সংবাদ
১৭ই এপ্রিল ১৯৬৬
ছয় দফা প্রসঙ্গে
জনাব,
বিগত পাক-ভারত যুদ্ধের পর পাকিস্তানের বিশেষতঃ পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচাইতে বড় ঘটনা আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবী। উক্ত ছয় দফা দাবী সম্বন্ধে কমবেশী সবাই জ্ঞাত। উক্ত ছয় দফা দাবী পেশের পর প্রদেশের এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মনােভাব ও অবস্থা আমি যতদূর সম্ভব প্রকাশ করিতে চেষ্টা করিব।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ছয় দফা দাবীর উদ্যোক্তা। ছয় দফা দাবী পেশের পর আওয়ামী লীগ বাস্তবে দুই প্রদেশে প্রায় বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছে। কারণ পশ্চিম পাক আওয়ামী লীগের খুব কম অংশই ছয় দফা সমর্থন করিয়াছে। কারণ ইহা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের একটি বিশেষ গােষ্ঠী সবসময়ই পূর্ব পাকিস্তানকে বিরূপ দৃষ্টিতে দেখিয়া আসিয়াছে অবশ্য পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি তাহাদের যথেষ্ট “দরদ” রহিয়াছে এমন মনে করারও কোন প্রয়ােজন নাই। তাহারা সবসময়ই ব্যক্তি স্বার্থকেই বড় করিয়া দেখিয়া থাকেন-ইহা তাহাদের শ্রেণীগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
ছয়দফা দাবী পেশের পর নেজামে ইসলাম দল, জামাতে ইসলামী দল, কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রভৃতি রাজনৈতিক দল প্রায় প্রত্যেকই খােলাখুলিভাবে ছয় দফার বিরােধিতা করিয়াছে। ইতিমধ্যে জামাতে ইসলামী দল ও তৎপূর্বে এন,ডি,এফ, এর জনাব আতাউর রহমান খান কয়েকটি দফা পেশ করিয়াছেন। জামায়াতে ইসলামীর ৫টি দফায় পূর্ণ গণতন্ত্র ও ভােটাধিকার, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সাম্য বা জনসংখ্যার ভিত্তিতে বণ্টন, পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী গঠন ও অস্ত্র কারখানা স্থাপন প্রভৃতি বিষয় স্থান পাইয়াছে। জামাতে ইসলামী কার্যতঃ ৬-দফার বিরােধিতা করিলেও নিজ প্রস্তাবসমূহে ছয়দফার বিষয়বস্তু তথা স্বায়ত্তশাসনকে গ্রহণ করিয়াছে। জনাব আতাউর রহমান খানও তাঁহার সাতদফা প্রস্তাবেও কার্যতঃ ছয়দফাকেই সমর্থন করিয়াছেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের বিশিষ্ট নেতা জনাব মাহমুদুল হক ওসমানী পূর্ব পাকিস্তান সফরকালে স্বায়ত্তশাসনের (ভাষাভিত্তিক) কথা জোর দিয়া বলিয়া গিয়াছেন। কার্যতঃ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও তাহার নেতৃবৃন্দ সবাই ভাষাভিত্তিক আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবেই বলেন এবং ইহার উপর ভিত্তি করিয়াই কার্যতঃ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির জন্ম।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে পত্রপত্রিকাসমূহও আওয়ামী লীগের ‘৬-দফা সমর্থন না করিলেও বাস্তবে জনগণের প্রিয় স্বায়ত্তশাসন সমর্থন করেন।
ন্যাপ প্রধান মওলানা ভাসানী কয়েকদিন পূর্বে এক বিবৃতিতে স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে পুনরায় সমর্থন করিয়াছেন।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি দলগতভাবে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করিলেও ন্যাপ কর্মীদের সাথে আলাপে ইহা বুঝা যায় যে, তাহারা ছয় দফাকে প্রায় সম্পূর্ণই সমর্থন করেন। কিন্তু তাঁহাদের আরাে কিছু বক্তব্য আছে। তাহা হইতেছে ছয় দফা দাবীর সহিত আরাে কয়েকটি জরুরী দাবী সংযুক্তকরণ। প্রথমতঃ, সকল রাজবন্দীর মুক্তি ও গ্রেফতারী পরােয়ানা প্রত্যাহার। দ্বিতীয়তঃ, জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার ও পূর্ণ গণতন্ত্র তথা গণভােটের ব্যবস্থা। তৃতীয়তঃ, জমির খাজনা কমান, পাটের দাম ৪০ টাকা ধার্যকরণ, শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি ও নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের মূল্য হ্রাসকরণ এবং কৃষি ব্যবস্থার উন্নতিকরণ।
