You dont have javascript enabled! Please enable it!

দৈনিক ইত্তেফাক
২৮শে মার্চ ১৯৬৬

প্রাচ্যের শস্যভাণ্ডার আজ শূন্য কেন?
– এম রহমত আলী

বসন্তের আগমনে শুষ্কবৃক্ষে দেখা দিয়েছে কচি-কিশালয়, ধূলি-ধূসরিত হয়ে উঠেছে পথ-প্রান্তর। বৃষ্টির কামনা আজ সবার মাঝে। এই বৃষ্টিই আবার কিছুকাল পর মানুষকে করে তুলবে বিব্রত। তবু বৃষ্টি চাই ফসলের জন্য, পােকামাকড় আর দুরারােগ্য সংক্রামক ব্যাধি নিরােধের জন্য। পত্র-পল্লবে, দেওয়ালে-কার্নিশে, দেহের অনাবৃত স্থানে, এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে হৃদয়ে যে ধূলির আস্তরণ পড়েছে তা ধুয়ে-মুছে নির্মল করার জন্য চাই বৃষ্টি। বৃষ্টিই ফলে-পুষ্পে সুশােভিত করে তুলতে পারে-গ্রাম-বাংলার দিগন্তবিস্তীর্ণ মাঠ, ছায়া সুশীতল পল্লী। বৃষ্টির কামনার মত গ্রাম-বাংলার মানুষের মনে গণতন্ত্র আর স্বাধীনতার কামনাও শাশ্বত, নিরবধিকালের। অশুভ শক্তি বহু শতবার বিষাক্ত ফণা বিস্তার করে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে গ্রাম-বাংলার মানুষের চিরন্তন অভিলাষ; কিন্তু পারেনি কোনকালে, পারবেও না। এবারের বসন্তকালীন অধিবেশনেও পূর্ব বাংলার সত্যিকার গণ-প্রতিনিধিদের কণ্ঠে ঝংকৃত হয়েছে সে কামনারই মৃদু অনুরণন। বৃষ্টির মত গণতন্ত্রও প্রয়ােজন। বৃষ্টি চাই মাঠজোড়া ফসল আর বাগিচার জন্য; ‘গণতন্ত্র চাই-হৃদয় বাগিচার ফুল ফুটবার নিমিত্ত। সত্যি বলতে প্রতিভার বিকাশ একমাত্র গণতন্ত্রেই সম্ভব। এই গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থায় অনুপস্থিতিই পূর্ব বাংলা তথা পাকিস্তান তথা সারাবিশ্বের প্রতিভার আকাশকে মেঘাচ্ছন্ন করে রেখেছে। গণতন্ত্র ক্ষুধার্ত মানুষের খাদ্যের দাবীর মতই স্বতঃস্ফুর্ত ও স্বাভাবিক। অন্যায়কে ন্যায়, অসত্যকে সত্য এবং অবিচারকে সুবিচার বলে যারা মনে করেন, কেবল তারাই তা অস্বীকার করতে পারেন। তাদের সমুদয় ভাবনা-চিন্তা আত্মকেন্দ্রিক। বাসনার খিড়কি-দরজা উন্মুক্ত রাখার জন্য তাদের পক্ষে সবই সম্ভব। সবকিছু জেনে-বুঝেও যাঁরা জানতে বা বুঝতে চান না, তাঁদের সত্যিকার চেহারাই গণ-প্রতিনিধিরা উন্মােচন করেছেন। অপরদিকে শেখ মুজিবের ৬-দফার মধ্যে প্রতিবিম্বিত হয়েছে গ্রাম-বাংলার মানুষের ভবিষ্যৎ। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ৬-দফার দর্পণে যেন তাদের সত্যিকার চেহারা দেখতে পেয়েছে এবার। যে গুটিকয়েক পুঁজিপতি ব্যাঙ্ক, ইনস্যুরেন্স, কলকারখানা প্রভৃতি গড়ে তুলে দেশের উন্নতির অগ্রগতির নামে সাধারণ মানুষ বিশেষতঃ পূর্ব পাকিস্তানীদের নির্মমভাবে শােষণ করছে, তাদের সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে আজ আর সংশয়-সন্দেহ নেই। এরই জন্য হয়তাে পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি জনাব আফাজ উদ্দিনকে দুঃখভারাক্রান্ত কণ্ঠে সরকার পক্ষের কাছে জানতে চাইতে হয়েছেঃ ঐক্য কিসের? শত দুর্যোগ-দুর্বিপাক, শােষণ-নির্যাতন, অত্যাচার-অবিচার সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানীরা যে সহনশীলতা, বাস্তবধর্মিতা ও শান্তির প্রতি উদগ্র বাসনা দেখিয়েছে তা শুধু দেশে নয়, বহির্বিশ্বেও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের উদ্রেক করেছে। দেশবিদেশের মানুষ আজ জানেঃ পূর্ব পাকিস্তানীরা শান্তির পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে। এবারের জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে নগণ্য সংখ্যক পূর্ব পাকিস্তানী প্রতিনিধির কণ্ঠে যে সুর ঝংকৃত হয়েছে, ভাবাবেগের মধ্যদিয়ে তার পরিসমাপ্তি না ঘটলে জাতির পক্ষে তা কল্যাণকর হবে।
সত্যি বলতে, পূর্ব বাংলার মানুষ দীর্ঘকাল বিদেশী শাসনের অধীনে সীমাহীন দুর্ভোগ ভুগেছে কোন এক মনীষীর কণ্ঠেও তাই ধ্বনিত হয়েছে ‘বাংলার দৃষ্টিতে সম্পদ দিয়েই ইংলন্ড শিল্পায়িত হয়েছে। শুধু স্বদেশ শিল্পায়নের গুরুভাব বাংলার স্কন্ধে চাপিয়ে ইংরেজ সরকার ক্ষান্ত হয়নি, তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের ব্যয়ভারও বাংলার মানুষকে বইতে বাধ্য করা হয়েছে। হাল আমলেও একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহলের অবিমৃষ্যকারিতার দরুন দেশের এক অঞ্চলের সম্পদে অন্য অঞ্চল শিল্পায়িত ও ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। প্রশ্ন হলঃ এই অবস্থা কি সামনে চলতে থাকবে? যারা স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তানের কথা বলছেন তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী, আর যারা স্বীয় ধনভাণ্ডার স্ফীত করার মানসে পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণ করছেন তারা ‘দেশপ্রেমিক’, ‘জনদরদী’! পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এর চেয়ে নির্মম পরিহাস আর কী হতে পারে!
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি যারা নির্ধারিত করে আসছেন তারা পূর্ব বাংলাকে নয়, পশ্চিম পাকিস্তানকে সামনে রেখেই সে নীতি নির্ধারিত করেছেন। তাই পশ্চিম পাকিস্তান আজ যখন R.C.D -র কল্যাণে ইরানতুরস্ক পর্যন্ত সহযােগিতার হাত সম্প্রসারিত করতে পারে। তখন পূর্ব বাংলার মানুষের হস্ত সংকুচিত হতে হতে পেটের অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এই অপরিণামদর্শী নীতির ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সাক্ষাৎ প্রতিবেশীও আজ বৈরী। হাতের কাছে শুধু বন্ধু বলতেই বা তার আজ কে আছে? দেশের ১০ কোটি মানুষের মঙ্গলের জন্য নয়, কেবল কায়েমী স্বার্থের ইমারতকে চিরস্থায়ী করবার জন্য পূর্ব বাংলার মানুষের মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গার কাজ তবে কি এই একই নিয়মে সমানে চলতেই থাকবে? চলতে থাকলে শেষ পর্যন্ত সে মাথার কি আর কিছু অবশেষ থাকবে? সেই প্রাক-আর্য যুগ হতেই এ অঞ্চলের একটা নিজস্ব সত্তা ও সংস্কৃতি রয়েছে। পূর্ব বাংলার বস্ত্রশিল্প, আরাে হাজারাে রকমের হস্তশিল্পই তার পরিচয়। এছাড়াও তার পরিচয় ছড়িয়ে রয়েছে জারী, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া গানের, বৈঞ্চব ও শ্যামা সঙ্গীতের মধ্যে; মন মাতানাে অসংখ্য ছােটগল্প ও গাঁথা সাহিত্যে-যার আবেদন সার্বজনীন ও শাশ্বত। নৌকাবিহার, রেল, মােটর ও বিমান ভ্রমণের সময়ও পূর্ব বাংলার এই বিশেষত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অসংখ্য খাল, বিল, নদী-নালার ও প্রচুর বৃষ্টিপাতের আশীর্বাদ, অজস্র বনানী ও ফলফসলের ও ফুলের প্রবাহ আমাদের ক্ষেতখামার ও উদ্যান-উঠান ধন্য করেছে। আমরা সত্যি ভাগ্যবান যে, আমরা এমন মাটির বুকে জন্ম নিতে পেরেছি। পূর্ব বাংলা এশিয়া তথা পৃথিবীর উদ্যান। একদা পূর্ব বাংলার চাল ও দ্রব্য সস্তায় মধ্যপ্রাচ্য এবং গ্রীস, রােমে রফতানী হত আর আজ? প্রাচ্যের সে শস্যভাণ্ডার আজ শূন্য। বিদেশের করুণাকে আশ্রয় করেই আজ তার গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা। কিন্তু কেন? আজ হতে আড়াই হাজার বছর আগে গ্রীক ঐতিহাসিক হিরােডােটাস যা বলেছিলেন তাঁর নিজ মাতৃভূমি এবং আবাসভূমি সম্পর্কে, তা হয়ত আমাদের দেশমাতৃকার পক্ষেও সত্য হবে?
হিরােডােটাস বলেছিলেনঃ “এথেন্সবাসীরা যখন স্বৈরাচারী শাসনের নিগড়ে আবদ্ধ ছিল, তখন শক্তির দিক দিয়ে প্রতিবেশী কোন রাষ্ট্রের চাইতে কোন রকমেই তারা উৎকৃষ্ট ছিল না। কিন্তু, স্বৈরাচারের নিগড় থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বলবীর্য শক্তি-সাহসে তারা প্রতিবেশীদের বহু গুণে ছাড়িয়ে গেল। এ দ্বারা এই-ই প্রমাণিত হয় যে, যখন তারা স্বেচ্ছাচারের নিগড়ে আবদ্ধ ছিল, তখন নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তি ও কর্মশক্তির সদ্ব্যবহারে তারা প্রেরণা অনুভব করেনি। বরং সেদিন তারা ছিল প্রভুর ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাস মাত্র। কিন্তু সত্যিকার মুক্তির আস্বাদ প্রাপ্তির পরক্ষণ থেকেই এথেন্সের প্রতিটি নাগরিক দেশ গঠন ও দেশকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে পূর্ণ আন্তরিকতা নিয়ে নিজ নিজ সামর্থ্যের সদ্ব্যবহারে যত্নবান হয়।”
পাকিস্তানের দুর্বার সামরিক শক্তি অর্জনের আপাততঃ কোন প্রয়ােজন নেই। কেননা প্রকৃত প্রস্তাবে অস্ত্রশস্ত্র আর সামরিক বাহিনী হল একটি দেশের তৃতীয় রক্ষাব্যবস্থা। আসল জিনিস হল আত্তিক বল, তারপরই জাতীয় অর্থনীতি। বুদ্ধ বলেছেন, যে নিজেকে জয় করেছে তাকে কেউ পরাভূত করতে পারে না; কিন্তু নিজেকে জয় করা যায় তখনই, যখন নিজেকে পুরােপুরি বােঝা যায়, জানা যায়।
আমরা যদি সঠিকভাবে নিজেদের সমস্যার বিভিন্ন দিক ও সম্ভাবনার দিকগুলাে ভাল করে বুঝে উঠতে পারি, তাহলেই কেবল আমরা পারব পূর্ব পাকিস্তান তথা পাকিস্তানের দশ কোটি মানুষের সত্যিকার ভাগ্য গড়বার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করতে, স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করতে।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!