You dont have javascript enabled! Please enable it!

দৈনিক ইত্তেফাক
১৯ শে মার্চ ১৯৬৬

রাজনৈতিক মঞ্চ
মােসাফির

প্রেস ট্রাষ্টের মনােনীত চেয়ারম্যান মিঃ সুমার হঠাৎ কেন হোঁচট খাইলেন, বুঝিতে পারিলাম না। তিনি যে শ্রেণীর লােকের মুখপাত্র তারা সাধারণতঃ পর্দার অন্তরাল হইতে কলকাঠি ঘুরান, নিজেরা ‘মঞ্চে’ অবতরণ করেন না।
তবে মিঃ সুমার রাজনীতিতে নূতন হইলেও তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য বটে ; এই কারণেই হয়ত তিনি মনে করিয়াছেন যে, রাজনীতিতে যখন অবতরণ করিয়াছে তখন একটু সাহস দেখানাে প্রয়ােজন। আর এই সাহস দেখাইতে যাইয়া তিনি প্রথম চোটেই হোঁচট খাইয়া পড়িয়াছেন। পররাষ্ট্র বিষয়ের বিতর্কের উপর মিঃ শাহ আজিজুর রহমান আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী করায় মিঃ সুমার বেসামাল হইয়া এমনি বাণনিক্ষেপ করিয়াছেন, যাতে এক চোটে দুই পাখী শিকার করা যায়। তিনি মন্তব্য প্রসঙ্গে বলিয়াছেন ও পাকিস্তানের আদর্শে বিশ্বাসী শাহ আজিজুর রহমানের নিকট হইতে স্বায়ত্তশাসনের দাবী উত্থাপিত হইতে পারে, তিনি তাহা কখনও আশা করেন নাই। ইহা শেখ মুজিবর রহমানের মত লােকদের মুখে শােভা পায়। বলাবাহুল্য, মিঃ সুমার তার এই মন্তব্য দ্বারা শেখ ও শাহ’র মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টির এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে পাকিস্তান-বিরােধী কার্যকলাপ বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চাহিয়াছেন; শাহ আজিজ পাকিস্তানের ‘আদর্শে বিশ্বাস করেন এবং শেখ মুজিব করেন না-এই দুষ্ট ইঙ্গিত করা হইয়াছে।
দেশে ‘নিরপেক্ষ এবং উচ্চাঙ্গের’ সাংবাদিকতা প্রবর্তনের ‘মহান উদ্দেশ্যে শিল্পপতিদের দ্বারা গঠিত প্রেস ট্রাষ্টের চেয়ারম্যানের আচরণ লক্ষ্য করিয়া বহুদিনের একটি কথা মনে পড়িল। ১৯৩৭ সাল , শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক বাংলার প্রধানমন্ত্রী। বাংলার ঘরে ঘরে বিশেষতঃ মধ্যবিত্ত এবং কৃষককুলের মধ্যে বিপুল আশার সঞ্চার হইয়াছে। হক সাহেব যখন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হইয়াছেন তখন ভাগ্যবিড়ম্বিত কৃষককুলের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য অনেক কিছু করা হইবে সর্বত্রই এই আশা। বাংলার কৃষককুল জমিদার-মহাজনদের শােষণে জর্জরিত, ঋণভারে কুঞ্জ মেরুদণ্ড। হক সাহেব বরিশাল সফরে আগমন করিয়াছেন। স্থানীয় ভক্তরা যারা নির্বাচনে তার কর্মী হিসাবে কাজ করিয়াছেন) তার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তাঁর মন্ত্রিসভার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা-বিশেষতঃ ঋণ সালিশী বাের্ড, মহাজনী আইন এবং প্রজাস্বত্ব আইনের বিষয়বস্তু নিয়া আলােচনা করিয়াছেন। হক সাহেব অনেক সময় অনেক কথার টোটকা জবাব দিতেন। তিনি বলিলেন, দেখ, আমি পটুয়াখালিতে খাজা নাজিমউদ্দিনকে তার জমিদারীতে পরাজিত করিবার পরে কলিকাতার উচ্চমহলে আমার আদর-কদর খুব বাড়িয়া যায়। এই মহল, ঐ মহল- সকল মহল হইতেই আমাকে খানাপিনার আমন্ত্রণ করা হয়। কোরমা, পােলাও, বিরানী আরও কত কি বড়লােকী খানা। সকলেই আমার ভক্ত ও অনুগামী, ইহা প্রমাণ করিবার জন্য উচ্চমহলে যেন প্রতিযােগিতা লাগিয়া গিয়াছে। খানা-পিনার সময় আমি যখন গ্রাম-বাংলার চাষী মজুরদের দুরবস্থার কথা তুলি, ওদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কি সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তা নিয়া আলােচনা শুরু করি, তখনই ওদের হাসি মুখ হঠাৎ কালাে হইয়া যায় ; ওরা ফোস করিয়া উঠে। এদের এ মনােভাব লক্ষ্য করিয়া আমি অবাক বনিয়া যাই। জিজ্ঞাসা করি, তােমরা এভাবে ফেস করিয়া উঠ কেন। নির্বাচনকালে সবাইত তােমরা গ্রাম-বাংলার মানুষের প্রতি কত দরদ দেখাইয়াছ, কৃষকদের দুঃখ-দারিদ্র্য মােচনের কত-না প্রতিশ্রুতি দিয়াছ; এক্ষণে তােমাদের মতিগতি এরূপ কেন! আমার এই প্রশ্নের জবাব তাঁরা দেন না। কিন্তু কিভাবে আমার হাত-পা বাঁধিয়া রাখিতে হইবে এই চেষ্টাতেই তাঁরা মগ্ন থাকেন। মিঃ সুমার শ্রেণীর লােকদের আচরণ লক্ষ্য করিয়া হক সাহেবের সেই বহুদিনের কথাগুলিই মনে পড়িল। কথাগুলি পুরানাে হইলেও আমাদের সমাজে তথা রাজনীতিতে এই মুনাফেকী আজ প্রকট হইয়া উঠিয়াছে। নির্বাচনকালে কিংবা বিবৃতি-বক্তৃতায় সুমার সাহেবদের মত লােকেরাও জনগণের স্বার্থ ও জনগণের কল্যাণ বিধানের প্রতিশ্রুতি দিয়াই ‘জনগণের প্রতিনিধি সাজেন। কিন্তু আসলে জনগণের স্বার্থের কথা তুলিলেই তারা ফোঁস করিয়া উঠেন। জনগণের দাবী-দাওয়া যখন প্রকট হইয়া উঠে তখন এঁরা বেসামাল হইয়া পড়েন। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী নূতন কিছু নয় কিংবা ইহা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা কিছুও নয়। লাহাের প্রস্তাবের মূল ভিত্তি পাকিস্তানের উভয়াঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনের উপর প্রতিষ্ঠিতঃ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনকালেও এই ইস্যু শুধু উত্থাপিতই হয় নাই, ইহার উপর জনমতও সংগৃহীত হইয়াছে। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে এই দাবীর পূর্ণ স্বীকৃতি না মিলিলেও বহুলাংশে স্বীকৃতি লাভ করিয়াছিল। তদুপরি ১৯৪৬ সালের যে বৃটিশ ক্যাবিনেট মিশন প্লান মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস কর্তৃক প্রথম দিকে মানিয়া নেওয়া হইয়াছিল, সেখানেও কেন্দ্রের নিকট তিনটি বিষয় রাখিয়া অন্যান্য বিষয়সমূহ তিনটি গ্রুপের ষ্টেটসমূহের হস্তে অর্পণের প্রস্তাব ছিল। অথচ কৌতুকের বিষয় যে, আজ সে পুরানাে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীর পুনরাবৃত্তি করা হইলেই সুমার সাহেবদের মত লােকেরা বিস্ময়ে ও আতঙ্কে যেন দিশেহারা হইয়া পড়েন। যে লাহাের প্রস্তাবের কথা শুনিলে তাঁহারা আতঙ্কগ্রস্ত হইয়া বিকট চীৎকার শুরু করেন ও সবকিছুতে পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেন সেই প্রস্তাব যে কায়েদে আজমের নেতৃত্বেই রচিত হইয়াছিল, অবলীলাক্রমে কায়েদে আজমের একচ্ছত্র ভক্ত-অনুরক্তরা তাহা বেমালুম ভুলিয়া যান। অবশ্য ভুলিবারই কথা। কেননা, সুমার শ্রেণীর লােকদের পাকিস্তান আন্দোলনকালে এমনকি তার পরবর্তীকালেও কোন রাজনৈতিক ভূমিকা ছিল বলিয়া অন্ততঃ এদেশের কোন লােকের জানা ছিল না।
এঁরা ষ্ট্রং কেন্দ্র চাহেনঃ আমরাও শক্তিশালী পাকিস্তান চাই। এঁদের ও আমাদের মধ্যে পার্থক্য, এরা শক্তিশালী কেন্দ্রের অর্থে সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও দেশের সম্পদ একস্থানে কেন্দ্রীভূত করিতে চান। এঁদের শক্তিশালী কেন্দ্রের নমুনা হইলঃ দেশরক্ষা খাতে পাকিস্তানের গােটা রাজত্বের গড়পড়তা শতকরা ষাট ভাগ ব্যয়িত হয় ও কেন্দ্রীয় শাসন-ব্যবস্থা এবং বৈদেশিক মিশন পরিচালনায় শতকরা পঁচিশ ভাগ রাজস্ব ব্যয়িত হয়। এই প্রধান দুইখাতে যে অর্থবরাদ্দ হয় তার শতকরা নব্বই ভাগ ব্যয় হয় এক অঞ্চলে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প ক্ষেত্রেও শতকরা নব্বই ভাগ কেন্দ্রীভূত রহিয়াছে একই অঞ্চলে। ব্যাঙ্ক, ইনস্যুরেন্স সব কিছুরও মালিক-মােক্তাররা একই অঞ্চলে অবস্থান করেন। পূর্ব পাকিস্তানে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্পে অংশগ্রহণ করেন তাদের অধিকাংশ মুনাফার অঙ্ক অপরাঞ্চলে পাচার করিবার দরুন এই অঞ্চলের পুঁজি গঠন সম্ভব হইতেছে না। যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য (সুদে কর্জ গ্রহণ করা হইয়াছে ও হইতেছে—বিশেষতঃ বৈদেশিক ফার্মের সহিত যৌথ উদ্যোগে যে সকল পরিকল্পনা গ্রহণ করা হইতেছে তাহাও ব্যাঙ্কইনস্যুরেন্স ব্যবসা, শিল্প-পুঁজি কন্ট্রোলকারী মুষ্টিমেয় পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রহিয়াছে। পক্ষান্তরে আমরা যে শক্তিশালী পাকিস্তান কামনা করি তাহা হইলঃ দেশরক্ষা ব্যবস্থায় ভৌগােলিক দিক দিয়া বিচ্ছিন্ন উভয় অঞ্চলকে যতদূর সম্ভব স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। অবশ্য দেশরক্ষার সার্বিক দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তে থাকিবে এবং এক অঞ্চলে এই বাবত অধিক অর্থ ব্যয়িত হইলে অন্য বাবতে অপরাঞ্চলে সেই ঘাটতি অর্থবরাদ্দ করিতে হইবে। অর্থনৈতিক দিক দিয়া উভয় অঞ্চল যাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় তজ্জন্য স্ব স্ব অঞ্চলের সম্পদ দ্বারা উভয় অঞ্চলকে যতদূর সম্ভব আত্মনির্ভরশীল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। পূর্ব পাকিস্তানে পুঁজি গঠন সম্ভব করিয়া তােলার জন্য এই অঞ্চল হইতে পুঁজি পাচার বন্ধ করা। তদুপরি পাকিস্তান যে বৈদেশিক সাহায্য লাভ করিবে তার যে পরিমাণ যে অঞ্চল পাইবে সে পরিমাণেই সে পরিশােধ করিবে। কৃষিপ্রধান ও ঘনবসতিপূর্ণ এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও ভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে। কৃষি উন্নয়ন, কুটিরশিল্প উন্নয়ন প্রভৃতিকে অগ্রাধিকার দিতে হইবে। মাথাভারি শিল্পনীতি এবং তথাকথিত অবাধ অর্থনীতির প্রচলন সাধ্যমত নিয়ন্ত্রিত করিতে হইবে।
আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ইহাই মর্মকথা। এই স্বায়ত্তশাসনের কথা শ্রবণ করিয়া যারা জনগণের স্বার্থে ও দেশের উন্নয়নে নিবেদিতপ্রাণ বলিয়া দাবী করেন, তাঁরা আঁতকাইয়া উঠেন কেন! সুমার সাহেবরা যদি দেশের কল্যাণেই সবকিছু করেন তাহা হইলে প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকার এবং তাঁদের সরাসরি ভােটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা দেশের শাসন-ব্যবস্থা পরিচালনার বিরােধিতা করেন কেন! এই জনাবদের আচরণের স্ববিরােধিতা এতই স্পষ্ট প্রকট যে, একদম অন্ধ ও বধির না হইলে তারা এই ধরনের স্ববিরােধী আচরণ করিতে পারিতেন না। সুমার সাহেবরা নূতন রাজনীতিতে অবতরণ করিয়াছেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে যে-কোন ভাষায় আক্রমণ করিয়া তাঁরা তৃপ্তিলাভ বা বাহবা কুড়াইতে পারেন। তাতে আমাদের আপত্তি নাই। কিন্তু দেশবাসী সম্পর্কে তাদের ভীতি কেন? আর যদি জনগণ সম্পর্কে ভীতি নাই বলিয়া তারা দাবী করেন তাহা হইলে জনগণের ভােটাধিকার ফেরাইয়া দিতে জনাবরা বিমুখ কেন? কেনই বা তারা জনগণের ভােটে সকল সমস্যার সমাধানে সম্মত হন না। আর সুমার সাহেবরা যদি এ অঞ্চলের জনগণের উপর আস্থা স্থাপন করিতে না পারেন তাহা হইলে জনগণ তাদেরকে জিজ্ঞাসা করিতে পারে ? আপনারা কারা! যাই হােক, হক সাহেবের আরেকটি অমর উক্তির উদ্ধৃতি দিয়া আজ সুমার প্রসঙ্গে সমাপ্তি ঘটাইতে চাইঃ O’ selfdeluded fools, how I pity you !

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!