দৈনিক পয়গাম
৩১শে মার্চ ১৯৬৬
ছয় দফার নামে
কথায় বলে ও হাতীর দুই পাটি দাঁত আছে। হাতী এক পাটি দাত খাওয়ার জন্য ও আর এক পাটি দাতা দেখাইবার জন্য ব্যবহার করে। এ কথাটি পূর্ব পাকিস্তানের বিরােধী দল ও তাদের নেতাদের স্বরূপ ব্যাখ্যা করার ব্যাপারে বেশ সাহায্য করে। পূর্ব পাকিস্তানের বিরােধী দলগুলির সময় বর্তমানে খুবই খারাপ যাইতেছে। তারা মােটেই হালে পানি পাইতেছেন না।
কি করিয়া তাদের রাজনৈতিক পুনর্বাসন সম্ভব হইতে পারে তার চিন্তায় তারা আজ অস্থির। চিন্তায় কোন কূল-কিনারা না পাইয়া আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান তার ছয় দফা দাবী লইয়া রাজনীতির মাঠময়দান চষিয়া ফিরিতেছেন। কিন্তু ছয় দফা বলুন, সাত দফা বলুন আর একুশ দফাই বলুন, মূলতঃ সব দফার মতলব সেই এক। দফার এইসব পতাকা উড়াইয়া জনসাধারণকে ভুলাইতে হইবে, তাদের মন গলাইতে হইবে। এবং একটা ভাবাবেগের ঝড় সৃষ্টি করিয়া পুনরায় ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করিয়াও গদি দখলের সৌভাগ্যকে জয় করিয়া লইতে হইবে; ইহাই আসলে তারা চান।
পাঠকদের হয়তঃ মনে পড়ে, ১৯৫৪ সনের নির্বাচনের আওয়ামী লীগের ২১ দফার ঘােষণার কথা। কিন্তু আওয়ামী লীগের কর্তাব্যক্তিরা যখন গদি দখল করিলেন এবং ক্ষমতার স্বাদ পাইলেন; তখন কি করিয়াছিলেন? এই প্রশ্ন উত্থাপন করিয়াই পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর জনাব আবদুল মােনায়েম খান যশােরের এক জনসভায় বলেন, ২১ দফা কর্মসূচীতে তথাকথিত রাজনীতিকেরা নিরাপত্তা আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন। কিন্তু ১৯৫৬ সনের গণপরিষদে জনাব আতাউর রহমান ও শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ নেতা নিরাপত্তা আইন বহাল রাখার পক্ষে ভােট দিয়াছিলেন। আওয়ামী নেতাদের আগে পরের এই স্ব-বিরােধিতায় বিস্মিত হওয়ার কিছুই নাই। তাঁরা গদির জন্য যা খুশী তাই করিতে পারেন এবং গদিনশীন হওয়া মাত্রই আবার তারা অন্যরূপ ধারণ করিতে পারেন। ব্যাঙের দুঃখে সাপের চোখের সাঁতার পানির মত আজকাল আওয়ামী নেতারা গণতন্ত্র ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য আঁসুর বন্যা বহাইতেছেন। সকলেই জানেন যে, গণতন্ত্রের এই খাদেমরাই নাজিমুদ্দীন ওজারত ভাঙ্গিয়া দেওয়ায় মরহুম গােলাম মােহাম্মদের স্বেচ্ছাচারকে অভিনন্দিত করিয়াছিলেন। তখন জনাব গােলাম মােহাম্মদের ঢাকা আগমন উপলক্ষে তৎকালীন যুক্তফ্রন্টের ভাঙ্গ হাটের আর এক তরফের সাথে কিভাবে আওয়ামী নেতারা মাল্যদান প্রতিযােগিতায় নামিয়েছিলেন; সেই বিস্ময়কর দৃশ্য আজো অনেকে ভুলিয়া যান নাই। গণতন্ত্রের এই “খাকসার বান্দারাই” সংখ্যাগুরু পূর্ব পাকিস্তানকে সংখ্যাসাম্যের বিধান মানিয়া লইতে বাধ্য করিয়াছিলেন। অবশ্য বিড়ালের ভাগ্যে শিকা ছিড়ার আশা নাই। যদি এঁরা সত্যই একদিন গদি পান, তবে ছয়দফার কথা যে তারা সেদিন বেমালুম ভুলিয়া যাইবেন, তা ধরিয়া লওয়াই যাইতে পারে। সুতরাং আওয়ামী নেতাদের ছয় দফা ও অন্যান্য বিরােধী দলের পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতির বড় বড় বুলি যে লােক ভুলান ছলাকলা মাত্রঃ তা বুদ্ধিমান লােকের বুঝিয়া উঠা কঠিন নয়।
বিরােধী দলগুলির বিচিত্র ভিন্ন ভিন্ন যুক্ত এবং বিযুক্ত বহু দফার রাজনীতির স্বরূপ জনগণ ভাল করিয়াই এতদিনে ধরিয়া ফেলিয়াছে। ১৯৫৪ সন হইতে তারা বারবার এসব চাল দফায় দফায় দিয়া আসিতেছেন। ১৯৫৪ হইতে ১৯৬৬ সনের ব্যবধান উল্লেখযােগ্য। জনগণ তাদের স্বার্থের শত্রুমিত্রকে এই সময়ের মধ্যে ভালভাবেই চিনিয়া ফেলিয়াছেন। সুতরাং ছয় দফা হােক আর যে কোন দফাই হােক, আর কোনাে ভাওতায়ই তারা এবার ভুল করিবে না, এ বিশ্বাস আমাদের আছে।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব