদার সৈন্যের বদলে এখন থেকে সরকারের আঁওতায় ব্যাংকের লকারগুলাে খুলে পাকিস্তানের মালকড়ি পাঠাতে হবে এবং সমস্ত সােনার দোকান লুট করতে হবে। আর একটা অংশে হচ্ছে, ইসলাম আর দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সােনা জমা দেয়ার জন্য Appeal করতে হবে।
করাচীতে এ খবর প্রকাশ হবার পরেই এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন সবাই মাটির নিচে লাখ লাখ ভরি সােনা পুঁততে শুরু করেছে। আর বড়লােকেরা ব্যাঙ্কের লকারগুলাের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। ঠ্যালার নাম জশমত আলী মােল্লা। এখন মওলবী সা’বরা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছেন বাংলাদেশ আক্রমণ করে তাদের হালহকিকত কিভাবে কেরাসিন হচ্ছে অবস্থা বেগতিক দেখে উজিরে খাজানা থেকে ঘন ঘন প্রেস নােট জারি করা হচ্ছে। আর রেডিও গায়েবী আওয়াজ থেকে ভ্যা ভ্যা করে তারই প্রতিধ্বনি হচ্ছে। জেনারেল টিক্কা এখন মাথায় হাত দিয়ে বসেছেন। এত ঢাক ঢােল পিটিয়েও বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকা থেকে পাঁচশ’ ও একশ’ টাকার নােট একরকম বলতে গেলে ফেরতই পাওয়া যায়নি। কেননা বেশির ভাগ জায়গায় পাকিস্তানী ব্যাংকগুলাের কোনাে ব্রাঞ্চের অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই। লুট হয়েছে। হানাদার সৈন্য ও রাজাকারের দল এসব ব্যাংক লুট করেছে। মায় এসব ব্যাংকের ফার্নিচার পর্যন্ত গায়েব হয়ে গেছে। হানাদার সৈন্যদের বেপরােয়া আক্রমণে এসব ব্যাংকের কর্মচারীরা হয়। নিহত হয়েছে না হয় আত্মগােপন করেছে। তাই সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকার বেহায়ার মতাে ব্যাংকের কর্মচারীদের কাজে যােগ দেয়ার জন্য অবিরাম ভাবে call করে চলেছেন। শেষ পর্যন্ত নতুন Appointment দেয়া থানার দারােগা C.0. Developments এস.ডি.ও আর জেলার ডেপুটি কমিশনারদের পাঁচশ’ আর একশ’ টাকা জমা নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কি অপূর্ব ব্যবস্থা আর দায়িত্ববােধ। অবশ্য জঙ্গী সরকারের এতে কিসসু যায় আসে না। কেননা টাকা জমা নেয়ার পরে তাে আর ভাংচা দেয়া হবে না। দেয়া হবে সাদা কাগজের রসিদ। মাঝ থেকে লােকগুলাের বাপ-দাদার ঠিকানা পাওয়া যাবে আর বাড়ির অবস্থাটাও জানা যাবে।
কিন্তু এ কি? এত হৈ চৈ করার পরও বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকার লােকগুলাে টাকা জমা দিল না? মিলিটারি Wireless-এ এসব দুঃসংবাদ যেয়ে পৌঁছানাের সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গী সরকারের Advisor রা মাথার চুল ছিড়তে শুরু করেছে। এখন উপায়? মাঝ থেকে হানাদার সৈন্যরা অক্করে চেইত্যা গেছে। এদের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কেননা হ্যাতাইনগাে কাছে বেশ কিছু পাঁচশ’ আর একশ’ টাকার নােট রয়েছে। লুটের বখরা হিসেবে এসব নােট এদের পকেটে এসেছে। এরা কাঁধের স্টেনগান আর মেসিনগান মাটিতে রেখে বুক চাপড়িয়ে ইয়া আলী, ইয়া আলী’ করতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকার প্রতিটি সামরিক ছাউনী থেকে শুরু করে ট্রেঞ্চ আর বাংকারগুলােতে বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। কিন্তু উপায় নেই গােলাম হােসেন! ইসলামাবাদের খােদ জঙ্গী সরকারেরই এখন পেরেশান অবস্থা। আল্লাহ্র মাইর, দুনিয়ার বাইর। টাকা টাকা। করেই সেনাপতি ইয়াহিয়া একেবারে ঘাউয়া হয়ে উঠেছেন।
ঠিক এমনি একটা অবস্থায় করাচীতে আবার একটা জব্বর খবর রটে গেছে। পাঁচশ আর একশ’ টাকার নোেট ফেরৎ না পাওয়ায় জঙ্গী সরকার এবার পঞ্চাশ আর দশ টাকার নােটেরও হেই কাম করে দেবেন। আর যায় কোথায়? জাতির চোটে করাচীর স্টক এক্সচেঞ্চ অনির্দিষ্ট কালের জন্যে বন্ধ ঘােষণা করা হয়েছে। এখন বুঝুন কোথাকার water কোথায় যেয়ে stand করবে। সেনাপতি ইয়হিয়া বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে আর একটা রেকর্ড করতে চলেছেন। ধ্যাত্যরি না বলে কবে না দেশের সমস্ত ধরনের মুদ্রাই বেআইনী করে বসেন। অবশ্য দিনকে দিন অবস্থা যে দিকে চলেছে তাতে সে অবস্থার আর বেশি দেরী নেই। কি সােন্দর তখন পাকিস্তান আর বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকায় Barter system চালু হবে। হেট গরু হেটু বলে গলায় দড়ি লাগিয়ে গরু টেনে একজনের উঠানে দাঁড় করিয়ে দু’মন চাল নিতে হবে। গােটা দশেক লাউ এনে একসের সাবান কিনতে হবে কিংবা ছেলের অসুখ ভালাে করবার জন্য ডাক্তার সা’বের কাছে একটা খাসী নিয়ে হাজির হতে হবে।
সেনাপতি ইয়াহিয়ার জঙ্গী সরকার এখন অক্করে দিগবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের দোস্ত দেশগুলাের আবার এর মধ্যে বাকিতে মাল দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কনসর্টিয়ামের দেশগুলাে টাকা দেয়ার ব্যাপারে আও-শব্দ পর্যন্ত করছে না। আর এদিকে বাংলাদেশে মুক্তিফৌজের গাবুর মাইর শুরু হয়ে গেছে। বড় বড় গোঁফওয়ালা জেনারেলরা সব বাংলাদেশের আঁঠালে মাটির মধ্যে আটকা পড়েছেন। তারা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন- আইতে শাল যাইতে শাল- হ্যার নাম বরিশাল। এখন হেই বরিশালের পানিতে হব্বাই চুবানি খাইতাছে। আর করাচীতে শুরু হয়ে গেছে। মানে কিনা গ্যাজাম শুরু হয়ে গেছে। সবার মুখে এক কথা। “গিয়া, গিয়া সব তাবা হাে গিয়া। হ্যায় ইয়াহিয়া তুমনে ইয়ে কেয়া কিয়া?”
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল