You dont have javascript enabled! Please enable it! 1966.04.09 | ছয় দফার অন্তরালে | দৈনিক পয়গাম - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক পয়গাম
৯ই জুলাই ১৯৬৬

ছয় দফার অন্তরালে

আওয়ামী লীগের ছয় দফার অন্তরালে বাইরের এবং বিশেষ করিয়া পাকিস্তানের দুশমন চক্রের গােপন হস্ত সক্রিয় রহিয়াছে, তা কারাে জানার বাকী নাই। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকে, তার তরক্কী ও অগ্রগতিকে যারা বরদাশত করিতে নারাজ, তারা ভিতর এবং বাহির হইতে যুগপভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধাচরণ করিয়া যাইতেছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দিকসহ হেন দিক নাই—যে দিকে তাদের গােপন হস্ত সক্রিয় নয়। এমনকি, পাকিস্তানের উপরে যুদ্ধ চাপাইয়া দিয়াও তারা তার অস্তিত্বকে খতম করার কারসাজিতে লিপ্ত হইতে কসুর করে নাই। কিন্তু দশ কোটি পাকিস্তানী নিজেদের আজাদী, দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতৃকে নস্যাৎ হইতে দেয় নাই। সিংহশক্তিতে দুশমনের উপরে ঝাপাইয়া পড়িয়া দুশমনদের যুদ্ধের সাধ মিটাইয়া দিয়াছে।
কিন্তু কথায় বলে, দুশমন হাতে মারিতে না পারিলেও ভাতে মারার প্রচেষ্টা হইতে সহজে নিবৃত্ত হয় না। তাই যুদ্ধের ময়দান ছাড়িয়া তারা এখন গােপনপন্থা অবলম্বন করিয়াছে। কখনাে সাহিত্যের নামে, কখনাে কালচারের নামে আবার কখনাে পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রতি “মাসির” দরদে গদগদ হইয়া তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতৃ ও সংহতির মধ্যে ফাটল ধরাইবার বদ মতলবে মাতিয়া আছে। একই কারণে তারা প্রদেশের একশ্রেণীর লােককে নিজেদের দালালীর কাজেও নিয়ােগ ছাড়ে নাই। আর এই শ্রেণীর দালালরা কখনাে সজ্ঞানে কখনােবা অজ্ঞানেই তাদের হাতের পুতুল সাজিয়া নাচের আসর জমাইতেছে। কিছুদিন আগে এই চেলাচামুণ্ডাদের “সাফল্যজনক অগ্রগতির খবর “নিউইয়র্ক টাইমস” ফলাও করিয়া প্রকাশ করিয়া দিয়া, অজান্তেই থলের মধ্যকার কাল বিড়ালটির অস্তিত্বকে কিভাবে পাকিস্তানী জনসাধারণের সম্মুখে প্রকাশ করিয়া দিয়াছে, পয়গামের পাঠকবৃন্দের তা অজানা থাকার কথা নয়। অন্যদিকে “সাপ্তাহিক টাইমস” পত্রিকাও কিভাবে এই জাতীয় বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী, সংহতি বিরােধী ব্যক্তিদের পূর্ব পাকিস্তানীদের নেতা হিসেবে চিত্রিত করার ঘৃণ্য অপপ্রয়াস পাইয়াছে, পয়গামের’ ‘চিঠিপত্র কলামে তাও প্রকাশ পাইয়াছে।
বস্তুতঃ, ছয় দফার ধ্বজাধারী আওয়ামী লীগের মতলব ও কার্যসূচী সম্পর্কে সরকারী দলের তরফ হইতেই শুধু সতর্কবাণী উচ্চারিত হয় নাই; এক সময়কার সম্মিলিত বিরােধী দলের অপরাপর প্রত্যেকটি দলও আওয়ামী লীগের ছয় দফার অন্তরালবর্তী মতলবের সকল গােমর ফাস করিয়া দিয়াছে। এইসব দলের মধ্যে রহিয়াছে কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মত প্রভাবশালী বিরােধী দলসমূহ। ইহারা সকলেই এক বাক্যে ছয় দফাকে পাকিস্তানের অস্তিত্বের প্রতি বিপজ্জনক ও দেশের ঐক্য ও সংহতির পরিপন্থী বলিয়া রায় দিয়াছে। সরকারী দল ও বিরােধী দলের এই সম্মিলিত রায় যে পূর্ব পাকিস্তান তথা গােটা পাকিস্তানের জনসাধারণেরই নির্ভেজাল রায়, তা আর বুঝাইয়া বলার দরকার হয় না।
ভারতীয় বেতার কেন্দ্রের সার্বক্ষণিক হাওয়াই তৎপরতা ছাড়াও অতিসম্প্রতি ভারতের ‘জনসেবক’ নামক এক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধও এই কথাই প্রমাণ করিয়া দিয়াছে যে, ছয় দফার বিরুদ্ধে জনগণের এই রায় কত সত্য এবং পাকিস্তানের জানি দুষমনদের ও তাদের ঘৃণ্যদালালদের বিরুদ্ধে দেশবাসীর ঐক্য, সংহতির আওয়াজ সত্যই কত জোরদার। ভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত এই নিবন্ধটিতে একথাই আরেকবার প্রমাণিত হইয়া গেল, ভারত ছয়দফা আন্দোলনের ব্যাপারে শুধু গভীরভাবে আগ্রহী নয়, ইহার সাথে সে জড়িতও রহিয়াছে। প্রবন্ধটিতে বলা হইয়াছে, ছয় দফার উদ্যোক্তাদের তথাকথিত স্বায়ত্তশাসন দাবী পূর্ব পাকিস্তানের ‘আজাদী’ অর্জনেরই সুষ্ঠু পদক্ষেপ। এবং এই ‘আজাদী’ অর্জনের পরে ছয় দফাওয়ালারা যে পূর্ব পাকিস্তানকে ভারতীয় ইউনিয়নের সংগে সংযুক্ত করিয়া ফেলিবে, প্রবন্ধটিতে সে বিষয়েও সুস্পষ্ট ইংগিত রহিয়াছে।
এখন ইহা বুঝিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, পূর্ব পাকিস্তানীরা তথা গােটা পাকিস্তানীবাসী ছয় দফার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইয়া শুধু আওয়ামী লীগের বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে নাই, ভারতের এক ঘৃণ্য চক্রান্তকেও বানচাল করিয়া দিয়াছে। সেপ্টেম্বরের যুদ্ধের পরে ইহা পাকিস্তানের দ্বিতীয় বিজয় বলিতে হইবে। অথবা আরাে খােলাসা করিয়া বলা চলে, পশ্চিম পাকিস্তানের উপরে চাপানাে অঘােষিত ভারতীয় সামরিক আক্রমণকে পাকিস্তান যেভাবে নেস্তনাবুদ করিয়া দিয়াছে, তেমনিভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের বুকে ভারতের ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা তথা যুদ্ধেও পাকিস্তান বিজয়মাল্য অর্জন করিয়াছে।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব