You dont have javascript enabled! Please enable it!

দৈনিক পূর্বদেশ
১৯শে ফেব্রুয়ারী ১৯৬৭

ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক সকল মহলে সাড়া জাগিয়েছে
(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)

রাজনৈতিক অধিকার হরণ, গণতন্ত্র সঙ্কোচন এবং সার্বজনীন ভােটাধিকার বিলােপের ফলে জাতীয় জীবনে যে স্থরিবতা সৃষ্টি হয়েছে তার অবসান করে দেশে সুষ্ঠু এবং সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য অবশেষে ন্যূনতম কর্মসূচী ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলাে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য তৎপর হয়েছেন। গত কিছুদিনের রাজনৈতিক তৎপরতা পর্যালােচনা করলে স্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে, সকল দল ও মতের সমবায়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে চলেছে এবং অচিরে ইহা স্পষ্ট রূপ পরিগ্রহ করবে। এই তৎপরতার ফলশ্রুতি হিসেবে আগামী মাসের শেষের দিকে ঢাকায় বিভিন্ন দল ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের একটি কনভেনশন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির কথা উল্লেখ করা যায়। এই কনভেনশনকে সর্বতােভাবে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য বর্তমানে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালানাে হচ্ছে।
এখানে উল্লেখযােগ্য যে, অনুরূপ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন পরিচালনার উপর ইতিপূর্বে এন-ডি-এফ নেতৃবৃন্দ গুরুত্ব আরােপ করেন। বস্তুতঃ জাতীয় জীবনের এই সন্ধিক্ষণে যাতে ঐক্য প্রচেষ্টায় কোন প্রকার শৈথিল্য দেখা না দেয় তজ্জন্য তাঁরা হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন।
বেআইনী আইন রুখতে হবে
আজ দেশে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা বিশদ বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। কল-কারখানার শ্রমিক থেকে শুরু করে অফিস-আদালতের কর্মচারী, চাষী, দিনমজুর থেকে আরম্ভ করে মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রতিটি লােকের মুখেই এক অসহায় উক্তি বাঁচবাে কি করে। এবার ছেলে-পুলে নিয়ে মারা যাবাে। মানুষের এই অসহায় অবস্থা এবং হতাশা ও ভীতির জন্য দায়ী গত কয় বছরের গণসমর্থন বজ্জিত এক ব্যক্তির শাসন। যে শাসনের বদৌলতে মাত্র গুটি কয়েক লােক সমগ্র দেশবাসীর সম্পদ নিজেদের পকেটে ঢুকিয়েছে। আর এই শাসন তাদের ভােগ-লালসা এবং শােষণকে নিরাপদ ও নিরঙ্কুশ করার জন্য তথাকথিত আইনের মারপ্যাচে চাষী-দিনমজুরদের আন্দোলনের অধিকার কেড়ে নিয়েছে, সাধারণ মানুষের ক্ষোভ প্রকাশের দাবী জানাবার রাস্তা বন্ধ করেছে। তাই আজ অনিবার্য বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে এবং মানুষের মনে আস্থার ভাব ফিরিয়ে আনতে হলে সর্বপ্রথমে তাদের আন্দোলনের, ধৰ্ম্মঘটের, সমাবেশের এবং ক্ষোভ প্রকাশের অধিকার কায়েম করতে হবে। তা শুধু সম্ভব ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। দেশবাসী আজ অতি বড় আশায় বুক বেঁধে চেয়ে আছে সেই মুহূর্তের পানে, যখন সমস্বরে সকলে একই আওয়াজ তুলে সম্মুখে এগিয়ে যেতে পারবে। দেশবাসীর এই আশা-আকাংখার প্রতিধ্বনি করেই নেতৃবৃন্দ সকল দল ও মতের সমন্বয় সাধন করে কর্মসূচী নিয়ে এগিয়ে আসছেন। তাদের এই প্রস্তুতি এবং দৃঢ় পদক্ষেপে কনভেনশন শিবিরে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। তারা গণআন্দোলনের প্রস্তুতিতে এমনি দিশেহারা ও বেসামাল হয়ে পড়েছে যে, এক্ষণে তাদের প্রচারপত্রগুলাে দেশবরেণ্য গণনেতাদের সম্পর্কে মিথ্যা ও আজগুবী কাহিনী প্রচারে লিপ্ত হয়েছে। এমনকি তথাকথিত অতি প্রগতিবাদী একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা পর্যন্ত এদের লেজুড় হিসেবে কর্তাদের মনােরঞ্জনের জন্য স্বকপােকল্পিত কাহিনী প্রচারে আত্মনিয়ােগ করেছে। এই বাহনটি যখন দেশে কোন আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে তখন দেশীয় আন্দোলনের চেয়ে বিদেশী সমস্যার প্রতি অধিক মাত্রায় আগ্রহ প্রদর্শন করতে শুরু করে। বস্তুতঃ প্রগতির নামে এরা গণবিরােধী চক্রের সঙ্গে আঁতাত করে মানুষের বাঁচার সংগ্রামকে নস্যাৎ করার ক্ষেত্রে পূর্বাপর যে ভূমিকা গ্রহণ করে আসছে তা কারও দৃষ্টি এড়াতে পারে না।
বিভিন্ন দলের মনােভাব
এখানে ঐক্যপ্রচেষ্টায় বিভিন্ন দলের মনােভাব ব্যাখ্যা করা দরকার। প্রথমতঃ এন, ডি, এফ সবসময়ই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পক্ষপাতি এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন পরিচালনা করা না যাওয়ায় যে ক্ষতি হয়েছে তা তারা বহুবার উল্লেখ করেছেন।
দ্বিতীয়তঃ কাউন্সিল মুসলিম লীগ কনভেনশন লীগের সঙ্গে এক হয়ে যাবে বলে ক্ষমতাসীন মহল থেকে বারেবারে উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা চালানাে হলেও কাউন্সিল লীগ যে, কনভেনশন লীগের সঙ্গে কোন আলাপ করতেও রাজী নয় তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে খান আব্দুল কাইউম খান এবং মিয়া মমতাজ দৌলতানার দ্ব্যর্থহীন ঘােষণায়। জামাতে ইসলামী এবং নেজামে ইসলাম কোন সময় কোন কারণেই বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আপােষ করতে রাজী নয় এবং একথা ক্ষমতাসীনরাও ভাল করে জানেন। বাকী থাকে দুটো দল-আওয়ামী লীগ এবং ন্যাপ। ন্যাপ সম্বন্ধে নানা মহল নানা কাহিনী প্রচার করেন। কারণ ন্যাপের দুটি অঙ্গ (মস্কো ও পিকিং পন্থী) দল বহুক্ষেত্রে একই দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিতে পারেন না। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে এর পিকিংপন্থী অঙ্গ বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে লড়তে নারাজ। কিন্তু তাদের আগে যে শক্তি ছিল এখন তা ভাটার দিকে এবং অপর অঙ্গটিই এখন দলে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। এই পক্ষ গণঐক্যে বিশ্বাসী এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন তাঁরা সমর্থন করেন। অবশ্য পিকিংপন্থী অঙ্গকেও এ ব্যাপারে পথে আনার জন্য একটি কমিটি নিয়ােগ করা হয়েছে এবং আশা করা যায়, শীঘ্রই ন্যাপ সামগ্রিকভাবে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শরীক হবেন।
আওয়ামী লীগের ভূমিকা
এক্ষণে আওয়ামী লীগের মনােভাব আলােচনা করা যাক। আওয়ামী লীগ একা ছয়দফা কর্মসূচী নিয়ে আন্দোলন পরিচালনা করেন। রাজনৈতিক মহলের বিশ্বাস এমনি একটি আন্দোলন কোন দলের পক্ষে একা চালান। সঙ্গত নয় কারণ কোন দল বিশেষের পক্ষে একক প্রচেষ্টায় তা বহুদূর ঠেলে নিয়ে যাওয়া যায় না। আওয়ামী লীগেরও অনেকে মনে করেন যে, ছয়দফা তাদের দলীয় কর্মসূচী হলেও তারা ন্যূনতম কর্মসূচী নিয়ে অপরাপর দলের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শরীক হতে পারেন। বস্তুতঃ এই উদ্দেশ্যেই পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লা খান সম্প্রতি ঢাকা এসে সকল মহলের সঙ্গে যােগাযােগ করে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য চেষ্টা চালান।
এ সম্পর্কে ঐক্য আন্দোলনের উদ্যোক্তাদের অভিমত এই যে, কোন দলকেই তার দলীয় কর্মসূচী বিসর্জন না দিয়ে সার্বজনীন ভােটাধিকার, পূর্ণ গণতন্ত্র এবং বাকস্বাধীনতা কর্মসূচীতে একমত হয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চালানাে সম্ভব।
তবে শেখ মুজিবকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জোর প্রচেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে। প্রকাশ, সম্প্রতি পিন্ডি থেকে কয়েকজন বিশেষ দূত এসে এ ব্যাপারে চেষ্টা তদ্বির চালান। তবে সেই তদ্বিরে বিশেষ কোন ফলােদয় হয়নি। কারণ আওয়ামী লীগ মহল থেকে দূতদের বলা হয়েছে যে, গণদাবী আদায়ের জন্য তারা যে কোন মহলের সঙ্গে সহযােগিতা করতে রাজী আছেন। অবশ্য দলীয় ভিত্তিতে তাদের ছয়দফার আন্দোলনও চলতে থাকবে বলে তারা জানান। সুতরাং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মনােভাব দৃষ্টে বলা যায় যে, দেশকে সঙ্কটমুক্ত করার জন্য ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন গড়ে তােলার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। আসন্ন কনভেনশনে এটা সুস্পষ্ট রূপ নেবে, একথা দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলা যায়।
এক প্ল্যাটফর্ম চাই
আরও একটি কারণ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়ােজনীয়তা তুলে ধরেছে। তা হলাে খাদ্য সঙ্কট এবং সকল প্রকার দ্রব্যসামগ্রীর অস্বাভাবিক হারে অনবরত মূল্য বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি। এককভাবে কোন দলের পক্ষে এই পরিস্থিতির সমাধানের পথ সুগম করা সম্ভব নয়। এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতি থেকে দেশবাসীকে মুক্তি দিতে হলে সকলের একই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানাে অপরিহার্য এবং তখনি গণবিরােধীদের সার্থকভাবে মােকাবিলা করা যাবে।
ঢাকায় সর্বদলীয় কনভেনশন অনুষ্ঠানের যে প্রস্তুতি চলেছে তা পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহলে অভিনন্দিত হয়েছে। খান আবদুল কাইউম খান, মিয়া দৌলতানা, খান লুখাের, সরদার শওকত হায়াত প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এই প্রচেষ্টাকে সঠিক পথে সঠিক পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেছেন।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!