You dont have javascript enabled! Please enable it!

দৈনিক পূর্বদেশ
২৩ এপ্রিল ১৯৬৭

আজ ঢাকায় সর্বদলীয় বৈঠক বসছে
পূর্ব পাকিস্তানের দাবী স্বীকার করে
ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন অপরিহার্য
(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)

আজ ২৩শে এপ্রিল।-আজ ঢাকায় বিরােধী দলগুলাের নেতৃবৃন্দের বৈঠক বসছে। এই বৈঠকে দেশব্যাপী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং ব্যক্তি কেন্দ্রীক শাসনের অবসান দাবীতে সর্বদলীয় ভিত্তিতে আন্দোলন পরিচালনা সম্পর্কে একটি ন্যূনতম কাৰ্যসূচী প্রণয়নের চেষ্টা করা হবে। কার্যসূচী প্রণয়ন করা গেলে শীঘ্রই নেতৃবৃন্দ আর একটি বৈঠকে মিলিত হয়ে আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিবেন এবং কি ভিত্তিতে আন্দোলন চলবে তাও ঘােষণা করবেন।
গত কয়দিন ঢাকায় বিভিন্ন দলের নেতারা পরস্পরের সঙ্গে যােগাযােগ করে এই প্রশ্নের মতবিনিময় করেছেন নবাবজাদা নসরুল্লা, চৌধুরী মােহাম্মদ আলী, মিয়া দৌলতানা এবং এন, ডি, এফ নেতৃবৃন্দ একথা বিশেষ জোর দিয়ে বলেছেন যে, ন্যূনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন পরিচালনায় কোন অসুবিধা নেই। তবে প্রশ্ন দেখা দেবে আওয়ামী লীগ এবং ন্যাপের ভূমিকা নিয়ে। কারণ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা সর্বতােভাবে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পক্ষে হলেও আওয়ামী লীগের পীঠস্থান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতারা এই প্রশ্নে এখনও খােলাখুলি কিছু বলেননি। শেখ মুজিবর রহমান ইতিপূর্বে সর্বদলীয় আন্দোলন নীতিগতভাবে সমর্থন করে। একথাও বলেছেন যে, ছয়দফা প্রশ্নে তারা যতদূর অগ্রসর হয়েছেন তাতে তাদের পক্ষে নতুন কোন কর্মসূচী ঘােষণা করে নতুন করে আসর জমিয়ে তােলা সম্ভব নয়। ছয়দফার আন্দোলন তাদের করতেই হবে।
ক্ষমতাসীন মহল সর্বদলীয় ভিত্তিতে দেশব্যাপী আন্দোলনের প্রশ্নে বিচলিত বােধ করেন। তাই দেখে রাজনীতির বিশেষ করে বিরােধী দলের ভূমিকা আপাতত অক্ষুন্ন রাখতে দিতে তারা রাজী। এতে তাদের দ্বিবিধ উদ্দেশ্য সাধিত হবে। প্রথমতঃ বিশ্বের সম্মুখে একথা তুলে ধরা যাবে যে, পাকিস্তানে বিরােধী দলীয় মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। দ্বিতীয়তঃ বিচ্ছিন্নভাবে বিরােধী দল কাজ করে গেলে তা তাদের জন্য এমন কোন দুশ্চিন্তার কারণ হবে না। তাই কোন রাজনৈতিক দল আলাদাভাবে কাজ করতে চাইলে তাতে ক্ষমতাসীন মহলের নারাজ হবার কিছুই নেই। এজন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি মহল এই প্রশ্ন তুলেছেন যে, আলাদাভাবে আন্দোলন করে কতদূর অগ্রসর হওয়া যাবে! তারা চান ন্যূনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর দলীয় কর্মসূচী অনুযায়ী নির্বাচনী অভিযান পরিচালনা করতে। কিন্তু এই প্রশ্নে আপােষ করতে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মহল এখনও মনে হয় নারাজ।
এদিকে ন্যাপও এই প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত। ন্যাপের ডানপন্থী (মস্কো) ফ্রন্ট সর্বদলীয় আন্দোলনের পক্ষপাতি। এই মতবাদের সমর্থক নেতারা এখন কারাগারে আবদ্ধ। কিন্তু ন্যাপেরও প্রভাবশালী মহল সরকারের তথাকথিত পররাষ্ট্র নীতির অন্ধ সমর্থক। ফলে অন্য কোন বড় সমস্যা দেখা দিলেও এদের পক্ষে সরকারের তেমন বিরােধিতা করার উপায় থাকে না। গত কয়দিন অবশ্য আওয়ামী লীগ এবং ন্যাপের এই মতবাদীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে বুঝবার জোর চেষ্টা চলেছে। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা কতদূর কামিয়াবী হয়েছেন তা এখনও বলা না গেলেও একথা বুঝা যাচ্ছে যে, অন্ততঃ তাদের মৌন সম্মতি নিয়ে আজকের বৈঠকের আয়ােজন করা হয়েছে।
বর্তমানে দেশে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তাতে দুটি মৌলিক প্রশ্ন সকল মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার কথা। একটি হলাে, বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে লড়তে হলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া তা সম্ভব কিনা এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করেও শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিকদের কাছে পূর্ব পাকিস্তান সুবিচার পাবে কিনা। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের কাছে শেষ প্রশ্নটিই অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়া অবধি পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনদের কাছে কোনদিন সুবিচার পায়নি এবং আজও শুভঙ্করের ফাঁক সৃষ্টি করে একই সহজ পথে পূর্ব পাকিস্তানীদের তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অবশ্য এবার পরে যেন ভুল বুঝাবুঝি না হয় সেজন্য পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা নাকি পূর্বাহ্নেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে একটি খসড়া প্রণয়ন করে এনেছেন। সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানের যে সমস্ত নেতা আজকের বৈঠকে যােগ দিচ্ছেন, তাঁদের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য হবে পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাদের বন্ধুদের সঙ্গে বােঝাপড়া করে নেয়া। একথা পূর্ব বাংলার মানুষ আজও বিশ্বাস করে যে, তাদের নিয়ে বঞ্চনার শেষ নেই। আমাদের বর্তমান নেতাদের অনেকেই তাদের রাজনৈতিক কর্মক্ষমতার শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন। সুতরাং এই শেষ মুহূর্তে তাদের অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে অগ্রসর হতে হবে। একথা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, যে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালিত হবে, শেষ পর্যন্ত এদেশের মানুষ যেন সেই ধরনের কেন্দ্রীয় শাসনের যন্ত্রে আটকা না পড়ে। কথায় আছে, আগের বেজার ভাল। তাই পশ্চিম পাকিস্তানের বন্ধুরা যদি তিনটি বিষয় ছাড়া বাদবাকী ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে দলীল করতে রাজী হন, তা হলে আপাততঃ ন্যূনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করা যেতে পারে। আর যদি এক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের মন সংশয়মুক্ত না হয় তবে এই আন্দোলনের কোন ফায়দা হবে না। বরঞ্চ এই কয় বছরে এখানকার মানুষ যেটুকু এগিয়েছে তাও বিস্মৃতির অতল তলে তলিয়ে যাবে। সুতরাং আগেভাগে বােঝাপড়া করতে হবে আমাদের ভবিষ্যত প্রশ্নে। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা যদি পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে স্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করতে অপারগ হন, তবে সেক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিতেই আন্দোলন। পরিচালনা করতে হবে। সেখানে কোন দলের একক কর্মসূচীর কোন প্রশ্ন উঠবে না। আত্মমর্যাদা এবং ব্যক্তিপ্রাধান্যের কথা ভুলে সকলকে একসঙ্গে একই প্ল্যাটফর্মে সমবেত হয়ে স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন করে যেতে হবে। সেই আন্দোলন যত দুঃখ এবং নির্যাতনই ডেকে আনুক তা বরণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। নির্ভিকচিত্তে সকলকে সম্মুখে এগিয়ে যেতে হবে।
পর্যবেক্ষক মহল বর্তমান বৈঠকের উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছেন এবং তারা কায়মনে আশা করেন, জাতির ভবিষ্যতের প্রতি লক্ষ্য রেখে আজকের এই বৈঠক সুদূরপ্রসারী কর্মসূচী গ্রহণ করতে সক্ষম হবে।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!