দৈনিক পয়গাম
২৫শে আগষ্ট ১৯৬৭
রাজনৈতিক হালচাল
আওয়ামী লীগের তাসের ঘর অবশেষে ভাঙ্গিয়া পড়িল। শেখ মুজিবর রহমানের ৬-দফাপন্থী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ১৯শে আগষ্টের কাউন্সিল সভায় নওয়াবজাদা নসরুল্লা খানের ৮-দফাপন্থী পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট দেখাইয়া স্বাধীন হইয়াছে। তাহাদের প্রস্তাবে বলা হইয়াছে যে, ৮দফা প্রােগ্রাম ‘শােষিত ও নির্যাতিত জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী, কাজেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ উহাতে যােগদান করিবে না এবং ৮-দফাপন্থীদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখিবে না। আওয়ামী লীগের মধ্যে ৮-দফা সমর্থক ১৪ জন বড় বড় নেতাকে তাহারা সর্বসম্মতিক্রমে’ সাসপেন্ড করিয়াছে এবং তাহাদিগকে কেন দল হইতে বাহির করিয়া দেওয়া হইবে না, ইহার কৈফিয়ৎ তলব করিয়াছে। ইহাদের মধ্যে সাবেক আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্ট মৌলানা তর্কবাগীশ, প্রাক্তন মন্ত্রী সালাম খান, জহিরুদ্দিনরাও আছেন। ওদিকে নওয়াবজাদা নসরুল্লা খান ও এইসব বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগ দিগগজরাও বসিয়া নাই। তাহারা পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকিয়া পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি বাতিল করিয়া দিয়াছেন। ইহাদের বিরুদ্ধে চার্জের অন্ত নাই। পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল-সেক্রেটারী গােলাম মােহাম্মদ খান লুখাের পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের অস্থায়ী জেনারেল-সেক্রেটারী আমেনা বেগমের দলকে ‘ডামি বা গােবর গণেশ আখ্যায়িত করিয়া তাহাদের বিরুদ্ধে কার্যতঃ দেশদ্রোহিতার চার্জ আনিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন ও ‘আমেনা বেগমের (আওয়ামী লীগ) দল পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কাজ করিতেছে। অদমনীয় আমেনা বেগমও কিছু কম যান না। তিনিও পাকিস্তান আওয়ামী লীগওয়ালাদের বিরুদ্ধে বহু প্রকার চার্জ উত্থাপন করিয়াছেন। এসব চার্জ ও কাউন্টারচার্জ আজ নূতন নয়। দুই দলের অভিযােগ, পাল্টা-অভিযােগ আজ অনেক দিন যাবতই চলিতেছে। উহারই চরম পরিণতিরূপে ভাঙ্গা-ভাঙ্গিটা চূড়ান্ত হইল, শেখ মুজিবের পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কন্ট্রোলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া স্বাধীন হইল এবং উভয় দলই একে অপরকে ডিসমিষ করিয়া পরিতৃপ্ত হইল।
আওয়ামী লীগের এই ভাঙ্গন নূতন কিছু নয়। ১৯৪৯ সালে এই দল সৃষ্টির পর হইতেই ভাঙ্গাভাঙ্গি চলিয়া আসিতেছে। এবং এবারেরটা লইয়া হইল পঞ্চম ভাঙ্গা ও প্রথমবার ভাঙ্গাভাঙ্গি হয় ১৯৫৩ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের ‘মুসলিম নিধন লইয়া। মুসলিম পন্থীরা তখন বেজায় সংখ্যালঘু। তাহাদিগকে নস্যাৎ করিয়া দিয়া বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ “মুসলিম”-নিধনকারীরা জয়যুক্ত হইল, “মুসলিম”-এর গলা কাটিয়া তাহারা করিল আওয়ামী লীগ সেই সময় কিছু লােক বাহির হইয়া গেল। দ্বিতীয় দফা ভাঙ্গাভাঙ্গি হইল ১৯৫৫ সালে যুক্তফ্রন্ট নেতা ফজলুল হক সাহেবের বিরুদ্ধে শেখ মুজিব গ্রুপের অনাস্থা প্রস্তাবকে কেন্দ্র করিয়া। সালাম খান উহার বিরােধিতা করিয়া ৩২ জন পরিষদ-সদস্য ও কিছু সংখ্যক কর্মী লইয়া দল হইতে বাহির হইয়া গেলেন এবং পরে তাহাদিগকে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ হইতে বাহিরও করিয়া দেওয়া হইল। তৃতীয় দফা ভাঙ্গন ঘটিল ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাতা মৌলানা ভাসানী সাহেব তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী সাহেবের মার্কিন তােষণনীতির প্রতিবাদে আওয়ামী লীগকে ‘সালাম আলায়কুম’ জানাইয়া ১২ জন পরিষদ সদস্য ও বেশ কিছুসংখ্যক কর্মী লইয়া দলত্যাগ করিয়া ভিন্ন দল গঠন করিলেন। তাদের অহি-নকুল সম্পর্ক অদ্যাবধি চলিতেছে। চতুর্থ দফা ভাঙ্গাভাঙ্গি হইল ১৯৬৪ সালে এনডি-এফ গঠন-তথা রাজনৈতিক দল পুনরুজীবনের প্রশ্নে। শহীদ সাহেব বৈরুতে মৃত্যুর প্রাক্কালে ৪০ পৃষ্ঠাব্যাপী একটি রাজনৈতিক অছিয়তনামা’ স্বীয় শিষ্য-শাগরেদদের জন্য রাখিয়া যান। কোন কুরিয়ার মারফত উহা শহীদ সাহেবের মৃত্যুর পর মানিক মিয়ার হস্তগত হয়। শহীদ সাহেব উহাতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন যে, তখনও দল পুনরুজ্জীবিত করার সময় আসে নাই, সময় আসিলেও আওয়ামী লীগ নামে আর দল করিয়া সুবিধা হইবে না। তিনি ‘নূতন কোন লাইনে’ চিন্তা করিতেছিলেন। কিন্তু শহীদ সাহেবের লাশ মাটিতে মিশিয়া যাইবার পূর্বেই তাঁর সর্বশেষ ইচ্ছা-অভিমত সম্বলিত ৪০ পৃষ্ঠার ‘অছিয়ত নামারও দাফন হইয়া গেল এবং শেখ মুজিবের দল পার্টি ‘রিভাইজ’ করিলেন। ইহার বিরােধিতা আতাউর রহমান, আবুল মনসুর প্রমুখ বিশিষ্ট আওয়ামী লীগারগণ দলত্যাগ করিয়া এন-ডি-এফ করিলেন। সর্বশেষ-এইবার হইল পঞ্চম ও চূড়ান্ত ভাঙ্গন।
এই পাঁচ-দফা ভাঙ্গন ‘জাহেরী। কিন্তু বাতেনী ভাঙ্গন আওয়ামী লীগের মধ্যে আগাগােড়াই চলিয়া আসিতেছে। কে কাকে কুনই মারিয়া কুপাকাত করিবে, সেটা ভিতরের খেলা। ঐ পাশা খেলায় পড়িয়া আওয়ামী লীগের আদি-সংগঠক শামসুল হক শেখ মুজিবের কাছে হারিয়া গেলেন এবং শেষ পর্যন্ত উন্মাদ, গৃহত্যাগী হইয়া নিরুদ্দিষ্ট হইলেন। এমনিভাবে শেখ মুজিবের কুক্ষিগত আওয়ামী লীগে মৌলানা ভাসানী, সালাম খান, খয়রাত হােসেন, খদ্দর মিয়া, আতাউর রহমান, আবুল মনসুর, সর্বশেষ তর্কবাগীশ, জহিরুদ্দিনরা কেহই টিকিতে পারিলেন না। শামসুল হকের মত ইহারা পাগল হন নাই বটে, তবে আওয়ামী লীগের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমানের পাগল হইবার বেশী বাকীও ছিল না। শেখ মুজিবের কনুইয়ের তা খাইতে খাইতে অতীষ্ট হইয়া পৌনে দুই বছরের ওজারতিতে অন্ততঃ চারবার তিনি পদত্যাগ করিতে উদ্যত হন। সবশেষবারের ঘটনাটা অত্যন্ত উপভােগ্য। যুক্তফ্রন্ট আওয়ামী নাটকের শেষ অঙ্কে দলীয় সংখ্যা-শক্তি নির্ণয়ের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সেক্রেটারী পীর আহসানুদ্দিন আসিয়া গভর্ণর সুলতানুদ্দিন সাহেবের সামনে পরিষদ সদস্যদের “ফিজিক্যাল ডেমনস্ট্রেশন” প্যারেড বা ‘দৈহিক প্রদর্শনীর মহড়া করাইয়া যে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের অতবড় একটা কেরিকেচার করিয়াছিলেন এবং যুক্তফ্রন্ট, আওয়ামী লীগ-এর দৌলতে সবাই সেটা মানিয়া লইয়াছিল, সে কথা আশা করি, পাঠকগণ ভুলিয়া যান নাই। আতাউর রহমান সাহেব সেই সময়কার কাহিনী বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেন।
“দলীয় নেতাদের কাজ বেড়ে গেল। আমাদের দল নিয়েই বেশী মুশকিলে পড়তে হল। আমাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নেতা নির্বাচন করে আবার নূতনভাবে মন্ত্রীত্ব গঠন করার উপায় উদ্ভাবন করতে লাগল। …স্থির করে ফেললাম, আর নেতার আস্থাও হারিয়ে ফেলেছি-এরপর রাজনীতির নাম মুখে আনাও বেহায়াপনা। কিন্তু কম্বলত ছাড়ে না।” শেষ পর্যন্ত কম্বল ছাড়িল না। গভর্ণর নূতন (ও সর্বশেষ) মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আতাউর রহমান খানকে কমিশন করিলেন। কিন্তু কমিশন পাইলেও পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের অপার মহিমায় কমিশনপ্রাপ্ত-লীডার আতাউর রহমানের কিছু করিবার অধিকার থাকিল না। সবই করিলেন সেন্ট্রাল সার্কিট হাউসের রুদ্ধদ্বার কক্ষে সােহরাওয়ার্দী সাহেব ও শেখ মুজিবর রহমানরা। আতাউর রহমানের সেখানে ডাক পড়িল না। তিনি কিছু জানিতেও পারিলেন না। পরিস্থিতিটা তাঁর মুখেই শুনুনঃ
“আমার সাথে কে কে মন্ত্রী হবেন, তার লিষ্টও নেতাই (অর্থাৎ শহীদ সাহেব) ঠিক করে দিলেন। আমাকে ডাকেনও নাই, জিজ্ঞেসও করেন নাই। তবে টেলিফোনে জানিয়ে দিলেন, কে কে মন্ত্রী হবেন আর কি কি বিভাগের ভার তারা নেবেন।…. নেতাকে খুব হাত করে নেওয়া হয়েছিল, নইলে এতটা করতে তিনি রাজী হতেন কি-না সন্দেহ। … স্থির করলাম যথেষ্ট হয়েছে, আর কেন ? এরপর কপালে কি আছে বলা যায় না। যে পাল্লায় পড়েছি, তাতে সহজে নিস্তার নাই। মরার পরও আক্রোশ থাকবে, এমনকি বাড়বেও হয়ত। ( নেতাকে) আমার সিদ্ধান্ত বললাম, … আল্লাহর ওয়াস্তে অব্যাহতি দিন। আমি কমিশন ফেরৎ দেই। যার গরজ বেশী, শখ বেশী, তিনি ভার নিন। তাকেই ডাকা হােক–।” (ওজারতির দুই বছর—৪৭ অধ্যায়) আতাউর রহমান সাহেবের কপাল ভাল-ইহার অল্প কিছুদিন পরেই অক্টোবরের বিপ্লব আসিয়া তাহাকে বাঁচাইয়া দিল, শামসুল হকের পথে আর তাহাকে যাইতে হইল না। তবে একথা আশা করি, তিনিও অস্বীকার করিতে পারিবেন না যে, দলীয় পাণ্ডারা মহানির্বাণ লাভের সেই মােক্ষম পথটিই তাঁহার জন্য পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের শেষ পর্যায়ে প্রস্তুত করিয়াছিলেন। মার্শাল ল’ তাহাকে রক্ষা করিল।
বস্তুতঃ ইহাই আওয়ামী লীগের পলিটিকস। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভাঙ্গনের বাণী লইয়াই আওয়ামী লীগের আবির্ভাব, ভাঙ্গনের ভিতর দিয়াই উহার তিরােভাব। ভাঙ্গনের এই প্রতিমূর্তিরা যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গিয়াছে, ২১-দফা ভাঙ্গিয়াছে। যুক্তফ্রন্ট দলপতি অশীতিপর বৃদ্ধ-নায়ক-ফজলুল হক সাহেবের উপর আঘাত হানিয়াছে, মৌলানা ভাসানীকে আঘাত করিয়াছে, শহীদ সােহরাওয়ার্দী সাহেবের শেষ ইচ্ছাকে কবর দিয়াছে, পার্টির গােড়াপত্তনকারী সেরা সেরা নেতাকে তাড়াইয়াছে, যেসব নিঃস্বার্থ কর্মী নাজিমুদ্দিন, নূরুল আমিন সরকারের হাতে নির্যাতন সহিয়া পার্টি সংগঠন করিয়াছে, পার্টিমুখপত্র প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, তাহাদিগকে বিতাড়িত করিয়াছে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধূমকেতুবৎ আবির্ভূত হইয়া উপযুক্তপরি ভাঙ্গাভাঙ্গির খেল খেলিয়া পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপর্যস্ত করিয়াছে, কার্জন হলকাগমারী সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের বুকে বৈদেশিক সংস্কৃতি আমদানী করিয়া জাতীয় দেহে মারাত্মক বিজাতীয় বিষ ঢুকাইয়াছে, ছাত্রতরুণদিগকে দলীয় রাজনীতিতে টানিয়া আনিয়া তাহাদের প্রতিজ্ঞা উন্মেষের বারটা ত বাজিয়াছেই, সেই সঙ্গে অশান্তি-উদ্ধৃঙ্খলতার একটা বন্যা বইতে চেষ্টা করিয়াছে এবং শেষ পর্যন্ত ৬-দফার ভিতর দিয়া জাতীয় সংহতি ও অণ্ডতা চূর্ণ-বিচূর্ণ করিয়া পাকিস্তানকেই ভাঙ্গিয়া ফেলিতে উদ্যত হইয়াছে। ইহাদের জাতীয় সংহতি বিরােধিতার কথা গােলাম মােহাম্মদ খান লুখােরের মত আজীবন সােহরাওয়ার্দী-ভক্ত গােড়া আওয়ামী লীডারও প্রকাশ্য বিবৃতিতে স্বীকার করিয়াছেন।
জনৈক বিশিষ্ট আওয়ামী নেতা ও একটি জেলার একজন প্রধান আওয়ামী পদাধিকারী দুঃখ করিয়া বলিয়াছেন ? ১৯শে আগষ্ট তারিখে হােটেল ইডেনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পাঁচ-ছয় ঘণ্টাব্যাপী সম্মেলনে যত বক্তৃতা ভাষণ হইয়াছে, তার কোনটিতে একটি বারের জন্যও “পূর্ব পাকিস্তান” শব্দটি উচ্চারিত হইতে শােনা যায় নাই, তৎস্থলে প্রত্যেকের মুখে শােনা গিয়াছে, “পূর্ব বঙ্গ”।
‘পাকিস্তান’ বা ‘পূর্ব পাকিস্তান নাম বর্জনের এই ইচ্ছাকৃত অপচেষ্টা দেখিয়া উক্ত আওয়ামী নেতা পর্যন্ত ভাবিত হইয়া পড়িয়াছেন। তবে কি ৬দফা শেষ পর্যন্ত ১-দফাতে আসিয়া ঠেকিবে ? কেন্দ্রীয় সংগঠনের প্রতি ইহাদের ‘সালাম আলয়কুম’ কি বৃহত্তর কিছুরই ইঙ্গিত বহন করে ? বর্ণিত আওয়ামী লীগ নেতা এই জিজ্ঞাসার জবাব এখনও পান নাই। হয়তাে বা পাইয়াছেন, সংশয় ….।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব