You dont have javascript enabled! Please enable it! 1966.03.04 | বাস্তবতার আলােকে ৬-দফা কর্মসূচী | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক
৪ঠা মার্চ ১৯৬৬

বাস্তবতার আলােকে ৬-দফা কর্মসূচী
তফাজ্জল হােসেন (সম্পাদক, ইত্তেফাক)

শেখ মুজিবর রহমান প্রণীত ও পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি কর্তৃক অনুমােদিত ৬-দফা কর্মসূচী কোন কোন মহলে ত্বরিত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। আর-যে যাই বলুন, আমি কিন্তু এই ৬-দফা পরিকল্পনায় নূতন কিছুই দেখি না। পরিকল্পনাটির সঙ্গে কেউ একমত হতে পারেন, আবার কেউ হয়তাে ভিন্নমতেও পােষণ করতে পারেন; তাই বলে একথা কেউই বলতে পারেন না যে, এই কর্মসূচীতে যা বলা হয়েছে তিনি আগে কখনও তা শােনেননি। মুজিবর রহমানকে এইটুকু কৃতিত্ব দেওয়া চলে যে, সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার আলােকে জাতীয় সমস্যাবলী যখন নতুন করে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে ঠিক সেইসময় তিনি এই বিস্তারিত কর্মসূচীটি প্রণয়ন করে জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। ১৯৫০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এ্যাণ্ড ন্যাশনাল কনভেনশনে লিয়াকত আলীর মৌলিক আদর্শ কমিটির সুপারিশের যে বিকল্প রিপাের্টটি গ্রহণ করা হয়, তার কথা যাদের মনে আছে, তারা নিশ্চয়ই এ কথা স্বীকার করবেন যে, ঐ রিপাের্টেও এই একই ধরনের দাবী সন্নিবেশিত হয়েছিল। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা কর্মসূচীর ১৯নং দফাটিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশানের ব্যাপারটি সুস্পষ্টভাবে স্থান পেয়েছিল। কেন্দ্রে ও প্রদেশে সেদিন মুসলিম লীগই ক্ষমতায় আসীন ছিল এবং সে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল বয়স্ক-ভােটাধিকারের ভিত্তিতেই। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ দল সেদিন যুক্তফ্রন্টের ২১-দফার, বিশেষ করে তার রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী দু’টির বিরুদ্ধে মরণপণ করে রুখে দাঁড়িয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযােগ্য যে, নেজামে ইসলাম দলও সেদিন যুক্তফ্রন্টের অঙ্গদল ছিল। এইসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে তুমুল বিতর্কের ঝড় তুলতে গিয়ে ক্ষমতাসীন লীগ দল সেদিন সরকারী ক্ষমতা ও অর্থবল সব কিছুরই পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে সর্বশক্তিতে সংগ্রাম ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিল। যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা কর্মসূচীর প্রতি তারা সর্বতােরকমে ও সম্ভাব্য সব উপায়ে আক্রমণ চালিয়েছিল। এমনকি, জনসাধারণকে হুঁশিয়ারির পর হুঁশিয়ারি জানিয়ে এমন ঘােষণাও তারা করেছিলেন যে, যুক্তফ্রন্টের ২১-দফা কর্মসূচীর প্রতি জনসাধারণ যদি সমর্থন জানায় তাহলে ‘ইসলাম ও পাকিস্তান বিপন্ন হয়ে পড়বে। এত প্রচারণা, এত হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও জনগণের আদালতের বিচারে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ দল সেদিন সমূলে উৎখাত হয়ে যায়। পক্ষান্তরে যুক্তফ্রন্ট দল নির্বাচনে শতকরা ৯৭টি আসন দখল করে। বলাবাহুল্য, যুক্তফ্রন্টের সেদিনকার এই বিজয় সারা এশিয়ার বুকে এক নজিরহীন ঘটনা হিসেবে পরিগণিত হয়। কারণ, স্বাধীনতা অর্জনের পর সর্বপ্রথম নির্বাচনী সংগ্রামে বিরােধী দলের মােকাবিলা করতে গিয়ে ক্ষমতাসীন কোন দলের এমন করে সমূলে উৎখাত হওয়ার ঘটনা এশিয়ায় আর দ্বিতীয়টি ঘটেনি।
স্বভাবতঃই কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলাম দলকে আজ যখন শেখ মুজিবের ৬-দফা কর্মসূচীকে অভাবিতপূর্ব বা আকস্মিক একটা কিছু বলে গণ্য করে হৈ-চৈ করতে দেখি, তখন বিস্মিত হতে হয় বৈকি! ১৯৫৪ সালে প্রত্যক্ষ বয়স্ক ভােটাধিকারের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে আলােচ্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি সম্পর্কে জনগণ যে সুস্পষ্ট রায় দেয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে যে কেউ সহজেই একথা বলতে পারেন যে, আলােচ্য কর্মসূচীর জনগণ-স্বীকৃত ভিত্তি সম্পর্কে নূতন করে প্রশ্ন তুলবার ন্যায়সঙ্গত অধিকার আর কারও নেই (অবশ্য বিস্তারিত খুঁটিনাটি সম্পর্কে মতানৈক্য থাকা অস্বাভাবিক নয়)।
এতদসত্ত্বেও, একজন উদারমনা গণতন্ত্রী হিসেবে এবং জনগণের প্রতি অবিচল আস্থা আছে বলেই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটিতে নূতন করে আলােচনার সূত্রপাত হওয়ার ব্যাপারে আমার অমত নেই, অবশ্য যদি এ প্রশ্নে সরাসরি গণভােট অথবা প্রত্যক্ষ ও প্রাপ্তবয়স্ক ভােটাধিকারভিত্তিক সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনমত যাচাইর ব্যবস্থা করা হয়।
যা-ই হােক, কেবল যে পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তি লাহাের প্রস্তাবেই একথার উল্লেখ ছিল তাই নয়, পরবর্তীকালে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের মধ্যদিয়ে যে প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ তাদের সুস্পষ্ট রায় জানিয়ে দিয়েছে, নূতন করে সেই প্রশ্নটিকে কেউ আবার তুলে ধরতে চাইলে তাঁর এ উদ্যমের পিছনে দুরভিসন্ধি আবিষ্কার করতে গেলে সত্যের প্রতি চরম অবিচারই করা হবে। গণতন্ত্রে প্রত্যেকেরই নিজস্ব মতামত পােষণের অধিকার স্বীকৃত ; কিন্তু যে প্রশ্নে একবার জনমত যাচাই করা হয়েছে, সে প্রশ্নে সব বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে জনমতের সেই রায়কে বাস্তবায়িত করার জন্য প্রত্যেকের উচিত পরস্পর সহযােগিতা করা। রাষ্ট্রভাষা ও যুক্ত নির্বাচনের প্রশ্নে এই ধরনের গণতান্ত্রিক মনােভাবই আমরা লক্ষ্য করছি।
স্বভাবতঃই প্রশ্ন করা যেতে পারে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে সেই একই মনােভাবের পরিচয় দেওয়া হয়নি বা হচ্ছে না কেন?
আগে বহুবারই আমি সুস্পষ্টভাবে বলেছি যে, পূর্ব পাকিস্তানে কেউই বিচ্ছিন্নতার মনােভাব পােষণ করেন না।
এতদসত্ত্বেও, বিচ্ছিন্নবাদিতার যে অভিযােগ আনয়ন করা হয়, তার লক্ষ্য কেবল পূর্ব পাকিস্তানকে তার ন্যায়সংগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাখা। কে না জানে বা কে না বুঝে যে, পারস্পরিক স্বার্থে ও পারস্পরিক অস্তিত্বের খাতিরেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে এক হয়েই বসবাস করতে হবে। দেশের উভয় অংশকেই সমানভাবে এই সত্যটি উপলব্ধি করতে হবে। একতরফা উপলব্ধির কোন অবকাশ সেখানে নেই। ভৌগােলিক কারণেই পাকিস্তানের জীবনে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের অপরিহার্য প্রয়ােজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এ দাবীর মােদ্দা অর্থ, দেশের উভয় অংশকে সমান স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতার অধিকারী করা-খাস করে পূর্ব পাকিস্তানকে কোন বিশেষ বা অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের যে, যখনই কোন ন্যায়সংগত দাবী-দাওয়া এমনকি উর্দুর পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের ৫কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার মত নির্দোষ দাবী নিয়েও যখন এই প্রদেশবাসী উত্থাপন করেছে, তখনই দেখা গিয়েছে,পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু লােক সে প্রশ্নে হৈ-চৈ শুরু করে শেষ পর্যন্ত আমাদের দেশপ্রেম সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলেছেন এমনটি যারা সে দাবী নিয়ে এগিয়ে এসেছে তাদেরকে ‘শত্রুর চর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন ; আর সেই সঙ্গে অত্যাচার আর নির্যাতনের বন্যা বইয়ে দেয়া হয়েছে। শত শত দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও ছাত্রকে কারান্তরালে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তারই পাশাপাশি পুলিসের গুলীবর্ষণের ফলে তিন-তিনটি ছাত্রকে অকালে প্রাণও দিতে হয়েছে। আবার যখন যুক্ত নির্বাচনের প্রশ্ন উঠে, তখনও ঠিক এই একই অবস্থা দাঁড়ায়। দেশবরেণ্য নেতা ও জনগণকে লক্ষ্য করে তখন কেবল গালিগালাজই করা হয় না, জনাব সােহরাওয়ার্দীর জীবনের উপরও নৃশংস হামলা চালানাের চেষ্টা চলে। বলাবাহুল্য, পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ থেকে যা কিছুই বলা বা করা হােক না কেন, সে সম্পর্কে পূর্বপরিকল্পিত একটা বিশেষ মানসিকতা নিয়ে এমনতরই ধুয়া তােলা হয়, এমনতরই অত্যাচার আর নির্যাতনের বন্যা বইয়ে দেয়া হয়। অথচ, পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু কিছু লােকের এই মনােভাব কোন কালেই জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় সংহতির অনুকূল হতে পারে না। আমার অনুরােধ হলাে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীসম্বলিত যে ৬-দফা কর্মসূচী সম্প্রতি দেশবাসীর সামনে পেশ করা হয়েছে, সে সম্পর্কে সেই একই নিয়মে আবার যেন সেই ভ্রান্ত মনােভাবই প্রয়ােগ না করা হয়। একথা বিস্মৃত হওয়া উচিত নয় যে, রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা ও যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি দেশের আইন বইতে আজ স্থান পেলেও শুরুতে এইসব দাবী-দাওয়া দাবিয়ে দেয়ার জন্য এদেশের শত শত এমনকি কখনাে কখনাে হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও ছাত্রকে কারাগারে নিক্ষেপের মত অত্যাচার ও নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে একদিন যে তিক্ততার সৃষ্টি করা হয়েছে, আজও তার জের চলেছে। বিনা কারণে মানুষকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হলে বা আদালতে বিচারের ব্যবস্থা না করে তার নাগরিক স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করা হলে মানুষের শরীর ও মনের ওপর চরম নির্যাতনই করা হয়। বলাবাহুল্য, এই ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক আদর্শ ও মূল্যমানের গােড়ায়ই কুঠারাঘাত করে। তবু, সত্যের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে এ ধরনের অত্যাচার-নির্যাতন হাসিমুখে বরণ করবার মত লােকের আজও অভাব নেই। অত্যাচার-নির্যাতন যতই কঠোর হােক, সংগ্রামী মানুষকে তা হতােদ্যম করতে পারে না, বরং অত্যাচার-নির্যাতনের কঠোরতা যতই বৃদ্ধি পায়, সংগ্রামী মানুষের মনােবল ও আত্মবিশ্বাস ততই আরও জোরদার হয়। পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসই একথার সত্যতার সাক্ষী। অতএব দেখা যাচ্ছে, যে সমস্যার আজ আমরা সম্মুখীন হয়েছি, অত্যাচার-নির্যাতন বা দমনমূলক ব্যবস্থার মধ্যে যে সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে না বা সে ব্যবস্থাতে ৬-দফা কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা চলছে তারও কোন সুরাহা হবে না। একই দেশের নাগরিক হয়ে একে অপরের আন্তরিকতার বা দেশপ্রেমের প্রশ্ন তােলা ঠিক নয়। অতীতে একশ্রেণীর মানুষে এই ধরনের মানসিকতার পরিচয় দিয়ে এদেশের মানুষেমানুষে এবং বিশেষ করে দেশের দুরাস্তৃত দুই অংশের জনসাধারণের ভ্রাতৃত্ববােধ ও পারস্পরিক সম্পর্ক বিষিয়ে তুলেছিল। যারা একদিন শেরে বাংলা ফজলুল হককে “বিশ্বাসঘাতক” বলে অভিহিত করেছিল, তাদেরকেই কিছুদিন যেতে না যেতে তাঁকেই আবার “দেশপ্রেমের মানসপুত্র” বলে অভিনন্দিত করতে হয়েছে। আর যারা মরহুম শহীদ সােহরাওয়ার্দীর দেশপ্রেমে সন্দেহ করেছেন, তাঁরা দেশের তাে নয়ই, নিজেদেরও কোন মঙ্গল করেন নি। সংশ্লিষ্ট মহলকে তাই আমরা অনুধাবন করতে বলি যে, যখন আমরা দেখি পূর্ব পাকিস্তানে এমন কোন সত্য নেই-যাকে কোন না কোন সময় ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ বা ‘শত্রুর চর’ বলে আখ্যায়িত করা হয়নি, তখন আমাদের মনােভাব কি দাঁড়ায় ? জিজ্ঞাসা করি শহীদ সােহরাওয়ার্দী ধনদওলত বা বিষয়-সম্পত্তি বলতে কি রেখে গিয়েছেন?
পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দকে হেয়প্রতিপন্ন ও খাটো করার জন্য মহল বিশেষে আমরা একটি বিরামহীন প্রবণতা লক্ষ্য করে আসছি। অথচ, বাস্তব অবস্থা এই যে, মুসলিম বাংলার নেতৃত্ব ও এই প্রদেশের রাজনীতি-সচেতন মানুষ না হলে আদপে পাকিস্তানই অর্জিত হতাে না। পাকিস্তান কারও দান নয়, কিংবা যুদ্ধের দ্বারা অর্জিত রাষ্ট্রও নয় ; কেবলমাত্র জনগণের দৃঢ়সংকল্প ও অদম্য ইচ্ছার বলেই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল।
সংগ্রামের সূত্রে আমরা এমন অনেককে চিনেছি-যারা পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের নিন্দা করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে তাচ্ছিল্য করতে চান। এঁরা সেই শ্রেণীরই লােক, যারা কোন ন্যায্য দাবী উঠলেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠেন। সাধারণভাবে রাজনীতিকদের উদারতার সুযােগে পাকিস্তানে ‘কায়েমী স্বার্থের একটি চক্র গড়ে উঠবার অবকাশ পেয়েছে। এবং দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, সেই ‘কায়েমী স্বার্থবাদী’ মহলটিই এখন সেই রাজনীতিকদেরই বিরুদ্ধাচরণ করে জনগণের ন্যায্য গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে চলেছেন। বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য তারা আত্মােৎসর্গ করতেও পিছ-পা নন বলে তারা প্রচার করেন ; অথচ নিজ দেশের জনগণের অধিকার প্রদানের প্রশ্নে তারাই আবার মারমুখী। স্বার্থবাদী এই চক্রটির পাঠস্থান হলাে পশ্চিম পাকিস্তান। অবশ্য এ পাদপীঠ পূর্ব পাকিস্তানে হলেও তাদের কার্যকলাপের কোন তারতম্য হতাে না; কারণ স্বার্থবাদী চক্রের দৃষ্টিভঙ্গি সবখানেই এক।
এখন প্রশ্ন হলাে, কায়েমী স্বার্থের ইঙ্গিতেই আমরা পরিচালিত হব না, সুস্থ মানসিকতা যুক্তিধর্মিতা এবং জনগণের ইচ্ছা-অভিলাষকেই আমরা রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবনে প্রতিফলিত হতে দেব?
কায়েমী স্বার্থী মহল হয়তাে মনে করতে পারেন যে, দেশের আপামর জনসাধারণ ও তাদের প্রতিনিধিদের ভূমিকাকে কেবল পিছনে ফেলে দিতে পারলেই নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখে তারা ফুলে-ফেঁপে উঠতে পারবেন। এই যখন অবস্থা, তখন কায়েমী স্বার্থীদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও জনগণের ইচ্ছাঅনিচ্ছা-এই দুইটির মধ্যে আজ একটিকেই আমাদের বেছে নিতে হবে। আমার স্থির বিশ্বাস, জনগণের ইচ্ছাকে যদি প্রতিফলিত হতে দেয়া হয়, তবে ৬-দফা কর্মসূচী বা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন কোনটি সম্পর্কেই কোন ভুল বুঝাবুঝির অবকাশ আর থাকবে না। কেননা, এই কর্মসূচী বাস্তবায়িত হলে দেশের উভয় অঞ্চলের জন্যই সমান অধিকার ও সমান ক্ষমতার বিধান হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের এতে আপত্তি থাকতে পারে কি?
জবাবে বলব, না। পাকিস্তানের এমন কে আছেন যিনি চান না যে, দেশের উভয় অংশই সমানভাবে উন্নত হােক, এবং উভয় অংশই সমান রাজনৈতিক ক্ষমতা ও মর্যাদা ভােগ করুক? ৬-দফা পরিকল্পনার কোথাও যদি কোন আপত্তিকর কিছু থাকে, পাকিস্তানের সংহতি বিপর্যস্ত হতে পারে। এমন কিছুও যদি তাতে থাকে, তা হলে দেশের দুই অংশের প্রতিনিধিরা একত্রে বসে সহজেই সে প্রশ্নের ফয়সালা করতে পারেন। আমার বিবেচনায় ভুল বুঝাবুঝি নিরসনের এই-ই সর্বোত্তম পথ। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি দোষারােপ করার আগে স্মরণ রাখা উচিত যে, জনসংখ্যার দিক দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও পূর্ব পাকিস্তান। সংখ্যাসাম্য মেনে নিয়েছে। এই একটিমাত্র ঘটনা থেকেই দেশের অখণ্ডতা এবং উভয় অংশের জনগণের সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর আন্তরিকতার প্রমাণ মিলবে। দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য আজ কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, তা আজ আর কারও অজানা নয়। কেবল আশ্বাসবাণী দিয়ে বা পৃষ্ঠপােষকতার মনােভাব নিয়ে এই পাহাড়-প্রমাণ বৈষম্য দূর করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে উভয় অঞ্চলের অবস্থা যাতে সমানুপাতে আনয়ন করা যায়, তার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট, আত্ম-পরিচালিত কর্মসূচী গ্রহণ করা প্রয়ােজন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমি ৬-দফা কর্মসূচীটি বিবেচনা করে দেখার জন্য আহ্বান জানাই। আসুন, কে এই ৬-দফার প্রণেতা, আপাততঃ তা ভুলে গিয়ে আমরা পাকিস্তানের ভৌগােলিক ও অর্থনৈতিক প্রয়ােজনীয়তার আলােকেই ৬-দফা কর্মসূচীর গুণাগুণ বিচার করে দেখি। স্বায়ত্তশাসনের দাবী বা ৬-দফা কর্মসূচীর প্রতি এখানকার জনগণের কোন সমর্থন নেই এবং এ কর্মসূচী কোন আত্মকেন্দ্রিক রাজনীতিক মহলের দুরভিসন্ধিপ্রসূত, এরূপ ধারণা পােষণ করে আত্ম-প্রবঞ্চনার কোন অর্থ নেই। বাস্তব অবস্থা স্বীকার করিয়া লওয়া হউক। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী একটি অত্যন্ত জীবন্ত দাবী। এখানকার মানুষ এ দাবীকে তাদের জীবন-মরণের প্রশ্ন বলেই গণ্য করে। এ প্রশ্নে যাদের সন্দেহ আছে যারা এখনও অজ্ঞতায় ভুগছেন, তাঁরা জনগণের দরজায় গিয়ে তাঁদের মতামত যাচাই করুন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ও দেশরক্ষার ব্যাপারে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় এবং উভয় অঞ্চলই যদি সমান রাজনৈতিক অধিকার পায়, তবে আকাশ ভেঙ্গে মাথায় পড়বে না, বরং পাকিস্তান তাতে আরও শক্তিশালীই হবে।
সম্প্রতি পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানী জওয়ানরা তাদের শৌর্য ও বীর্যবত্তার প্রমাণ দিয়েছে এবং বাঙ্গালীরা সাহসী ও যােদ্ধার জাত নয় বলে এতদিন যে বানােয়াট অপবাদ রটনা করা হয়েছে তারও অবসান ঘটিয়েছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে ৬-দফা কর্মসূচী দেখে আঁৎকে উঠার বা ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার কোন কারণ নেই। আসুন আমরা ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মন নিয়ে প্রকৃত অবস্থা বিচার করি। সংশ্লিষ্ট সকলে পরস্পর পরস্পরের বক্তব্য বা মতামত বুঝবার ও সম্যক উপলব্ধি করবার চেষ্টা করুন। প্রত্যেক ব্যাপারে যারা আমাদের সন্দেহ করেন, তাঁদের কাছে আমি একটি পাল্টা প্রশ্ন করতে চাই ও পূর্ব পাকিস্তানের বদলে পশ্চিম পাকিস্তান যদি আজকের এই পর্বতপ্রমাণ বৈষম্যের শিকার হত, তাহলে তাদের প্রতিক্রিয়া কি হত ?
তাই তাদেরকে বলব, ধৈর্যশীল হউন, যুক্তিবাদী মন নিয়ে সবকিছু বিচার করুন। আমি তাঁদের আহ্বান জানাই “নিজে বাঁচুন অপরকেও বাঁচতে দিন”-এই নীতি বাক্য কেবল কথায় নয়, কাজেও বিশ্বাস স্থাপন করুন। তাহলেই কেবল পারস্পরিক ভুল বুঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারেই পূর্ণ সহযােগিতা ও মতৈক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সন্দেহ ও দমননীতির দ্বারা কিছু হাসিল করা যাবে না তাতে বিরােধের মাত্রাই কেবল বাড়বে।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব