সংবাদ
২২শে আগষ্ট ১৯৬৭
৬-দফার সিদ্ধান্তের প্রতি করাচী
আওয়ামী লীগের সমর্থন ঘােষণা
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
আওয়ামী লীগের জরুরী কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন ঘােষণা করিয়া করাচী প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব আসিম ও সাধারণ সম্পাদক জনাব খলিল আহমেদ তিরমিজি এক বিবৃতি প্রদান করিয়াছেন। নিম্নে উক্ত বিবৃতিটি প্রকাশ করা হইলঃ
“৬-দফার প্রতি পুনরায় সমর্থন ঘােষণা করিয়া ও ৮-দফা কর্মসূচী প্রত্যাখ্যান করিয়া পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে যে সাহসীক ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইয়াছে, আমরা উহার প্রতি অভিনন্দন জানাই। করাচী প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের পক্ষ হইতে আমরাও পুনরায় ৬-দফা কর্মসূচী এবং উহা বাস্তবায়নের সংগ্রামের প্রতি আমাদের সমর্থন ঘােষণা করিতেছি।”
“পার্টি গঠনতন্ত্র ও সিদ্ধান্ত অমান্য করিয়া যে ১৪ জন সদস্য পি ডি এম-এ যােগদান করিয়াছেন, আমরা তাহাদেরকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্তের প্রতিও সমর্থন জানাইতেছি। গত ১৯শে আগষ্ট হােটেল ইডেনে পার্টির গঠনতন্ত্র অনুসারে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে যােগদানকারী সদস্যদের মধ্যে যে সাহস ও উদ্দীপনা লক্ষ্য করা গিয়াছে, উহা আমাদেরকে উৎসাহিত করিয়াছে। আমাদের সুচিন্তিত অভিমত এই যে, ১৯শে আগষ্ট অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে শতকরা ৯০ জনেরও অধিক কাউন্সিলর যােগদান করেন। ৩০শে সেপ্টেম্বর যে তথাকথিত কাউন্সিল সভা আহ্বান করা হইয়াছে, উহা গঠনতন্ত্রের পরিপন্থী। এই তথাকথিত কাউন্সিল অধিবেশন যদি কোনদিন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে যদি কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাহা হইলে উহার প্রতি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কোন অংশের সমর্থন থাকিবে না।
“এখানে স্মরণ করা যাইতে পারে যে, করাচী প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ ইতিপূর্বেই শেখ মুজিবের ৬-দফা কর্মসূচীকে নিজের কর্মসূচী হিসাবে গ্রহণ করিয়াছে এবং এই কর্মসূচীর সপক্ষে করাচী ও পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে জনমত সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে। ফলে ৬-দফা বিরােধী ব্যাপক অপপ্রচারের দরুন পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে যে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়, ক্রমেই উহার অবসান ঘটিতেছে। এক্ষণে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ক্রমেই ইহা অনুধাবন করিতেছেন যে, ৬-দফা কর্মসূচী বাস্তবায়নের মধ্যেই দেশের দুই অংশের জনগণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তি নিহিত রহিয়াছে। এই কর্মসূচী পাকিস্তানের অত্যাবশ্যকীয় ঐক্য ও সংহতির চাবিকাঠি স্বরূপ।”
লুন্দখােরের চ্যালেঞ্জ
রাওয়ালপিণ্ডি, ২১শে আগষ্ট (এ পি পি)।-পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী ও পি ডি এম সদস্য জনাব গােলাম মােহাম্মদ লুন্দােের এক বিবৃতিতে পি-ডি-এম-এ যােগদানের বিরােধিতা করিয়া পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে, উহার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করার কোন অধিকার মিসেস আমেনা বেগম ও জনাব নজরুল ইসলামের ‘নকল গ্রুপ’এর নাই।
তিনি বলেন, বস্তুতঃ আগামী ২৯শে সেপ্টেম্বর আইনসঙ্গতভাবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউনসিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হইবে।
“যেসব আওয়ামী লীগ সদস্য এখনও পার্টি ম্যাণ্ডেট অমান্য করিয়া পিডিএম-এ যােগদান ও পিডিএম-এর সহিত সহযােগিতা করিতেছেন তাহাদেরকে পার্টি হইতে বহিষ্কার করা হইবে” বলিয়া পূর্ব পাকিস্তান। আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইয়াছে, জনাব লুখাের উহা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, ৬-দফার প্রচারকেরা সকলেই বিচ্ছিন্নতাবাদী।
তিনি বলেন, পিডিএম-এর ৮-দফায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের সকল দাবীই রহিয়াছে। কেবলমাত্র ৬-দফা কর্মসূচীর বিচ্ছিন্নতাবাদী লক্ষ্যসমূহ এই কর্মসূচীতে নাই। তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদকেই ৬-দফা কর্মসূচীর প্রধান লক্ষ্য বলিয়া অভিমত প্রকাশ করেন। রাজশাহীর মুজিবর রহমানের বিবৃতি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জনাব মুজিবর রহমান (রাজশাহী) এক বিবৃতিতে বলেন যে, ১৯শে আগষ্ট ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান। আওয়ামী লীগের যে তথাকথিত কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হইয়াছে, ১৪ই আগষ্ট অনুষ্ঠিত পার্টির ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে উহাকে পার্টির গঠনতন্ত্রের পরিপন্থী বলিয়া আখ্যা দেওয়া হয়। কাজেই ঐ কাউন্সিলে গৃহীত সিদ্ধান্ত কোন পার্টি সদস্যের প্রতি প্রযােজ্য নহে। জনাব মুজিবর রহমান বলেন, ঐ কাউন্সিলে ৮ শত কাউন্সিলর যােগদান করিয়াছে বলিয়া যে দাবী করা হইয়াছেন, উহা ঠিক নহে। তাহার মতে ১শত ৩৫ জনের বেশী খাঁটি কাউন্সিলর ঐ কাউন্সিলে যােগদান করেন নাই। এই সংখ্যা কাউন্সিল অধিবেশনের কোরামের জন্য যথেষ্ট নহে। তিনি উল্লেখ করেন যে, ওয়ার্কিং কমিটির ১৪ই আগষ্টের তথাকথিত কাউন্সিল অধিবেশনকে গঠনতন্ত্রের পরিপন্থী আখ্যা দেওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এই যে, তখনও পর্যন্ত অনেক জেলারই কাউন্সিল লিষ্ট পার্টির প্রাদেশিক কার্যালয়ে খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। বস্তুতঃ দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, পাবনা, যশাের, খুলনা, ফরিদপুর, কুমিল্লা, বরিশাল ও সিলেট জেলা হইতে কাউন্সিলররা ঐ কাউন্সিলে যােগদানের সুযােগ পান নাই।
যেসব কাউন্সিলর, জেলা প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারী ঐ কাউন্সিলে যােগদান করেন, জনাব মুজিবর রহমান তাহাদের নাম প্রকাশ করার জন্য অনুরােধ জানান।
পার্টি বিরােধী কার্যকলাপের জন্য পার্টির যে ১৫ জন নেতৃস্থানীয় সদস্যকে প্রাথমিক সদস্যপদ ও অন্যান্য পদ হইতে সাসপেণ্ড ঘােষণা করিয়া যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হইয়াছে তৎসম্পর্কে জনাব রহমান বলেন, পার্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতির নিকট আমি কি জানিতে পারি যে, গঠনতন্ত্রের কোন ধারাবলে ঐসব কাউন্সিলরকে সাসপেন্ড করার অধিকার পাইলেন?
জনাব রহমান গঠনতান্ত্রিক বিধান ও পি ডি এম-এ যােগদান সম্পর্কিত আলাপ-আলােচনার বিবরণ দান করিয়া বলেন যে, সাসপেণ্ড করার সিদ্ধান্তটি উদ্দেশ্যমূলক ও বেআইনী।
জনাব রহমান তাহার বিবৃতিতে বলেন, তথাকথিত কাউন্সিলের নেতারা শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ভাঙ্গাইয়াছেন। বিবৃতির একাংশে তিনি বলেন যে, তিনিও শেখ মুজিবর রহমানের সহিত সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাঙ্কারে শেখ মুজিবুর রহমান তাহাকে বলেন, যদি কাউন্সিল পি ডি এম-এর কর্মসূচী গ্রহণ করে তাহা হইলে তিনিও উহা গ্রহণ করিবেন। তবে ৬-দফা কর্মসূচী গৃহীত হইলে তিনি কৃতজ্ঞ থাকিবেন।
পরিশেষে জনাব রহমান তাহার বিবৃতিতে বলেন, “যে মুহূর্তে সকল গণতান্ত্রিক শক্তি ও দলের অভ্যন্তরে ঐক্যের একান্ত প্রয়ােজন, সে মুহূর্তে প্রতিক্রিয়াশীল মহলকে আরও শক্তিশালী করে এমন কোন কাজ না করার জন্য আমি সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানাইতেছি।”
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু তৃতীয় খণ্ড: ষাটের দশক॥ দ্বিতীয় পর্ব