চতুর্থতঃ, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ ও সকল সামরিক জোট ত্যাগ। এই দাবীসমূহ নিঃসন্দেহে সকলের গ্রহণযােগ্য। শেষ দফাটি নিয়া হয়ত মতভেদ দেখা দিতে পারি কিন্তু বিগত পাক-ভারত যুদ্ধে ইহার স্বরূপ। যখন সম্পূর্ণভাবেই প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছে তাহার পরও কেহ যদি ইহার প্রতি মােহ দেখাইতে চেষ্টা করেন তাহা হইলে তাহার ‘দেশপ্রেম’ নিয়া ‘নিশ্চই’ সন্দেহ করা যায় এবং মার্কিনীদের এই জোটের প্রতি তাহাদের ভালবাসার কারণ নিয়া যুক্তিসঙ্গতভাবেই কোন মন্তব্য করা চলে।
পাকিস্তানের প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক (বিরােধী দলীয়) দলই যখন স্বায়ত্তশাসনকে সমর্থন করে এই অবস্থায় স্বায়ত্তশাসন তথা আরাে কয়েকটি জরুরী দাবী নিয়া নিঃসন্দেহে একটি সম্মিলিত ফ্রন্ট গঠন করিতে পারেন। কিন্তু মনে হইতেছে, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ইহাতে নারাজ। তাঁহারা মনে করেন তাঁহারা একাই দাবীটি আদায় করিতে সক্ষম হইবেন। ইতিমধ্যে ন্যাপ প্রধান মওলানা ভাসানীও ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আহ্বান জানাইয়াছেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মনােভাব হইল, ছয়দফা সমর্থন কর-আস, একসাথে কাজ করি। ইহা কখনই আপােষের কথা নয়। আপােষ করিতে হইলে নমনীয় মনােভাব নিয়া আগাইয়া আসিতে হইবে। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যদি সত্যই তাঁহাদের দাবী পূরণ করিতে ইচ্ছুক হন তবে তাহাদের উচিত অন্যান্য দলের সহিত মিলিয়া একটি সম্মিলিত দাবী লইয়া সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া। দলীয় স্বার্থে না হইলেও জনগণের স্বার্থে আশা করি তাহারা ইহা ভাবিয়া দেখিবেন।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, ছয়দফা দাবী পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণেরও দাবী। তাহা হইলে তাহাদের উচিত পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের ভাষাভিত্তিক আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে সমর্থন করা এবং এক ইউনিট বাতিলের আহ্বান জানানাে। বাঙ্গালী স্বায়ত্তশাসন পাইবে অথচ বেলুচ, পাঠান, সিন্ধী প্রভৃতি জাতি স্বায়ত্তশাসন পাইবে না ইহা সংকীর্ণ ও স্বার্থবাদী দৃষ্টি ব্যতীত কিছুই নহে।
গত ৮ই এপ্রিল পাবনার জনসভায় ছয়দফার প্রবক্তা শেখ মুজিব যাহা বলিয়াছেন, তাহা শ্রবণ করিয়া পূর্ব বাংলার মানুষ সত্যই দুঃখিত হইবে। কারণ তিনি বলিয়াছেন,“রাজধানী ঢাকায় হলে ৬ দফা উঠায়ে নেব।” পূর্ব বাংলার শতকরা ৮৫ ভাগ কৃষক ও অবশিষ্ট শ্রমিক-জনতার কোন সমস্যার সমাধান কি রাজধানী হইলেই হইবে? রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণীর কোন সমস্যার সমাধান হইয়াছে। কি ? উজির-নাজিরদের বড় বড় বাড়ী নির্মাণ হইলেই কি দেশের সমস্যার সমাধান হইয়া যাইবে? দেশের কৃষক-শ্রমিক-জনতার অবস্থার উন্নতি হইবে? রাজধানী পাইলে যদি কৃষক-শ্রমিক তথা দেশের শতকরা ৯০ জনের দাবীকেই আপনারা ত্যাগ করেন, ইহাই কি কৃষকদের প্রতি, আপনাদের ভালবাসা? শ্রমিক-ছাত্র-জনতার প্রতি ভালবাসা? দেশের জনগণকে ভালবাসার এই কি নমুনা ?
খােরশেদ উল ইসলাম
চট্টগ্রাম
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব