১১ জুন ১৯৭১
আগেই কইছিলাম হ্যাগাে দিয়া কিছুই বিশ্বাস নাই। হ্যারা হগল কাম করতে পারে। কেননা সুযােগ পেলেই পাকিস্তানের এই নরপশুর দল যেমন নিরস্ত্র জনসাধারণের উপর পৈশাচিক বর্বরতার উল্লাসে মাতােয়ারা হয়ে উঠতে পারে, তেমনি ক্যাদোর মধ্যে পড়লে এরা পা পর্যন্ত ধরতে দ্বিধা বােধ করে না। এখন সেনাপতি ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী সেই ক্যাদোর মধ্যে হুইত্যা আছে। আর তাই ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকার আজকাল আবােল-তাবােল বলতে শুরু করেছে। ২৫শে মার্চ রাতে বাংলাদেশের বীভৎস হত্যাকাণ্ড শুরু করার পর যে হানাদর বাহিনী ঢাকা থেকে সমস্ত বিদেশী সাংবাদিকদের বের করে। দিয়েছিল, সেই হানাদার বাহিনী মাত্র একমাসের মাথায় আবার ছ’জন বিদেশী সাংবাদিককে দাওয়াত করে এনেছিল। কিন্তু জঙ্গী সরকারের কপালটাই খারাপ। এসব সাংবাদিকরা ভাণ্ডা একেবারে ফুট করে দিয়েছে।
বাংলাদশে ভয়াবহ নরহত্যা আর নরপশুদের তাণ্ডবলীলার খবরে মানবতার সেবায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্তর্জাতিক রেডক্রস বিমান বােঝাই মেডিকেল সাহায্য পাঠালে যে ইয়াহিয়া সরকার এক সময় তা ফেরত দিয়ে সদম্ভে ঘােষণা করেছিল ‘কৈ Aid কা জরুরত নেহী হ্যায় ইয়ে সব্ হমলােককা Internal Affair হ্যায়’- সেই ইয়াহিয়া সরকার এখন আন্তর্জাতিক রেডক্রশ ছাড়াও বিশ্বের সমস্ত সাহায্য সংস্থার কাছে দরবার করে বেড়াচ্ছে। অবশ্য এরা হচ্ছেন জ্ঞান-পাগল। অর্থাৎ যে মুহূর্তে ইসলামাবাদের জঙ্গী সরকার বুঝতে পারলাে যে কাজটা খুবই খারাপ হয়ে গেছে আর ভারতে চলে যাওয়া বাঙালি শরণার্থীদের জন্য বিশ্বের সমস্ত দেশ থেকে মাল-পানি আসতে শুরু করেছে, সেই মুহূর্তে কাঁউ কাউ শুরু করলে। হে বাবা, অন্ধ নাচার বাবা, চাইট্টা ভিক্ষা দাও বাবা।
যে মুহূর্তে ইয়াহিয়া সা’ব টের পেলেন যে জাতিসংঘ আর বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকা সফর করবেন, সেই মুহূর্তে অন্তত দখলকৃত ঢাকা শহরের অবস্থা স্বাভাবিক দেখাবার জন্য আরও গােটা কুড়ি সামরিক ক্যাম্প খুলে কারফিউ উঠিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। কেননা বিশ্ব ব্যাংক থেকে ইসলামাবাদে এর মধ্যেই একটা টেলিগ্রাম এসেছে ‘দেখ অমাদের বােকা বানাবার চেষ্টা করাে না। আমরা তদন্ত করে আসল ব্যাপারটা জানতে পারবই?”
যখনই জঙ্গী সরকার বুঝতে পারলেন যে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষ্যামতা না দেয়া পর্যন্ত পশ্চিমা দেশগুলাে থেকে কি বলে মাল-পানি আসবে না, তখনই এদের ঘেটুরা ‘দেশপ্রেমিক আওয়ামী লীগ মেম্বারদের খুঁজতে শুরু করে দিলেন। কেননা নিজেদের ইসলাম-পছন্দ নেতারা তাে ইলেকশনে গা মেরেছে।
কিন্তু এদিকে ধােলাই শুরু হয়ে গেছে। ইসলামাবাদের সামরিক জান্তার উপর জাতিসংঘ আর পশ্চিমা দেশগুলাের জোর ধােলাই শুরু হয়েছে। চোর ধরা পড়লে পুলিশ যেমন করে কথা আদায়ের জন্য ধােলাই করে, অহন অক্করে হেই ধােলাই হইত্যাছে। কোবানির চোটে জঙ্গী সরকার হগ্গল কথা কইয়্যা ফালাইছে। সেনাপতি ইয়াহিয়া এখন মানুষের চামড়া দিয়ে বানানাে ডুগডুগি বাজাতে শুরু করেছেন। আর কসাই টিক্কা রক্তমাখা হাত মুছে চোঙ্গা হাতে নিয়েছেন। মেসিনগানটা টেবিলের উপর রেখে রেডিওতে বক্তৃতা ঝেড়েছেন। আগের দফায় টিক্কা সা’ব মুক্তিফৌজের বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পুলিশ ও ইপিআরের জওয়ানদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। এরপর বাঙালি শরণার্থীদের দরদে দিল জারে জার করে ফিরে আসবার জন্য call করেছিলেন। আর এবার বাঙালি কৃষক, শ্রমিক, ডাক্তার, মােক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, শিক্ষক, ছাত্র, মুক্তিফৌজ মায় রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের পর্যন্ত বাড়ি ঘরে ফিরে আসবার দাওয়াত করেছেন। টিক্কা বলেছেন, আপনাদের জন্যে আঃ বাঃ ফ্রি অর্থাৎ কিনা আহার ও বাসস্থান ফ্রি’। এখন বুঝুন কোবানির চোটটা কি পরিমাণে হয়েছে।
এদিকে হানাদার বাহিনী লাল সালুর উপর তুলা দিয়ে সাইন বাের্ড লিখে দখলকৃত এলাকায় বিশটা Reception counter খুলেছে। কোরবাণীর খাসি যেমন করে জবাই করবার আগে ভালাে করে গােসল করিয়ে জবাই করা হয়, এইড্যা অক্কারে হেই ব্যাবস্থা। কাঁদবাম না হাঁসবাম! বাংলাদেশে হানাদার বাহিনী পাঁচ লাখ নিরস্ত্র লােককে হত্যা, দুই কোটি লােকে বাস্তচ্যুত আর পঞ্চাশ লাখ লােককে সীমান্তের অপর পারে পাঠিয়ে দিয়ে এখন আবার দাওয়াত দিয়ে Reception counter খুলে বসেছে। কি বিচিত্র এ দেশ সেলুকাস! নরখাদকদের বােঝা উচিত যে, নেড়ে বেলতলায় একবারই যায়।
হঠাৎ করে সেদিন ঢাকা শহর একেবারে সরগরম হয়ে উঠলাে। ধূসর রংগের জিপগুলাে সব মেসিনগান উঁচিয়ে গবর্ণমেন্ট হাউস অর কুর্মিটোলার মধ্যে জোর দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল। জব্বর খবর। মেহেরপুর থাইক্য জব্বর খবর আইছে। সেখানে এক হাজার শরণার্থী ফিরে এসেছে। জেনারেল নিয়াজী হেলিকপ্টারে দৌড়ালেন। যেয়ে দেখলেন তার রাজাকারের দল Reception counter-এ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। এক হাজার লােক তারা ঠিকই পেয়েছে। রাতে তাদের ভালাে করে খাওন-দাওনের পর হেই কামের জন্য নেয়া হয়েছিল। কিন্তু হায় আল্লাহ্! এগুলাে তাে বাংলায় কথা কয় না, এগুলাে উর্দুতে কথা কয়! নিয়াজী অক্করে পিয়াজী হয়ে গেলেন। লগে লগে order দিলেন ওসব কিছু বুঝি না। হামকো বাঙালি রিফুজি চাহিয়ে। ও লােগ আগর নেহি আতা হ্যায় তাে গাঁও সে পাকড়কে লাও। তারপর বুঝতেই পারছেন হেগাে কারবারটা।
বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকায় এখন জ্যান্ত লােক ধরবার জন্য হা-ডু-ডু খেলা শুরু হয়ে গেছে। জাতিসংঘের প্রতিনিধি আসার আগেই এসব Reception counter বাঙালি দিয়ে ভরে প্রমাণ করতে হবে যে, শরণার্থীরা পাকিস্তান পা-পা-পায়েন্দাবাদ বলে ফিরে আসতে শুরু করেছে। আর তা হলেই কাম্ ফতে। কোটি কোটি টাকার সাহায্য আসবে। হারবান দেখতে চমৎকার ভাই, হারবান দেখতে চমত্তার।
আর এদিকে টিক্কা খান সবার উপরে টেক্কা মেরে দিয়েছেন। তিনি বাঙালি শরণার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, আপনারা আইস্যা দেখুন আপনাদের আত্মীয়স্বজনরা কি সােন্দর দেশ গঠনের কামে লাইগ্যা পড়ছে। আত্মীয়স্বজনরা বাইচ্যা থাকলে তাে কাম করবাে? নাকি মরা মানুষও আইজ কাইল কাম করে!
কিন্তু বেচারা টিক্কা করবে কি? আঁতি আর কোবানির চোটে অহন আর মুখ দিয়া অক্করে খই ফুটতাছে। তাই টিক্কা সাব এখন সবাইকে ডেকে পাঠিয়েছেন। উনি বৈষ্ণব হয়েছেন।
তাই আগেই কইছিলাম হেগাে দিয়া কিছুই বিশ্বাস নেই। হেরা হগল কাম করতে পারে। হেরা যে কোনাে দিন অক্করে পগার পার হইতেও পারে। কেননা হেই টাইম তাে আইস্যা গ্যাছে।
সূত্র: চরমপত্র – এম আর আখতার মুকুল